অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানেও তৈরি হচ্ছে নকল ক্যাবল
>> ৩৬টি নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান তৈরি করে বৈদ্যুতিক ক্যাবল
>> নকল ক্যাবল তৈরি করছে অর্ধশতাধিক অবৈধ প্রতিষ্ঠানও
>> চীন থেকে তৈরি করে আনা হচ্ছে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ক্যাবল
>> অননুমোদিত তিন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে
রাজধানীসহ দেশের কোথাও না কোথাও প্রতিদিনই ঘটছে অগ্নিদুর্ঘটনা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আগুনের ভয়াবহতা আর্থিক ক্ষতিকেও ছাপিয়ে যায় মানবিক বিপর্যয়। এ বিষয়ে জাগো নিউজের দীর্ঘ অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে আগুনের নেপথ্যের নানা কারণ। এর মধ্যে অন্যতম ও প্রধান একটি কারণ হলো নকল ও নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, দেশি-বিদেশি যেকোনো প্রতিষ্ঠানের বৈদ্যুতিক পণ্য নকল করা হচ্ছে। খোদ রাজধানীতেই রয়েছে এমন অনেক প্রতিষ্ঠান। পুরান ঢাকার বংশাল, নবাবপুর, সিদ্দিকবাজার এলাকায় নকল ও নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি তৈরির কারখানার সন্ধান মিলেছে। নতুন মোড়কে দামি ব্র্যান্ডের লোগো হুবহু ব্যবহার করে বাজারজাত হচ্ছে এসব নকল পণ্য। শুধু রাজধানীতে নয়, বাজারজাত হচ্ছে সারাদেশেই।
আরও পড়ুন > আসলের চেয়ে নকলেরই ছড়াছড়ি
অথচ যেকোনো পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাত করতে হলে অনুমোদন নিতে হয় মান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই)। বৈদ্যুতিক ক্যাবল (তার) তৈরি করে এমন মোট ৩৬টি প্রতিষ্ঠানকে নিবন্ধন দিয়েছে বিএসটিআই। অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ঢাকার সানজিদা ক্যাবলের বিরুদ্ধে নকল ক্যাবল তৈরির অভিযোগ উঠেছে।
অনুমোদন নেই এমন অর্ধশতাধিক প্রতিষ্ঠান নিজস্ব কারখানায় তৈরি করছে নকল বৈদ্যুতিক ক্যাবল। সম্প্রতি গোপন অনুসন্ধান ও সরেজমিন এর সত্যতা পাওয়ার পর পলক এন্টারপ্রাইজ, বিএনবি ক্যাবলস ও নিউ ইআরবি ক্যাবলস নামে তিনটি অননুমোদিত প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করেছে বিএসটিআই।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দেশি-বিদেশি বিভিন্ন কোম্পানির বৈদ্যুতিক পণ্য নকল করা হচ্ছে রাজধানী বংশাল, নবাবপুর, সিদ্দিকবাজার এলাকায় কারখানাগুলোতে। নকল ও নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি তৈরির অভিযোগে ইতোমধ্যে ৩৫ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড, ১০ কোটি টাকার নকল ক্যাবলসহ বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম জব্দ এবং ৪৬ লাখ টাকা জরিমানা করে র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত।
আরও পড়ুন > শর্ট সার্কিট থেকে ৩৯ শতাংশ আগুন
বিএসটিআই সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, ঢাকার মোট ২৮টি প্রতিষ্ঠান ৫৮টি লাইসেন্সের অনুমোদন নিয়ে বৈধভাবে বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম তৈরি করছে। এর মধ্যে সুপার সাইন ক্যাবলসের নামে তিনটি লাইসেন্স রয়েছে। তাদের অনুমোদন দেয়া হয়েছে তবে কার্যক্রম পর্যবেক্ষণে রয়েছে। বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে- পারটেক্স ক্যাবলস লিমিটেড, তানিয়া ক্যাবলস, আজিজ ক্যাবলস ইন্ডাস্ট্রি, নিটো ক্যাবলস ইন্ডাস্ট্রি, আবুল আক্তার অ্যান্ড সন্স, এভারেস্ট ক্যাবলস ইন্ডাস্ট্রি, এলকো ওয়ার্স অ্যান্ড ক্যাবলস, সিটিজেন ক্যাবলস লিমিটেড, আরআর ইম্পেরিয়াল, বিবিএস ক্যাবলস, এবিএস ক্যাবলস, মেঘনা স্টার, করতোয়া ক্যাবলস, সানজিদা ক্যাবলস, বিএসএস ক্যাবলস, ইএফটি ক্যাবলস, হার্ড অন পাওয়ার, এইচবিআর ক্যাবলস, এসআরবি ক্যাবলস, তিতাস ক্যাবল, এএইচবি ক্যাবল, জারিন ক্যাবলস, এসকিউ ওয়্যার অ্যান্ড ক্যাবলস, তাজ ক্যাবলস, অ্যাপোলো পাওয়ার ক্যাবলস, পলি ক্যাবলস, সুপারসাইন ক্যাবলস ও ইভানা ক্যাবলস।
