নিপীড়িত হলেও কথা বলব-ই
নুরুল হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) ভিপি (সহ-সভাপতি)। ঢাবির এ শিক্ষার্থী কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে বিশেষ আলোচনায় আসেন। সেই সঙ্গে কয়েক দফা হামলারও শিকার হন।
আন্দোলন, ডাকসু নির্বাচন, রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি সমালোচনার কেন্দ্রেও আছেন এ ছাত্রনেতা। সম্প্রতি তিনি মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সায়েম সাবু।
জাগো নিউজ : সম্প্রতি ঢাকার বাইরে ইফতার অনুষ্ঠানে গিয়ে হামলার শিকার হলেন। মনে হচ্ছে নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেও পাবলিক অনুষ্ঠানে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছেন।
নুরুল হক : সরকার ভিন্ন মতের পথ চিরতরে রুদ্ধ করতে চাইছে। আওয়ামী লীগ হামলা, মামলা করে বিরোধী শক্তিকে কোণঠাসা করে রেখেছে। একইভাবে ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কার্যক্রমের ভয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা নিজেদের অধিকার নিয়ে কথা বলতে পারছেন না।
আরও পড়ুন >> দুর্নীতি অবশ্যই সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ
ছাত্রলীগের সন্ত্রাসকে উপেক্ষা করে আমরা জনসম্পৃক্ত অধিকার নিয়ে কথা বলছি, যার প্রমাণ আমরা কোটা সংস্কার আন্দোলনে দিতে পেরেছি। ছাত্রলীগ একাধিকবার আমাদের ওপর হামলা করেছে। সরকার মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করেছে। আমরা কিন্তু দাবি আদায় করেই ছাড়ছি। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনেও আমরা সমর্থন দিয়ে দৃশ্যত সফল হয়েছি। আমরা প্রশ্নফাঁসের বিরুদ্ধে কথা বলে চাপ সৃষ্টি করতে পেরেছি। প্রশাসন প্রশ্নফাঁসের হোতা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের শনাক্ত করেছে। ছাত্রলীগের কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য ভেঙে দিতে পেরেছি।
এসব কারণেই ছাত্রলীগ মনে করছে, ক্যাম্পাসগুলোতে এখন তাদের প্রতিপক্ষ ‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার পরিষদ’। এ কারণে ছাত্রলীগ জঙ্গি ও হিংস্র সন্ত্রাসীদের মতো আচরণ করছে।
জাগো নিউজ : এ পরিস্থিতির মধ্যে আসলে আপনার লক্ষ্যটা কী?
নুরুল হক : রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা মানুষকে সুরক্ষা দেয়ার পরিবর্তে ভীত-সন্ত্রস্ত করে তুলছে। রাষ্ট্র নিজেই নাগরিকের অধিকার ক্ষুণ্ন করলেও মানুষ তা নিয়ে কথা বলতে সাহস পাচ্ছে না। আইনের পর আইন করে মানুষের বাকস্বাধীনতা হরণ করা হচ্ছে। ডিজিটাল নিরাপত্তার নামে মানুষকে বেঁধে ফেলা হচ্ছে। সামাজিক মাধ্যমেও মত প্রকাশ করতে পারছে না মানুষ।
এমন পরিস্থিতি কখনই স্থায়ী হতে পারে না এবং এর বিরুদ্ধে কাউকে না কাউকে কথা বলতেই হয়। জনসম্পৃক্ত বিষয়ে অর্থাৎ যেখানে মানুষের অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে, সেখানে আমরা কথা বলব।
জাগো নিউজ : শিক্ষার অধিকার নিয়েই তো আপনারা সামাল দিতে পারছেন না…
নুরুল হক : ষাটের দশকের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস সবারই জানা। স্বাধীনতার আগে রাজনৈতিক দলগুলোর চেয়ে ছাত্র সংগঠনগুলোই জোরাল ভূমিকা রাখে। অথচ স্বাধীনতার পর আমরা আমাদের মৌলিকত্ব হারিয়েছি। চেতনবাজদের হাতেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিনষ্ট হয়েছে। ৪৮ বছরেও আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। গণতন্ত্রের নামে আমরা একের পর এক স্বৈরতন্ত্র দেখেছি। এমন শাসন ব্যবস্থায় সব শ্রেণির মানুষই তার অধিকার হারা হয়। ছাত্ররাই একমাত্র সবার অধিকার নিয়ে কথা বলতে চায়।
জাগো নিউজ : তার মানে ষাটের দশকের আন্দোলন থেকে আপনি অনুপ্রাণিত হয়ে ছাত্রদের সংগঠিত করতে চাইছেন?
