রাজধানী সরে যাক নতুবা জাপানের নীতি গ্রহণ করুক
ড. আকবর আলি খান। বিশিষ্ট অর্থনীতি ও শিক্ষাবিদ। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা। সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব। অধ্যাপনা করছেন বেসরকারি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে। দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি ও উন্নয়নের নানা প্রসঙ্গ নিয়ে সম্প্রতি মুখোমুখি হন জাগো নিউজ-এর। উন্নয়ন নিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করলেও নানা চ্যালেঞ্জের কথাও তুলে ধরেন।
সুশাসন ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ না থাকায় দেশের অর্থনীতি হুমকির মুখে আছে; একই প্রশ্নে সামাজিক অস্থিরতাও বাড়ছে বলে অভিমত প্রকাশ করেন। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে শেষটি।
জাগো নিউজ : উন্নয়নের একটি ভিন্ন প্রসঙ্গে মতামত জানতে চাই। রাজধানী ঢাকা দিনদিন বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠছে। অনেকেই রাজধানী স্থানান্তরের মত দিচ্ছেন। আপনার অভিমত কী?
আকবর আলি খান : রাজধানী কোথায় সরিয়ে নেয়া হবে? অবকাঠামোগত ব্যর্থতা ও জনবিস্ফোরণের কারণেই রাজধানীর সমস্যা তীব্র হচ্ছে। এ সমস্যা কিন্তু চীনে হয়নি। অথচ হওয়ার কথা ছিল। সাংহাই একটা বড় শহর। একশতলা ভবন করা হয়েছে শতশত। কিন্তু সমস্যা হয়নি। কারণ সেখানকার অবকাঠামো নির্মাণ হয়েছে শত বছরের পরিকল্পনা নিয়ে। আমরা সেটা করতে পারিনি।
আরও পড়ুন > বাজেট পদ্ধতির পরিবর্তন জরুরি
ঢাকাকে বাঁচাতে হলে এর উন্নয়ন বাইরের দিকেও ছড়িয়ে দিতে হবে। রাজধানী দূরে নেয়া তো পরের কথা, একটি দফতরও বাইরে নেয়ার উদ্যোগ নেই, উপযুক্ত ব্যবস্থা নেই।
বাংলাদেশে জায়গার বড়ই সঙ্কট। চাইলেই রাজধানীকে ছড়িয়ে বা স্থানান্তর করা সম্ভব নয়। জায়গা থাকলে আজই রাজধানী সরিয়ে নেয়া যেত। অনেক দেশ তা-ই করেছে।
জাগো নিউজ : সমাধান কী?
আকবর আলি খান : রাজধানীবাসীকে রক্ষা করতে সরকারকে এখনই কিছু একটা করা দরকার। সমস্যা হচ্ছে, শুধু রাজধানী ঢাকা নয়, গোটা বাংলাদেশ নিয়েই আমি চিন্তিত। উন্নত বিশ্বের কথা মাথায় নিয়ে জীবনযাপন করতে চাইলে বাংলাদেশে সেটা সম্ভব নয়।
নিজেদের সমস্যা নিজেদেরই সমাধান করতে হবে। ইউরোপ-আমেরিকার উদাহরণ এখানে অকার্যকর। তবে জাপানের উন্নয়ন, অবকাঠামো আমাদের এখানে খানিক প্রযোজ্য হতে পারে। জাপান অল্প জায়গায় অর্থাৎ একটি অবকাঠামোতে একাধিক কাজ করে। সেখানকার অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তিন শিফটে শিক্ষা প্রদান হয়। জাপানের মতো অবশ্যই বিকল্প কিছু ভাবতে হবে। রাজধানী সরে যাক নতুবা জাপানের নীতি গ্রহণ করুক- দুটার একটা গ্রহণ করতে হবে।
জাগো নিউজ : ‘দারিদ্র্য’ নিয়ে গবেষণা করছেন। এখনকার অবস্থান কেমন দেখছেন?
