সরকারি গুদামে ধান সরবরাহকারীরা বেশির ভাগ প্রকৃত কৃষক নন
>> দায়-দেনা পরিশোধ করতেই কৃষকের ঘরের ধান শেষ
>> ধান না থাকায় কৃষকরা ব্যবসায়ীদের কাছে কার্ড (গুদামে ধান দেওয়ার) বিক্রি করে দিচ্ছেন
>> কৃষকের ডাটাবেজ তৈরি করতে দেরি হওয়ায় ধানও দেরিতে কেনা হচ্ছে
সরকার প্রকৃত কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনতে চাইলেও এখন আর প্রকৃত কৃষকরা সরকারি গুদামে ধান দিতে পারছে না। দেনা পরিশোধের আগেই ধান বিক্রি করায় সরকারের ঘরে/গুদামে এক টন ধান দেওয়ার মতো কৃষক এখন খুব বেশি নেই। ফলে এখন যারা গুদামে ধান দিচ্ছেন তাদের মধ্যে প্রকৃত কৃষকের চেয়ে ব্যবসায়ীই বেশি।
জানা গেছে, বৈশাখের প্রথম সপ্তাহ থেকে কৃষক ধান কাটা শুরু করে। শ্রমিকের দাম, সেচ, কীটনাশক, সার, ছেলে-মেয়ের স্কুল-কলেজের বেতনসহ সব ধরনের দায়দেনা পরিশোধ করতেই কৃষকের ঘরের ধান শেষ। ফলে সরকারের ঘরে/গুদামে এক টন ধান দেওয়ার মতো কৃষক এখন খুব কম আছে। এখন যারা গুদামে ধান দিচ্ছেন তাদের মধ্যে প্রকৃত কৃষকের চেয়ে ব্যবসায়ী বেশি। গুদামে ধান দেওয়ার জন্য যে সব কৃষক কার্ড পেয়েছেন ধান না থাকায় তাদের অনেকেই সামান্য লাভে ধান ব্যবসায়ীদের কাছে কার্ড বিক্রি করে দিচ্ছেন।
বগুড়া জেলার ধুনট থানার চরপাড়া গ্রামের কৃষক আকিমুদ্দিন শেখের সঙ্গে কথা বললে জানান, বৈশাখ মাসের প্রথম থেকে ধান কাটা শুরু হয়েছে। এখন জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষ দিকে। কয়েক দিন পর আসবে আষাঢ়। এতদিন ধান ঘরে ধরে রাখার মতো কৃষক আমাদের দেশে খুব কম আছে। কামলার মজুরি, সেচ, কীটনাশক, সার, ছেলে-মেয়ের স্কুল-কলেজের বেতনসহ সব ধরনের দায়দেনা পরিশোধ করতেই কৃষকের ঘরের ধান শেষ। বিশেষ করে এবার কামলার যে মজুরি ছিল তা পরিশোধ করতে বেশির ভাগ কৃষক ধান মাড়াই শেষেই বিক্রি করেছে।
এক প্রশ্নের জবাবে আকিমুদ্দিন শেখ বলেন, সরকার কৃষকের সুবিধার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে। কিন্তু সরকারের কাজের ধীরগতির কারণে কৃষক লাভবান হতে পারে না।
খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার এর আগে সংবাদ সম্মেলন করে সাংবাদিকের বলেছিলেন, ‘২৫ এপ্রিল (২০১৯) থেকে শুরু হয়ে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান চলবে।’ তবে ২৫ এপ্রিল পার হয়ে আজ ১১ জুন (মঙ্গলবার)। সরকারের গুদামে এখন যারা ধান দিতে পারবেন ধুনট থানায় তাদের লটারি গত ৯ জুন শেষ হয়েছে।
আকিমুদ্দিন শেখ বলেন, ধুনট সদর ইউনিয়ন থেকে সরকার ৪০ টন ধান নেবে। কৃষকের তালিকা পাঠানো হয়েছে ৩শ’ জনের। ফলে কর্তৃপক্ষ লটারি করতে বাধ্য হয়েছে। যারা প্রকৃত কৃষক তারা সরকারি গুদামে ধান দিতে পারবে না। কারণ, ধান কাটার সাথে সাথে কৃষকরা প্রয়োজন মেটানোর জন্য বিক্রি করেছেন।
তিনি আরও বলেন, যারা ধান সরবরাহের জন্য টিকিট পেয়েছেন, তাদের মধ্যে এমন লোক আছে যারা এক বিঘা জমিতেও ধান চাষ করেননি। তারা মৌসুমের সময় সস্তায় ধান কিনে রাখেন এবং দাম বাড়লে বিক্রি করেন। সে কারণে সরকার কৃষকদের সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা করলেও বারবার মধ্যস্বত্বভোগীরাই লাভবান হচ্ছেন।