নুরুল হক : মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর যে ছাত্র সংগঠনগুলো রয়েছে, তারা কোনোভাবেই শিক্ষার অধিকার নিয়ে কথা বলছে না। তারা ক্ষমতার সিঁড়ি হয়ে কাজ করছে। বরং তারা মানুষের অধিকার হরণ করতে মরিয়া। আমরা সে অধিকার ফিরিয়ে দিতে চাই এবং ষাটের দশকের ছাত্র আন্দোলন থেকে অবশ্যই শিক্ষা নেয়ার অনেক কিছু আছে।
জাগো নিউজ : ষাটের দশকের ছাত্র আন্দোলন হয়েছিল সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক চেতনার ভিত্তিতে, পেছনে রাজনৈতিক দল ছিল। আপনার চেতনা আসলে কী? কোনো দলে ভিড়বেন কি না?
আরও পড়ুন >> শিক্ষায় গলদ আছে বলেই সমাজে বর্বরতা বাড়ছে
নুরুল হক : আমরা কোনো রাজনৈতিক দলের হয়ে কাজ করছি না। কোনো দলের পক্ষও নিতে চাই না, বিপক্ষেও যেতে চাই না। কিন্তু এটা খুব নিশ্চিত করেই বলতে চাই যে, আমরা ভালো কাজের সঙ্গে থাকব, খারাপ কাজের বিরোধিতা করব।
জাগো নিউজ : কিন্তু রাজনৈতিক কাঠামো ছাড়া এ বিরোধিতা হালে পানি পাবে কি?
নুরুল হক : রাজনীতি দিয়েই সবকিছু প্রভাবিত, তা মানছি। কিন্তু রাজনৈতিক কাঠামোই একমাত্র নিয়ন্ত্রক, তা মনে করার কারণ নেই। গণমাধ্যম, সুশীল সমাজও কিন্তু কখনও কখনও রাষ্ট্র, সমাজের নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় থাকে।
আমরা এমন একটি জায়গা থেকে শিক্ষা-সাংস্কৃতিক বিষয়ের পাশাপাশি রাষ্ট্র, সমাজের অসঙ্গতির বিরুদ্ধে সাধারণ ছাত্রদের অবস্থান নিতে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করছি। এখানে চেতনা তো কাজ করছেই। সেটা একধরনের রাজনীতি বলতে পারেন। কারণ রাষ্ট্র, সমাজের কোনো কিছুই রাজনীতির বাইরে নয়।
আমরা নিজেরা কোনো দলীয় ব্যানারে নাও থাকতে পারি, কিন্তু রাজনৈতিক সচেতনতা থাকা তো কোনো অপরাধের নয়। প্রত্যেকেই কোনো না কোনো আদর্শ বিশ্বাস করেন। সেই আদর্শ থেকে ভালোকে ভালো আর মন্দকে মন্দ বলতে পারাটাই রাজনৈতিক সচেতনতা। আমরা ঠিক সেটাই করতে চাইছি। এটা যদি আপনি রাজনীতি বলতে চান, তাতে আমার আপত্তি নেই।
জাগো নিউজ : আপনি ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করার কথা বলছেন। আবার নির্বাচিত হয়ে ছাত্রলীগের প্রতিনিধিদের সঙ্গে গণভবনেও গেলেন। সেখানে প্রধানমন্ত্রীকে ‘মা’ বলে সম্বোধনও করলেন। এতে আপনার অবস্থান নিয়ে দ্বি-চারিতা প্রকাশ পায় কি না?
নুরুল হক : শেখ হাসিনা বিশেষ এক দলের হলেও তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী। আমি আওয়ামী লীগ-বিএনপির বিরোধিতা করছি না। প্রধানমন্ত্রী গণভবনে দাওয়াত দিয়ে আমাদের সম্মানিত করেছেন। আমরাও সেই দাওয়াতে সাড়া দিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে সম্মানিত করেছি। আমার মায়ের সঙ্গে তুলনা করে নারী সমাজের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছি। এখানে কোনো রাজনীতি ছিল না।
গণভবন থেকে বের হওয়ার পর আমার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে, আমি ছাত্রলীগে ফিরব কি না? আমি স্পষ্ট করে বলেছি, আমি ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে এখন নেই। ভবিষ্যতে কোনো রাজনৈতিক দলে ভিড়ব কি না, ভাবিনি।
জাগো নিউজ : আপনি ছাত্রশিবিরের রাজনীতি করেন- অনেকেই এমন অভিযোগ করছেন। ছাত্রলীগে থেকে শিবিরের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছেন বলেও গুঞ্জন আছে। কোটাবিরাধী আন্দোলনেও শিবিরের সহায়তা পেয়েছেন। এসব অভিযোগের জবাবে কী বলবেন?