আকবর আলি খান : বাংলাদেশের জাতীয় যে দারিদ্রসীমা রয়েছে, তাতে বাংলাদেশের দারিদ্র্য অনেক কমে এসেছে। কিন্তু জাতীয় দারিদ্র্যসীমায় অসঙ্গতি রয়েছে বলে আমি মনে করি।
আমাদের জাতীয় দারিদ্র্যসীমা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৯৭৩ সালে এবং সেটা অত্যন্ত নিম্ন পর্যায়ের। সেই নিম্ন পর্যায়ের মাপকাঠিতে আমরা এগিয়ে গেছি। কিন্তু নিম্ন-মধ্যবিত্তের যে মাথাপিছু আয়, তার মাপকাঠিতে নির্ধারণ করলে এখনও বাংলাদেশের ৫০ ভাগ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে রয়েছে।
আরও পড়ুন > সাধারণরা এগোতে চায়, রাজনীতিকরা পিছিয়ে দেয়
১৯৭৩ সালের জাতীয় দারিদ্র্যসীমার মাপকাঠি এখন অকার্যকর। ওই মাপকাঠি ছিল নিম্ন আয়ের দেশের। কিন্তু এখন আমরা নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে আছি। আবার আন্তর্জাতিক দারিদ্র্যসীমার মাপকাঠিতে বলতে গেলেও বাংলাদেশের দারিদ্র্যতার ব্যাপকতা রয়েছে।
জাগো নিউজ : দারিদ্র্যতার এ ব্যাপকতা নিয়ে মূল্যায়ন করা যায় কিনা?
আকবর আলি খান : বাংলাদেশে দুটি খাতের উন্নয়ন জরুরি। একটি শিক্ষা, আরেকটি স্বাস্থ্য।
শিক্ষা খাতে আমাদের পরিমাণগত অনেক অর্জন হয়েছে। কিন্তু শিক্ষার গুণগত মান ক্রমশই নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। শিক্ষার গুণগত মান কীভাবে উন্নত করা হবে, সে সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য কোনো উদ্যোগ নিতে দেখছি না।
অন্যদিকে স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ একেবারেই কম। যেটুকু বিনিয়োগ হচ্ছে, সেটুকু যথার্থভাবেও হচ্ছে না। হাসপাতাল করে শুধু দালানি উন্নয়ন ঘটছে। দালানে ডাক্তার থাকছে না। যন্ত্রপাতি নাই। রাষ্ট্রের এমন দৈন্যতার কারণে বেসরকারি চিকিৎসা ব্যবসা ফুলে-ফেঁপে উঠছে। সরকারি খাতের স্বাস্থ্যসেবার মান মোটেও উন্নত হচ্ছে না। আবার বেসরকারি খাতের স্বাস্থ্যসেবা নিয়েও কোনো তদারকি হচ্ছে না। সাধারণ মানুষ সেখানে অনেক ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। একই অবস্থা শিক্ষাতেও। এরকম প্রতিটা খাত ধরেই দুর্বলতা প্রকাশ করা যাবে।
আমি মনে করি না, রাতারাতি এসব সমস্যার সমাধান হবে। উদ্যোগ নেয়া জরুরি। কিন্তু আমরা সেই উদ্যোগ নিতে দেখছি না।
জাগো নিউজ : শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন নিয়ে সরকার তো উচ্ছ্বসিত...
আকবর আলি খান : সরকার কেন উচ্ছ¡সিত তার জবাব সরকারই ভালো দিতে পারবে। একজন অর্থনীতিবিদ হিসেবে আমি শুধু আলোচনা করলাম। আমার মনে হয়, অর্জন যেমন আছে, তেমনি বড় চ্যালেঞ্জও আছে।
জাগো নিউজ : এ অর্জনের পেছনে কাদের অবদানকে স্বীকৃতি দেবেন?
