ভিডিও EN
  1. Home/
  2. বিশেষ প্রতিবেদন

কোটিপতির আয়টাও আমরা নির্ধারণ করে দিতে পারছি না

সায়েম সাবু | প্রকাশিত: ১০:০৪ পিএম, ২৫ জুন ২০১৯

মামুন রশীদ। বিশিষ্ট ব্যাংকার। গবেষণা করছেন, লিখছেন অর্থনীতির নানা বিষয় নিয়ে। ব্যাংক ব্যবস্থা, উন্নয়ন, বাজেটসহ অর্থনীতির নানা প্রসঙ্গ নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজ-এর।

অর্থনীতির ওপর রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের নেতিবাচক দিক তুলে ধরে বলেন, ‘ব্যাংক খাত প্রায় বিপর্যয়ের মুখে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষমতা খর্ব করার কারণে ব্যাংক ব্যবস্থায় নানা অনিয়ম গেড়ে বসেছে। অর্থনীতির স্থিতিশীলতার জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর অধিক গুরুত্ব দেন এ গবেষক। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে শেষটি।

আরও পড়ুন >> খাদের কিনারায় ব্যাংক খাত

জাগো নিউজ : ব্যাংক খাতের নানামুখী সংকটের কথা বলেছিলেন আগের পর্বে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় কী?

মামুন রশীদ : আপাতত ব্যাংক সংকটের সমাধান দেখছি না। ব্যাংক নিজে তো সব সমস্যা তৈরি করেনি। সবার সমস্যা খুঁজে বের করতে হবে। ব্যাংকের দক্ষতা বাড়াতে হবে। প্রযুক্তির চাদরে ঢেকে ফেলতে হবে ব্যাংক খাতকে। ব্যক্তিকেন্দ্রিক লেনেদেনে ব্যাংকের উন্নয়ন ঘটাতে হবে। সর্বোপরি রাজনীতির বাইরে অর্থনীতিকে মূল্যায়ন করতে হবে।

জাগো নিউজ : রাজনীতি নিয়েই তো নানা প্রশ্ন। অস্থিরতা সর্বত্রই। চাইলে অর্থনীতিকে রাজনীতির বাইরে রাখা সম্ভব নয় কি?

মামুন রশীদ : আমরা পরম্পরায় অসম্ভব করে ফেলেছি। চাইলেই অর্থনীতিকে রাজনীতির বাইরে আনা সম্ভব নয়। কিন্তু আমরা তো এগিয়ে যাওয়ার কথা শোনাচ্ছি। এ কারণেই বিপরীত পক্ষকে কথা বলতে দিতে হবে।

অন্য সরকারের সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন বলে তার কথা শোনা হয় না। এটা তো আত্মঘাতী। ওই গভর্নর অর্থনীতির জন্য ভালো কোনো পরামর্শ দিতেই পারেন। এ মানসিকতার পরিবর্তন না ঘটলে বিপদ আরও বাড়বে।

জাগো নিউজ : কী ঘটতে পারে ব্যাংকগুলোয়?

মামুন রশীদ : আমি মনে করি, কিছু কিছু ব্যাংককে ফেল (ব্যর্থ) করতে দেয়া উচিত। আমি সচেতনভাবে বলছি। নইলে ভালো ব্যাংকের মূল্যায়ন হবে না। গ্রাহকও বুঝবে না। ভালো-মন্দ না বুঝে যে কোনো ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন মানে দায় ব্যক্তিরও। সব দায় সরকারকে দেয়া যায় না।

সরকার ঢালাওভাবে ব্যাংকের অনুমোদন দিচ্ছে। সরকার তার রাজনীতির স্বার্থে দিতেই পারে। কিন্তু আমার তো বোধ, চোখ আছে। আমি তো অন্ধভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারি না।

আরও পড়ুন >> জোড়াতালি দিয়ে চলছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়

জাগো নিউজ : এ সংকটের পেছনে আর কী কী কারণের ওপর গুরুত্ব দেবেন?

