ভিডিও EN
  1. Home/
  2. বিশেষ প্রতিবেদন

রাষ্ট্র এখন শোষকের পক্ষে, শোষিতের বিপক্ষে

সায়েম সাবু | প্রকাশিত: ০৯:৫৫ পিএম, ১৬ জুন ২০১৯

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। বিশিষ্ট ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর। ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে সম্প্রতি মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র। বাজেট প্রক্রিয়াকে জনবিচ্ছিন্ন উল্লেখ করে নানা অসঙ্গতি তুলে ধরেন।

দেশের অধিকাংশ সম্পদ শতকরা পাঁচ ভাগ মানুষের হাতে দাবি করে তিনি বলেন, রাষ্ট্র, সরকার ধনিক শ্রেণির কাছে ক্রমাগত জিম্মি হয়ে পড়ছে। আলোচনা করেন ব্যাংক ও শেয়ারবাজার প্রসঙ্গেও। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে প্রথমটি

জাগো নিউজ : ২০১৯-২০ অর্থবছরের বিশাল অঙ্কের বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে। বিশ্লেষকদের কেউ বলছেন, বাস্তবসম্মত বাজেট; কেউ বলছেন এ বাজেট বাস্তবায়নযোগ্য নয়। আপনার বিশ্লেষণ কী?

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ : বাস্তবায়নের দিক থেকে বললে, এটি অনেক বড় বাজেট। আবার জাতীয় আয়ের দিক থেকে বললে, এ অঙ্কের বাজেট আসলে বিশাল নয়। কারণ আমাদের কর প্রবৃদ্ধির হার শতকরা মাত্র ১০ ভাগ। অথচ পাশের দেশ ভারতে করের হার শতকরা ২০ ভাগ এবং ভুটানে ৩০ ভাগ অতিক্রম করেছে।

মূলত, বাংলাদেশে ধনীরা ট্যাক্স দেন না এবং দিলেও তা যৎসামান্য। মূল সমস্যা এখানেই। যদি করের হার বাড়ানো যায়, তাহলে এ বাজেট বাস্তবায়ন করা সম্ভব। তা না হলে বাজেট বাস্তবায়নযোগ্য নয়।

অন্যদিকে কর সংগ্রহ করা না গেলেও জিডিপি আয় তো আছে। সুতরাং সেদিক থেকেও বাজেটকে একেবারে বড় বলা যায় না। এ টাকা থেকেই আয় করা সম্ভব।

জাগো নিউজ : রাজস্ব ঘাটতি প্রতি বছরই থেকে যায়। আদৌ আয় করা সম্ভব?

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ : প্রশ্ন ঠিক এখানেই। বহু করদাতাকে করের আওতায় আনার পথ বের করেছেন অর্থমন্ত্রী। এখানেও ভিন্ন কথা আছে। নতুন করদাতারা সাধারণত এক হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা কর দেবেন। এ টাকা দিয়ে বাজেটের ঘাটতি মেটানো সম্ভব নয়।

বাংলাদেশে টাকার বড় অংশ শতকরা পাঁচ ভাগ মানুষের হাতে। বাকি ৯৫ ভাগ মানুষের কাছে তেমন টাকা নেই। অথচ এ ৯৫ ভাগ মানুষের কাছ থেকেই সরকার ট্যাক্স আদায় করে। ধনী এ পাঁচ ভাগের কাছ থেকে তেমন ট্যাক্স আদায় করা সম্ভব হয় না। এ পাঁচ ভাগ মানুষের কাছ থেকে সঠিক উপায়ে কর আদায় করা গেলে ঘাটতি বাজেট পূরণ করা সম্ভব।

জাগো নিউজ : এ পাঁচ ভাগ তো খুবই প্রভাবশালী। তাদের কাছ থেকে আসলে যথাযথ উপায়ে কর আদায় সম্ভব কি?

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ : আমরা অতীতে প্রভাবশালীদের কাছ থেকে ঠিক মতো কর আদায় করতে দেখিনি। প্রশ্ন হচ্ছে, ধনীদের বেলায় কঠোর হওয়ার মতো শক্তি সরকার রাখে কি না? কারণ আমরা দেখেছি, ধনীরা এতই শক্তিশালী যে, তারা সরকারকেই বরং প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখেন।

পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে ধনী লোকের বৃদ্ধির সংখ্যা সবচেয়ে বেশি এবং সেটা আমেরিকা ও চীন থেকেও বেশি। অর্থাৎ ধনী দেশগুলোকেও আমরা হার মানিয়েছি। তার মানে, আমরা এখন মারাত্মকভাবে ধনতন্ত্রের দিকে যাচ্ছি। এমন ধনতন্ত্রের দিকে অগ্রসর হওয়ার মানেই হচ্ছে নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্তের নিঃস্ব হওয়া। অর্থাৎ গরিব মানুষের কাছে আর টাকা থাকবে না, আয়ের পথও থাকবে না। সুতরাং যার কাছে টাকাই নেই, তার কাছ থেকে কর আদায় করে বড় ঘাটতি মেটানো সম্ভব হয় না।

জাগো নিউজ : ধনীদের কাছ থেকে কর আদায় না করে উল্টো গরিবদের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে। এতে আয়বৈষম্য আরও তীব্র করবে কি না?