আকবর আলি খান : অর্থনৈতিক উন্নয়নে সরকারের চেয়ে গরিব মানুষের ভূমিকা অনেক বেশি। গরিব মানুষের মধ্যে প্রথম শ্রেণিতে রয়েছেন প্রবাসীরা, যারা বিদেশে কঠোর পরিশ্রম করে দেশে টাকা পাঠাচ্ছেন। এক কোটির মতো শ্রমিক দেশের বাইরে রয়েছেন। অত্যন্ত প্রতিকূল পরিবেশে তারা শ্রম দিয়ে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। এ রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সচল করে দিয়েছে।
আরও পড়ুন > একত্রিত হলেই রাজনীতির মাঠে ঐক্য অটুট থাকে না
আরেকটা হচ্ছে নারী শ্রমিক। বিশেষ করে পোশাক খাতে নারী শ্রমিকরা দেশের অর্থনীতিকে ক্রমশই চাঙ্গা রাখছে। আবার ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমেও গ্রামের অসহায় নারীরা স্বাবলম্বী হচ্ছেন। এসব নারীর অধিকাংশই অর্ধশিক্ষিত, অশিক্ষিত। অথচ তারা শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর থেকে অগ্রণী ভূমিকা রাখছেন।
তৃতীয় শ্রেণিতে রয়েছেন বাংলাদেশের কৃষক। নানা প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যেও কৃষকরা আধুনিক চাষাবাদের মাধ্যমে দেশে খাদ্যের যে নিরাপত্তা-বেষ্টনী তৈরি করেছেন, তা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করেছে।
জাগো নিউজ : এ তিন শ্রেণির মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে কী বলবেন?
আকবর আলি খান : ওই তিন দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সহযোগিতায় সরকার অর্থনৈতিক উন্নয়ন করতে পারছে। সরকার একা কিছুই করতে পারত না। অথচ তাদের উন্নয়নের জন্য সরকার তেমন কিছুই করে না।
প্রবাসীরা ১০-১৫ বছর দেশের বাইরে থেকে টাকা পাঠান দেশে। অথচ দেশে ফেরার পর তাদের কাছে আর টাকা থাকে না। সরকার চাইলে তাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারত।
একই অবস্থা পোশাক শ্রমিকদের বেলাতেও। এ খাত নিয়ে আমাদের এখনই সজাগ হওয়া প্রয়োজন। আধুনিক যন্ত্র ব্যবহারের কারণে মানুষের শ্রম কমে যাচ্ছে। কয়েক বছরের মধ্যে পোশাক শিল্পে শ্রমিকের চাহিদা কমে যাবে, এমন আভাসও মিলছে। ১৫ বছর পর এত শ্রমিকের প্রয়োজন হবে না। তখন এ শ্রমিকরা কী করবেন, তা এখনই ভাবা দরকার।
আবার কৃষির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারলেও অর্থনীতি হুমকির মুখে পড়তে পারে। সুতরাং এ বিষয়গুলোর ওপর এখনই গুরুত্ব দিয়ে যথাযথ উদ্যোগ নেয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি।
জাগো নিউজ : গরিব এই সাধারণ মানুষের এগিয়ে যাওয়ার অন্তরায়...
আকবর আলি খান : রাষ্ট্র, সমাজে সুশাসন না থাকলে গরিব মানুষ আরও ক্ষমতাহীন হয়ে পড়ে। তখন তাদের পক্ষে অর্থনৈতিক উন্নয়নে অংশগ্রহণ করা সম্ভব হয় না।
আরও পড়ুন > আলোচনায় বসলেই সমাধান কিন্তু তারা বসবেন না
সুশাসন হচ্ছে, মানুষের অধিকার নিশ্চিত করা। মানুষের অধিকার যদি নিশ্চিত করা না হয়, তাহলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
জাগো নিউজ : ব্যাংক খাতের সমস্যা নিয়ে উদ্বিগ্ন অনেকেই। এ বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
আকবর আলি খান : ব্যাংকের সমস্যা দৃশ্যমান। সরকার চাইলে ব্যাংক খাতের সঙ্কট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। না চাইলে সম্ভব নয়। অনেকেই কথা বলছেন। কিন্তু সরকার উদ্যোগ না নিলে কোনো কাজ হবে না।
ব্যাংক খাতের সমস্যা নিয়ে আমার বক্তব্য স্পষ্ট। সরকারের কারণেই এ খাতের সংকট।
জাগো নিউজ : শেয়ারবাজারের পরিস্থিতি নিয়ে কী বলবেন?