মামুন রশীদ : কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয়ের টানাপোড়েন বর্তমান পরিস্থিতি আরও জটিল করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরও শক্তিশালী করার কথা ছিল। অথচ, দিন দিন দুর্বল করে দেয়া হচ্ছে। পাশের দেশ ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতো আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংককেও শক্তিশালী করতে হবে। এর গবেষণা সেল শক্তিশালী করা দরকার। তারাই ব্যাংকের উন্নয়নে পরামর্শ দেবেন। আর তা বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত দেবেন প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী ও মহান সংসদ।

জাগো নিউজ : খেলাপি ঋণের সংজ্ঞাও নির্ধারণ করে দিচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়…

মামুন রশীদ : আমরা এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছি। এটা ব্যাংক ব্যবস্থাকে আরও পেছনে নিয়ে যাবে। আইন করতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সহায়তায় আইন মন্ত্রণালয় ড্রাফট করবে। এরপর সংসদে যাবে পাসের জন্য। বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় এমন আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।

সবচেয়ে বিলাসবহুল স্থানে বাণিজ্যিক ব্যাংকের শাখা। অথচ সেখানে বড় বড় ব্যবসায়ীরা যান না। শাখাগুলোর ম্যানেজাররা বরং ওই ব্যবসায়ীর কাছে যান। আর ব্যাংকের শাখা অফিসে আসেন ব্যক্তি আমানতকারীরা। অথচ তাদের জন্য কোনো প্রোডাক্ট নেই, পরিষেবা নেই!

ব্যাংকের কাজ তো শুধু ঋণ প্রদান নয়। আরও অনেক কাজ আছে। মানবসম্পদ উন্নয়ন, বিনিয়োগের মধ্যে বেকারত্ব দূরীকরণ, প্রযুক্তির উন্নয়ন; ব্যাংকগুলো তা করতে পারছে না। ব্যাংকের কর্মকর্তারা পরিচালনা পর্ষদের খেদমত করতেই দিন পার করছেন। পরিচালনা পর্ষদের নির্দেশে ঋণ দিতেই তাদের সময় পার! আর কোনো কাজই করতে পারছেন না কর্মকর্তারা।

জাগো নিউজ : সঞ্চয়পত্রের নীতিতে পরিবর্তন এলো। এটা কীভাবে দেখছেন?

মামুন রশীদ : অর্থব্যবস্থায় সঞ্চয়পত্র কেনা-বেচা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও এখন অস্থিরতা কাজ করছে। প্রথমত, সঞ্চয়পত্রে সুদের হার অধিক। দ্বিতীয়ত, সঠিক ব্যক্তি সঞ্চয়পত্র ক্রয় করতে পারছেন না। জাতীয় পরিচয়পত্র, ব্যাংকের তথ্য এবং এনবিআর-এর মধ্যে সমন্বয় নাই।

আরও পড়ুন >> আমেরিকার পুঁজিবাদকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ

এ কারণে সঞ্চয়পত্র কেনার মধ্যে অনিয়ম রয়েছে। সাধারণত অবসরে যাওয়ার টাকা দিয়ে সঞ্চয়পত্র কেনার কথা, কিন্তু সেটা আর হচ্ছে না। ব্যাংকে গেলে বলা হচ্ছে সঞ্চয়পত্র নাই। আসলে ব্যাংকের মালিকরা বিশেষ ব্যক্তিদের কাছে আগেই তা বিক্রি করে দিচ্ছেন। সত্যিকার মানুষটি আর কিনতে পারছেন না।

সরকারের টাকা দরকার, তাই সরকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে টাকা সংগ্রহ করছে। এখানে কোনো নীতিমালাই মানা হচ্ছে না। ব্যাংকগুলোরও কোনো তদারকি নেই। অথচ, সরকারের ঋণ আর সুদের ভারে নুয়ে পড়ছে ব্যাংক খাত। অধিক সুদে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করা হচ্ছে। মানুষ ব্যাংকে আমানত না রেখে সঞ্চয়পত্র কিনছে।

