মূল পরিকল্পনায় ব্রডগেজ, নির্মাণ ডুয়েলগেজ!
>> প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয় ৯৮২ কোটি ৮৬ লাখ টাকা
>> প্রথম সংশোধনীতে ব্যয় বাড়ে ৪৫৩ কোটি ১৬ লাখ
>> প্রকল্পের মোট ব্যয় দাঁড়ায় এক হাজার ৪৩৬ কোটি
প্যাকেজ ডব্লিউডি-১। মূল পরিকল্পনায় এ প্যাকেজের আওতায় নাটোরের লালপুরের মাঝগ্রাম রেল স্টেশন থেকে পাবনা পর্যন্ত ২৫ কিলোমিটার নতুন ব্রডগেজ রেললাইন নির্মাণের কথা ছিল। কিন্তু মাঝগ্রাম স্টেশনে ব্রডগেজের পরিবর্তে নির্মাণ হয় ডুয়েলগেজ রেললাইন!
‘বাংলাদেশ রেলওয়ের ঈশ্বরদী থেকে পাবনা হয়ে ঢালারচর পর্যন্ত নতুন রেললাইন নির্মাণ’ প্রকল্পে এ ঘটনা ঘটে। মোট ১২টি প্যাকেজে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। ডব্লিউডি-১ প্যাকেজের আওতায় ব্রডগেজের পরিবর্তে ডুয়েলগেজ নির্মাণ করেছে ঢাকার মেসার্স ম্যাক্স অটোমোবাইলস প্রোডাক্টস লিমিটেড নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এটি বাস্তবায়নে আছে বাংলাদেশ রেলওয়ে।
আরও পড়ুন >> এক ভুলে গচ্চা ৩০০ কোটি!
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরীবিক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) ২০১৭ সালের জুনে দেয়া এক নিবিড় পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে বিষয়টি ‘বাঞ্ছনীয় নয়’ বলে উল্লেখ করা হয়।
প্রতিবেদন দেয়ার সময়ও ওই অংশের কাজ পুরোপুরি শেষ হয়নি। এরপরও মাঝগ্রাম রেল স্টেশন ডুয়েলগেজেই নির্মাণ হয়েছে বলে গত সোমবার (১৫ এপ্রিল ২০১৯) জাগো নিউজকে নিশ্চিত করেন ওই প্রকল্পের পরিচালক মো. আসাদুল হক।
শুধু তা-ই নয়, ১৮ মাসের মধ্যে ডব্লিউডি-১ প্যাকেজের নির্মাণকাজ শেষ করার কথা ছিল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স অটোমোবাইলসের। ২০১৭ সালের জুনে যখন ৩৬ মাস পার হয়, তখনও কাজ শেষ করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। এসব কারণসহ কমবেশি কিছু কাজ যুক্ত হওয়ায় ভেরিয়েশন অর্ডারের সময় চুক্তি মূল্যের চেয়ে ২০ কোটি ২২ লাখ টাকা বেশি দিতে হয় সরকারকে।
আইএমইডির ২০১৭ সালের জুনে এ প্রকল্পের ওপর দেয়া নিবিড় পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা যায়। তাতে বলা হয়, ‘ব্রডগেজের পরিবর্তে ডুয়েলগেজ রেললাইনের নির্মাণমূল পরিকল্পনায় থাকা উচিত ছিল। কিন্তু দীর্ঘ ৩/৪ বছর পর এ সিদ্ধান্ত (ব্রডগেজের পরিবর্তে ডুয়েলগেজ) গ্রহণ প্রকল্প বাস্তবায়নে অনভিজ্ঞতার শামিল। ফলশ্রুতিতে প্রকল্প বাস্তবায়নকাল অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে এখনও অসম্পূর্ণ রয়েছে, যা বাঞ্ছনীয় নয়।’
আরও পড়ুন >> সারাদেশের রেলপথ হবে ব্রডগেজ : মন্ত্রী
মান নিশ্চিত না করে ২৫ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ
আইএমইডির ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘ঈশ্বরদী-মাঝগ্রাম-পাবনা অংশে প্যাকেজ নম্বর ডব্লিউডি-১, ডব্লিউডি-২ (লট-এ), ডব্লিউডি-৪ (লট-এ), ডব্লিউডি-৫ (লট-এ)-এর মাঠ পর্যায়ের কার্যক্রম শুরু হয় যথাক্রমে ৫ ডিসেম্বর ২০১২, ৩০ জানুয়ারি ২০১৪, ৩০ জানুয়ারি ২০১৪ ও ২০ এপ্রিল ২০১৫ সালে। কিন্তু এ প্রকল্পের সুপারভিশন কনসালটেন্ট মাঠপর্যায়ে ২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে কাজ শুরু করে। এ সময়ে ২৮৭ কোটি ৭৪ লাখ ১ হাজার টাকার বিপরীতে ওই চার প্যাকেজে ২৫ কিলোমিটার মাটির ইমব্যাংকমেন্টসহ রেললাইন নির্মাণ, ৩৪টি মাইনর (ছোট) ব্রিজ, দুটি মেজর (বড়) ব্রিজ এবং চারটি স্টেশন বিল্ডিংসহ অন্যান্য স্থাপনার নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে, যার গুণগত মান নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি।’