আকবর আলি খান : ব্যাংক ও শেয়ারবাজার পরিস্থিতির মধ্যে তফাৎ আছে। শেয়ারবাজার ঝুঁকিপূর্ণ বাজার। ঝুঁকি না থাকলে শেয়ারবাজার হয় না। কিন্তু সেই ঝুঁকি যদি সীমা অতিক্রম করে, তাহলে কেলেঙ্কারি হয়। তদারকি প্রতিষ্ঠানের অবহেলার কারণেই এমন হয়।
ব্যাংক খাতের টাকা লুটপাট না করার ক্ষেত্রে সরকার ভূমিকা রাখতে পারে। ব্যাংক যিনি প্রতিষ্ঠা করেন, তিনি মনে করেন, আমিই মালিক। অথচ সাধারণ মানুষের টাকা নিয়ে তারা ব্যবসা করেন। সাধারণ মানুষের আমানত রক্ষা করতে না পারলে ব্যাংকের প্রতি আর আস্থা থাকবে না।
জাগো নিউজ : নারী নির্যাতনসহ সামাজিক অস্থিরতা বাড়ছে। এজন্য কোন বিষয়কে দায়ী করা যায়?
আকবর আলি খান : আইনের শাসন না থাকলে সামাজিক অস্থিরতা বাড়বেই। দেশে আইন আছে। আইনের প্রয়োগ নিয়ে প্রশ্ন আছে। অপরাধ করে মানুষ পার পেয়ে যাচ্ছে। বিচার হয় না। সঠিক তদন্ত হয় না। সাজাও হয় না।
আরও পড়ুন > অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি বৈষম্যও বাড়ছে
আইনের সঠিক প্রয়োগ হলে সমাজে অবশ্যই এমন অপরাধের মাত্রা কমে যাবে। একই সঙ্গে জনসাধারণকেও তার অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। তবে অধিকারের বিষয়ে সচেতন হওয়ার জন্য দরকার গণতান্ত্রিক পরিবেশ। গণতান্ত্রিক পরিবেশ না থাকলে, অধিকার সচেতন মানুষও দুর্ভোগের শিকার হয়। সুশাসন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা না পেলে সামাজিক অস্থিরতা আরও বাড়বে।
জাগো নিউজ : একই প্রশ্নে উগ্রবাদেরও বিস্তার কি?
আকবর আলি খান : উগ্রবাদ বা জঙ্গিবাদ শুধু দেশের মাটিতেই গড়ে ওঠে, তা কিন্তু নয়। জঙ্গিবাদ একটা অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক সমস্যা।
জঙ্গিবাদের বিস্তার নিয়ে ভাবতে হচ্ছে। বলা হয়, মাদরাসা শিক্ষার্থীরা জঙ্গি হয়। এটা ভুল। আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও মানুষ জঙ্গি হচ্ছে। বুয়েট, মেডিকেলে পড়েও উগ্র মতাদর্শ লালন করছে। বাইরে থেকে ডিগ্রি নিয়েও জঙ্গি হচ্ছে।
জঙ্গিবাদ বড় জটিল সমস্যা। রাতারাতি এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। জঙ্গিবাদের শেষ দেখতে হলে আমাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে।
এএসএস/এমএআর/জেআইএম