এবারের বাজেটে (প্রস্তাবিত) সরকারকে প্রায় ৫৭ হাজার কোটি টাকার সুদ বাবদ ব্যয় ধরে রাখা হয়েছে। এ বিপুল পরিমাণ সুদের কারণে অর্থনীতির অন্যান্য খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। রূপপুর ও পদ্মা সেতুর মতো আরও বড় বড় প্রকল্প করতে গেলে আমাদের দেনা আরও বাড়বে, যদি আমরা অভ্যন্তরীণ রাজস্ব না বাড়াতে পারি। রাজস্ব না বাড়ালে বাংলাদেশ তো ঋণের ফাঁদে পড়ে যাবে।

জাগো নিউজ : সরকার তো উন্নয়নের জন্যই ঋণ করছে। জনস্বার্থ তো আছেই…

মামুন রশীদ : অধিক সুদে ঋণ করে আসলে উন্নয়ন নিশ্চিত করা যায় না। বিদেশি ঋণের সুদ তো জনগণকেই দিতে হচ্ছে। বলতে পারেন, কল্যাণমুখী নয়, গোঁজামিলের উন্নয়ন চলছে।

ভোগ্যপণ্যের বাজার প্রতিনিয়ত সম্প্রসারিত হচ্ছে। এখানে বিদেশের পণ্য প্রাধান্য পাচ্ছে। টাকা বাইরে চলে যাচ্ছে। ঈদ, পূজা, পহেলা বৈশাখের মতো অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে বাজার বড় হচ্ছে।

অথচ যারা অধিক আয় করছেন তাদের আমরা করের আওতায় আনতে পারছি না। সুশাসন, রাজনৈতিক জবাবদিহিতা ও সুবিচারের অভাবে আমরা আয়ের ওপর কর বসাতে পারছি না। এ কারণে ভোগের ওপর পরোক্ষ কর বসাতে হচ্ছে। এটা কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত নয়। অর্থনীতি চালিয়ে নেয়ার জন্যই এটা করতে হচ্ছে।

আরও পড়ুন >> বিশেষ সুবিধা পাচ্ছেন ঋণখেলাপিরা

জাগো নিউজ : কিন্তু আয়কারীও তো ভোগ করছেন…

মামুন রশীদ : চালের ওপর কর বসালেন। একজন রিকশাচালক চাল কেনেন আবার একজন কোটিপতিও চাল কেনেন। উভয়কেই সমান হারে কর দিতে হচ্ছে! অথচ, কোটিপতির আয়টাও আমরা নির্ধারণ করে দিতে পারছি না অথবা, তার আয়ের ওপর কর নিতে পারছি না। এতে সমাজে বৈষম্য তীব্র হচ্ছে। কোটিপতির টাকা বাইরে চলে যাচ্ছে।

জাগো নিউজ : এক্ষেত্রে আপনার পরামর্শ কী?

মামুন রশীদ : রাজনীতিতে সুশাসন না এনে আপনি ধনীদের কাছ থেকে কর আদায় করতে পারবেন না। একই সঙ্গে প্রযুক্তির উন্নয়ন এবং কর গবেষণার উন্নয়ন করতে হবে। কার কাছ থেকে কর আদায় করা এবং কীভাবে করতে হবে, সেজন্য গবেষণার প্রয়োজন আছে। কর পরিকল্পনা জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে, জোরালোভাবেই তা করতে হবে।

অভ্যন্তরীণ আয় না বাড়াতে পারলে বিদেশিদের কাছে যেতেই হবে। এতে জাতীয় অর্থনীতি শক্তিশালী হয় না। নিজস্বতা থাকে না। বিদেশি ঋণ নিয়ে প্রয়োজনীয় জায়গায় বিনিয়োগও করা যায় না। তাদের শর্তে বিনিয়োগ করতে হয়। আবার ঋণের সুদ দিতে সব শেষ হয়ে যায়। অথচ রাষ্ট্রীয় খাতগুলো ধ্বংস করা হচ্ছে। দুর্নীতি, সুশাসনের অভাবে বিপিসি, বিমান বা রেলের মতো প্রতিষ্ঠানে বছরে কোটি কোটি টাকা লোকসান দিতে হচ্ছে।