এ বিষয়ে জাগো নিউজের নওগাঁ প্রতিনিধি জানান, নওগাঁ জেলায় গোডাউনে যে পরিমাণ ধান সরবরাহ করার কথা রয়েছে তার তুলনায় কৃষকের সংখ্যা অনেক বেশি। ফলে লটারির মাধ্যমে কৃষকদের কার্ড দেওয়া হয়েছে। এছাড়া অনেক কৃষকের হাতে এখন আর ধান নেই। যে কৃষকের কাছে ধান নেই অথচ কার্ড পেয়েছেন তারা এখন কার্ড বিক্রি করে দিচ্ছেন। এসব নিয়ে জেলা খাদ্য কর্মকর্তারাও অস্বস্তিতে আছেন।
ধান ক্রয়ের বিষয়ে কথা হয় লালমনিরহাট জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কাজী সাইফুদ্দিন অভির সঙ্গে। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, যে পরিমাণ ধান সরকার সংগ্রহ করবে তার তুলনায় কৃষকের সংখ্যা অনেক বেশি। সে কারণে ধান সরবরাহকারী কৃষককে শনাক্ত করতে লটারি করতে হয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কৃষকের তালিকা পেতে বিলম্ব হওয়ায় ধান সংগ্রহ করতেও বিলম্ব হচ্ছে। কৃষকদের তালিকা ডিজিলাইজড করা গেলে এ সমস্যা হতো না। ধান রোপনের সময়ই ইউনিয়ন পর্যায়ে কৃষকের নাম, গ্রাম, কতটুকু জমিতে ধান চাষ করছেন, এর আগে ধান সরবরাহ করেছেন কি-না ইত্যাদি তথ্য দিয়ে ডাটাবেজ তৈরি করা গেলে তালিকা নিয়ে আর ঝামেলায় পড়তে হতো না।
বাংলাদেশ কৃষক সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট এস এম এ সবুর জাগো নিউজকে বলেন, সরকারের কৃষি নীতি ঠিক না থাকার কারণে ধান কেনা নিয়ে নানা সমস্যা হচ্ছে। প্রকৃত কৃষকদের কাছ থেকে সরকার ধান সংগ্রহ করবে -এটা শুধু সান্ত্বনা। ধান কাটা শুরু হওয়ার দুই মাস পর ধান সংগ্রহ করতে গেলে সরকার কৃষকের কাছে ধান পাবে না -এটা সরকারও জানে।
আরও পড়ুন> আরও আড়াই লাখ টন ধান কিনবে সরকার
তিনি আরও বলেন, প্রকৃত কৃষকদের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ করার ব্যাপারে যে সব শর্ত আরোপ করা হয়েছে -সেটাও সঠিক নয়। গুদামে ধান সরবরাহের ক্ষেত্রে ১৪ ভাগের বেশি ময়েশ্চার (আর্দ্রতা) থাকা চলবে না। কৃষক যখন কাঁচা উঠানে ধান শুকায় তখন ময়েশ্চার থাকে ২০ থেকে ৩০ ভাগ। এ অবস্থায় কৃষক গুদামে ধান দিতে পারবে না। সুতরাং এ ক্ষেত্রে প্রতিবার যারা গুদামে ধান দিয়েছে এবারও তারাই দিচ্ছে। যে সব কৃষক কার্ড পেয়েছে তাদের অনেকের ঘরে ধান নেই। ফলে ব্যাবসায়ীদের কাছে কার্ড বিক্রি করে দিচ্ছেন।
চলতি বোরো মৌসুমে অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে ১৩ লাখ টন ধান ও চাল কিনবে সরকার। সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে প্রতি কেজি সিদ্ধ চাল ৩৬, আতপ চাল ৩৫ টাকা এবং ধান প্রতিকেজি ২৬ টাকা। এবার মোট সংগ্রহের মধ্যে দেড় লাখ টন থাকছে ধান, যা কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি কেনা হবে। আর মোট সাড়ে ১২ লাখ টন চাল সংগ্রহ করা হবে। এর মধ্যে ১০ লাখ টন সিদ্ধ চাল ও দেড় লাখ টন আতপ চাল।
এদিকে বর্তমানে দেশে খাদ্য মজুদ ভালো অবস্থানে রয়েছে। বর্তমানে সরকারি গুদামে প্রায় ১৩ লাখ টন চালের মজুদ রয়েছে।
এফএইচএস/আরএস/পিআর