নুরুল হক : কোটা সংস্কারের আন্দোলনের শুরু থেকেই সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা অভিযোগ করে আসছেন। তারা বলছেন, এটা বিএনপি-জামায়াতের ইন্ধনে হচ্ছে। কিন্তু তারা কোনো প্রকার প্রমাণ দিতে পারেননি। সরকারের গোয়েন্দারা মাটির নিচ থেকে জঙ্গিদের খবর বের করছেন। কোটা সংস্কারের আন্দোলনে বিষয়ে তাহলে তারা ব্যর্থ কেন? তারা তথ্য বের করুক।
আমরা এ সরকারের স্বৈরনীতির সমালোচনা করছি। আমরা সুশাসনের দাবিতেও আন্দোলন করছি। এসব কারণে সরকার আমাদের আন্দোলনকে ভয় পায়। এ ভয় থেকেই সরকারপক্ষের লোকেরা মিথ্যা প্রপাগান্ডা ছড়িয়ে আসছে। রাজনৈতিক রঙ দিয়ে আন্দোলন ক্ষতিগ্রস্ত করার চেষ্টা করেছিল, পারেনি। শেষপর্যন্ত ছাত্রদের গণদাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে সরকার।
আরও পড়ুন >> বেকার সমস্যাই সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ
আমাদের বিরুদ্ধে যদি জামায়াত-শিবিরের অভিযোগ প্রমাণিত হয়, তাহলে প্রধানমন্ত্রী আমাদের গণভবনে ডাকলেন কেন? তাহলে তিনি কি জামায়াত-শিবিরকে আমাদের মাধ্যমে পুনর্বাসনের দায়িত্ব নিলেন?
জাগো নিউজ : অনেকে মনে করেন, গণভবনে আপনাকে আমন্ত্রণ করা সরকারপক্ষের বিশেষ কৌশল ছিল...
নুরুল হক : আমি তা মনে করি না। ২৮ বছর পর শেখ হাসিনার আমলেই ডাকসু নির্বাচন হয়েছে। অন্য কোনো সরকার সেটা পারেনি। তিনি যুদ্ধাপরাধী জামায়াত-শিবিরকে ঘৃণা করেন, আমরাও ঘৃণা করি। সেই জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলে তাকে প্রধানমন্ত্রী অন্তত পাশে বসাতেন না। তিনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছেন, পরিবারের খোঁজ নিয়েছেন। সুতরাং গণভবন যাওয়া নিয়ে ছাত্রলীগের আরেকটি অপপ্রচার ছিল।
ছাত্রলীগ কোটা সংস্কার আন্দোলনে হাতুড়ি বাহিনী, নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনে হেলমেট বাহিনী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। ছাত্রলীগ নিজেদের কমিটি নিয়েও তো নানা ঘৃণার জন্ম দিল। নিজেদের দোষ আড়াল করতেই সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ শক্তি দেখাতে চাইছে। ছাত্রলীগ সন্ত্রাসী সংগঠন, এটা এখন প্রমাণিত।
জাগো নিউজ : এমন পরিস্থিতিতে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
নুরুল হক : আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীরা, মানুষের পক্ষে অবস্থান নিয়েছি। অন্যদিকে ছাত্রলীগ গণবিরোধী অবস্থানে আছে। ছাত্রলীগের পরিণতি মোনায়েম খানের ছাত্র সংগঠন ন্যাশনাল স্টুডেন্ট ফ্রন্টের (এনএসএফ) মতো হবে।
আমরা মানুষের কাছে যেতে চাই। রাজনৈতিক অধিকার আর সামাজিক সচেতনতা নিয়ে কথা বলতে চাই। নিপীড়িত হলেও আমরা কথা বলব-ই। ছাত্রলীগ যত আঘাত করুক, শরীরের ওপর দিয়ে হলেও তা সইতে প্রস্তুত আছি। আমরা পিছু হটব না।
জাগো নিউজ : কোনো ভয় কাজ করছে কি না?
নুরুল হক : বগুড়ায় একবার হামলা হলো। আবার ঢাকায় ফেরার পথে সিরাজগঞ্জে আওয়ামী লীগ নেতার ট্রাক দিয়ে আমাদের গাড়িকে চাপা দেয়া হলো। এসব ঘটনায় আতঙ্ক জন্ম নেবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে আতঙ্ক থাকলেও, আমরা মৃত্যুকে পরোয়া করি না।
আরও পড়ুন >> ১২৫টি ঘুরেছি, ঘুরব বাকি দেশগুলোও
জাগো নিউজ : তদন্ত কমিটি ডাকসু নির্বাচন ত্রুটিমুক্ত বলে দাবি করেছে। আপনি কী মনে করেন?
নুরুল হক : রাষ্ট্র, সরকার- সব জায়গাতে যে অসঙ্গতি, বিশ্ববিদ্যালয়ও এর বাইরে নয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্য কারা, কীভাবে নির্বাচিত হন, তা সবারই জানা। তিনি কী তদন্ত করবেন, তা সহজেই বোঝা যায়।
জালিয়াতির অভিযোগে তাৎক্ষণিকভাবে এক প্রভোস্টকে বহিষ্কার করা হলো। বস্তাভর্তি সিলমারা ব্যালট মিডিয়ায় প্রকাশ পেল। একমাত্র অসুস্থ মানুষরাই বলবেন, ডাকসু নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। শিক্ষকরা নৈতিকতা হারিয়ে ফেলছেন বলেই জাতির এ ক্রান্তিকাল।
এএসএস/এমএমজেড/এমএআর/এমএস