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ : হ্যাঁ, আয় বৈষম্য আরও তীব্র হবে। তবে লোকদেখানো হলেও এবার ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য ছোট একটি থোক বরাদ্দ রাখা হয়েছে। ১০০ কোটি টাকা রাখা হয়েছে এবারের বাজেটে। এ টাকা প্রয়োজনের তুলনায় কিছুই না। তবুও নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে একটি ভালো পদক্ষেপ।

আমি মনে করি, এ ১০০ কোটির সঙ্গে ব্যাংক সিস্টেমকে পরিপূরক করে যদি এক হাজার কোটি টাকা করা যেত, তাহলে একটি শুভসূচনা হতে পারত। অর্থাৎ সরকার ও ব্যাংকের যৌথ উদ্যোগে উদ্যোক্তা লালন করার একটি প্রয়াস থাকত। তা করা হয়নি।

সংবিধানে স্পষ্ট করে বলা আছে, সমাজ হবে বৈষম্যহীন। বঙ্গবন্ধু বৈষম্যহীন অর্থনীতির কথা বলেছেন বারবার। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, সমাজ শোষক এবং শোষিত- এ দুই ভাগে বিভক্ত। তিনি শোষিতের পক্ষে বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন।

কিন্তু সরকার এখন শোষকের পক্ষে, শোষিতের বিপক্ষে। বঙ্গবন্ধুর নীতি থেকে বেরিয়ে আসা আমাদের জন্য নিঃসন্দেহে ভয়ঙ্কর হবে। পুঁজিবাদে আমরা আমেরিকাকেও ছাড়িয়ে গেছি। আমেরিকার পুঁজিও কিছু নিয়ম-কানুন মেনে চলে। আমাদের এখানে নিয়মের কোনো বালাই নেই।

জাগো নিউজ : উন্নয়ন, প্রবৃদ্ধি তো হচ্ছে…
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ : উন্নয়ন, প্রবৃদ্ধি যা হচ্ছে, তা বাংলাদেশের নয়। উন্নয়নের সুবিধা শতকরা পাঁচ ভাগ মানুষের, যারা বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বও করেন না। তারা সুযোগ পেলেই বিদেশে অর্থপাচার করে আসছেন। গত ১০ বছরে ছয় লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে বলে খবর এলো। এর বাইরেও পাচার হচ্ছে। পাচার হয়েছে আগেও। সাধারণ মানুষ কিন্তু অর্থপাচারের ক্ষমতা রাখেন না।

অথচ অর্থপাচার নিয়ে অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। তার মানে সরকার জানার পরও প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না। অথচ এটি একটি গুরুতর সমস্যা এবং সমাধান সময়ের দাবি।

জাগো নিউজ : এবারের বাজেট বাস্তবায়নের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ হয়েছে, তা নিয়ে কোনো বিশ্লেষণ আছে কী?

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ : বাজেট বাস্তবায়ন হবে রাজস্ব আয়ের ওপরে। কিন্তু যারা কর দেয়ার কথা তারা দেন না। বিশেষ শক্তি প্রয়োগ না করলে আয় বাড়বে না। আমি মনে করছি, প্রায় ৭৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব ঘাটতি থাকবে। এবারের ঘাটতি বাজেট রাখা হয়েছে এক লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা।

জাগো নিউজ : বলা হচ্ছে, সরকার এখন অধিক শক্তিশালী। সংসদেও ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিত্ব বেশি। কর আদায়ে শক্তি প্রয়োগ করতেই পারে?

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ : ওই পাঁচ ভাগ ধনী ব্যবসায়ীদের সরকার তদারকি করতে পারছে না বরং ব্যবসায়ীরাই এখন সরকারকে তদারকি করছেন। সরকার এবং পাঁচ ভাগ ধনী মিলেই দেশ শাসন করছে। এ কারণেই কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারবে না সরকার। বলতে পারেন, সরকারের মধ্যে ব্যবসায়ীরা আরেকটি সরকার হিসেবে কাজ করছে।

ব্যাংক খাতের একটি উদাহরণ দিয়ে বলি। বাজেটের আগেই এ সেক্টরে দুটি সার্কুলার ইস্যু হয়েছে। সম্ভবত অর্থমন্ত্রীর নির্দেশে হয়েছে। প্রথমটি হচ্ছে, খেলাপি ঋণের সংজ্ঞার পরিবর্তন। আমরা নিয়ম করেছিলাম, তিন মাস যদি কোনো খেলাপি থাকে তাহলে তাকে খেলাপি ঋণ বলা হবে। এটিই বিশ্বের নিয়ম।

হঠাৎ করে নিয়ম পরিবর্তন করে বলা হলো, তিন মাস নয়, নয় মাস যদি খেলাপি থাকে তাহলে সেটা খেলাপি ঋণ হবে। অথচ আজ থেকে ১৫ বছর আগের নিয়ম ছিল এটি। আমরা নিয়ম পরিবর্তন করে তিন মাস করেছিলাম। এখন ফের পেছনে নিয়ে যাওয়া হলো। সার্কুলার জারি হয়েছে এবং তা প্রতিপালনের নির্দেশও দেয়া হয়েছে।

এতে করে প্রকৃত খেলাপিরা ছাড় পেয়ে যাবেন। কাগজে-কলমে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমে যাবে ঠিক, কিন্তু প্রকৃত অর্থে খেলাপি আরও বাড়বে। এটি অত্যন্ত দুশ্চিন্তার বিষয়।

এএসএস/এমএআর/পিআর