আরও পড়ুন >> সাইবার নিরাপত্তা ঝুঁকিতে ব্যাংক খাত

দুর্নীতি, কর আর ঋণখেলাপি হচ্ছে আমাদের জাতীয় অর্থনীতির শত্রু। রাজনীতিতে জবাবদিহিতার অভাবে এ তিন শত্রু ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে।

রাজনীতিতে বিরোধী শক্তির মত নেয়া হচ্ছে না। সংসদে বিরোধিতা নেই। অর্থনীতিতে যারা অভিজ্ঞ, তাদের মতামত গুরুত্ব পায় না। ভিন্ন মতের কাউকে উৎসাহ দেয়া হচ্ছে না।

জাগো নিউজ : বাংলাদেশের বিরোধী পক্ষ শুধু বিরোধিতার জন্যই মত দেয়। সংসদেও তাই। কার্যকর ভূমিকা তো তারাও রাখতে পারেনি…

মামুন রশীদ : রাজনীতি তো সেই ক্ষেত্রই তৈরি করতে দেয়নি। বিরোধিতাকে সবসময় বর্ষার প্রথম দিকের ময়লা পানি মনে করা হয়েছে। শেষে যে ভালো পানি মিলতে পারে, তা স্বীকারই করে না রাজনীতি। দুঃখ প্রকাশ করতেও দেয়া হয় না আমাদের সমাজ ব্যবস্থায়। তার মানে, অসহনশীলতা কোথায় চলে গেছে? মতামত না নিয়ে প্রতিপক্ষকে বরং নির্মূল করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

জাগো নিউজ : উন্নয়ন গণতন্ত্রের বাইরেও হতে পারে। অনেক সময় বিরোধিতা উন্নয়নের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। হংকং, চীন, সিঙ্গাপুরে কিন্তু আমরা গণতন্ত্রের চেয়ে উন্নয়নকেই দৃশ্যমান দেখি…

মামুন রশীদ : ওইসব দেশের মানুষ যে গণতন্ত্রের কাঙাল না, তার প্রমাণ কী? বরং গণতন্ত্র থাকলে আরও উন্নত হতে পারত, হয়তো। আপনি উন্নয়নের দোহাই দিয়ে আমার মতকে গলাটিপে মারবেন, তা তো হতে পারে না।

আরও পড়ুন >> সরকারের ব্যাংক নির্ভরতায় চাপে পড়বে বেসরকারি বিনিয়োগ

বিরোধীশক্তি দুর্বল মানছি। সরকার পক্ষ কী সংসদে বাজেটের ওপর ভালো আলোচনা রাখছেন? বাজেট আলোচনায় বিরোধী দলকে ঘায়েল করে কথা বলছেন। অন্য আলোচনা হচ্ছে। বাজেট আলোচনায় ৬০ শতাংশ আলোচনা হয় অন্য বিষয় নিয়ে। অথচ সংসদে বিরোধী পক্ষই নেই।

অর্থনীতিবিদ, সাবেক অর্থসচিব, গভর্নরের মতামত নিয়েও তো আলোচনা করা যায়। তা কি করেছে? অন্য দেশের শাসকরা কি এভাবে নিজেদের গুটিয়ে রেখে বাজেট ঘোষণা করেন?

জাগো নিউজ : বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে কী বলবেন?

মামুন রশীদ : আমরা আরও ভালোর দিকে যেতে পারতাম। সবার আগে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা দরকার। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আনা জরুরি। নজরদারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাধীন করে দিয়ে আরও শক্তিশালী করা। মেধাবীদের নিয়োগ দেয়া। সংসদ কার্যকর করা। তবেই এক উজ্জ্বল বাংলাদেশ গড়তে পারব আমরা।

এএসএস/এমএআর/এমএস

আরও পড়ুন