অন্যদিকে ঢাকার বাইরে বিআরবি ক্যাবলস, এসএসবি, অনিক ইলেকট্রনিক্স, অটোমেশন ক্যাবলস, রংপুর মেটাল ইন্ডাস্ট্রি, ফ্রি অ্যাম ইলেকট্রনিক্স, জেবি ক্যাবলস ও এবি ক্যাবলসসহ ১৪টি প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স অনুমোদন নিয়ে বৈদ্যুতিক ক্যাবল ও সরঞ্জাম তৈরি করে আসছে।
তবে সম্প্রতি অভিযান চলাকালে সানজিদা ক্যাবলসের বিরুদ্ধে নিজস্ব পণ্য তৈরির পাশাপাশি অন্য নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের অর্ডার করা নকল মালামাল তৈরির প্রমাণ মিলেছে র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালতে।
এ ব্যাপারে র্যাব সদর দফতরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাজারে আসলের চেয়ে ভেজাল কিংবা নকল ও মানহীন বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদির ছড়াছড়ি বেশি। রাজধানীর নবাবপুর, মাতুয়াইল ও বংশাল এলাকার কিছু ভুঁইফোড়, বেনামি প্রতিষ্ঠান নকল ও মানহীন বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি তৈরি করছে। যা সারাদেশে বাজারজাত হচ্ছে। আর কম টাকায় কিনে প্রতারিত হচ্ছেন ভোক্তারা।’
তিনি বলেন, ‘সানজিদা ক্যাবলস অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এ প্রতিষ্ঠান নিজস্ব ব্র্যান্ডের ক্যাবল তৈরির পাশাপাশি অন্য প্রতিষ্ঠানের নামেও ক্যাবল তৈরি করছে; যা সম্পূর্ণ বেআইনি। নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের মালামাল জব্দের পর জানা যায়, সানজিদা ক্যাবলসের কারখানায় তাদের নকল পণ্য তৈরি করা।’
সারওয়ার আলম বলেন, ‘একদম নিম্নমানের কিছু প্রতিষ্ঠান চীনের একদম নিম্নমানের কারখানা থেকে নানা ব্র্যান্ডের নামে ক্যাবল তৈরি করে নিয়ে আসছে। লেখা থাকছে মেড ইন চায়না। যা সম্পূর্ণ অবৈধ ও প্রতারণামূলক। একই কৌশলে নবাবপুরেই তৈরি হচ্ছে অবৈধ পণ্য। সেখানেও লেখা হচ্ছে মেড ইন চায়না।’
তিনি আরও বলেন, ‘অভিযানে গিয়ে জানতে পেরেছি, কিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে তারা যেসব বৈদ্যুতিক পণ্য বিক্রি করে সবই নকল। আবার কিছু প্রতিষ্ঠান নকল ও আসল দুটোই বিক্রি করে। বিসমিল্লাহ ক্যাবলস, খান অ্যান্ড সামির মার্কেটের টুটুল কারখানা, পলো ক্যাবলসসহ নামসর্বস্ব অর্ধশতাধিক প্রতিষ্ঠান নকল ক্যাবল তৈরিতে জড়িত- এমন প্রমাণও মিলেছে।’
এ ব্যাপারে বিএসটিআইয়ের পরিচালক প্রকৌশলী এস এম ইসহাক আলী জাগো নিউজকে বলেন, ‘অনুমোদন নেই, এমন ভুঁইফোড় কিছু প্রতিষ্ঠান বেআইনিভাবে নকল বৈদ্যুতিক পণ্য তৈরি ও বিক্রি করছে। সম্প্রতি অভিযানে গিয়ে প্রমাণ পাওয়ার পর অননুমোদিত তিনটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।’
আরও পড়ুন > ১৮ তলায় উঠেও বাঁচতে পারেননি বৃষ্টি
‘অনুমোদিত কোনো প্রতিষ্ঠানেও যদি নকল কিংবা নিম্নমানের ক্যাবল ও বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম তৈরির প্রমাণ মেলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে’- বলেন তিনি।
জেইউ/এনডিএস/এমএআর/জেআইএম