তবে আইএমইডির ওই প্রতিবেদন ‘ভিত্তিহীন’ বলে মন্তব্য করেছেন প্রকল্পের পরিচালক আসাদুল হক। তিনি বলেন, ‘আমি জানি না আইএমইডির এটা কোন রিপোর্ট। যদিও আমি নতুন এসেছি। আসলে এটার কোনো ভিত্তি নাই। গুণগত মান বজায় রেখেই সমস্ত কাজ করা হয়েছে।’
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘৩৬টি ব্রিজ ও স্টেশন বিল্ডিংসহ অন্যান্য স্থাপনার জন্য অসংখ্য পাইলিংয়ের কাজ হয়েছে। কিন্তু ওইসব পাইলিংয়ের গভীরতা মাপার জন্য ইন্টেগ্রিটি টেস্ট হয়েছে কিনা, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি এবং রেকর্ডপত্রও পাওয়া যায়নি।’
ইন্টেগ্রিটি টেস্টের মাধ্যমে কাজের পরিমাণ ও গুণগত মান যাচাই করার সুযোগ থাকে।
এসব বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক আসাদুল হক আরও বলেন, ‘আইএমইডির প্রতিবেদনে তো এ ধরনের তথ্য থাকার কথা নয়।’ তার দাবি, ‘এটা হাস্যকর কথা। কনসালটেন্ট যেখানে নাই, বিশেষ করে রেভিনিউ (রাজস্ব) খাত, রোডস অ্যান্ড হাইওয়ে, এলজিইডি – এখানে তো কনসালটেন্ট নাই। তাহলে এ কাজগুলো কি হয় না? আপনি চিন্তা করেন, সে যদি কনসালটেন্ট না হয়, তাহলে সে কি নরমাল ট্রিটমেন্ট পাবে না?’
‘সব প্রকল্পে কনসালটেন্ট নিয়োগের ক্ষেত্রে সেই ধরনের প্রবিশন (বিধান) থাকে না। প্রকল্পটা শুরু হয়েছিল ২০১০ সালে, তখন কনসালটেন্ট ছিল না। কনসালটেন্ট নিয়োগ হয়েছে ২০১৫ সালে। এ লটটা তো তার আগেই শেষ হয়ে গেছে’ - যোগ করেন প্রকল্প পরিচালক।
আরও পড়ুন >> রেলের উন্নয়নে ‘মন নেই’ দাতাদের
তিনি আরও বলেন, ‘আপনি জানেন কিনা, বাংলাদেশ রেলওয়ের যতগুলো প্রকল্প চলছে, সব থেকে কম খরচে এ প্রজেক্ট হচ্ছে। বাংলাদেশে বর্তমানে যেভাবে উন্নয়ন চলছে, সেই ধরনের কথাবার্তা আনাই ভালো।’
খতিয়ে দেখার সুপারিশ ছিল প্রতিবেদনে
প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ঈশ্বরদী-মাঝগ্রাম-পাবনা অংশে প্যাকেজ নম্বর ডব্লিউডি-১, ডব্লিউডি-২ (লট-এ), ডব্লিউডি-৪ (লট-এ), ডব্লিউডি-৫ (লট-এ)-এ মাটির ইমব্যাংকমেন্টসহ রেললাইন নির্মাণ, ৩৪টি মাইনর (ছোট) ব্রিজ, দুটি মেজর (বড়) ব্রিজ এবং চারটি স্টেশন বিল্ডিংসহ অন্যান্য স্থাপনার নির্মাণকাজ সম্পন্ন হওয়ার ক্ষেত্রে গুণগত মান নিশ্চিতের বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য মন্ত্রণালয় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।’
এসব ঘটনায় কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল কিনা, জানতে চাইলে আসাদুল হক বলেন, ‘কেন ব্যবস্থা নেব? আপনি যদি ঠিক থাকেন, কোনো ব্যক্তির কথার ওপর ভিত্তি করে তো ব্যবস্থা নেবেন না।’ কোনো ব্যক্তি নয়, প্রতিবেদনটি দিয়েছিল আইএমইডি। এ ধরনের প্রতিবেদন দেয়ার বৈধতা ও ক্ষমতা সরকারের একমাত্র এ প্রতিষ্ঠানেরই রয়েছে।
তবে ২০১৮ সালের প্রতিবেদনে এসব সমস্যার কথা বলা হয়নি বলে দাবি করেন প্রকল্প পরিচালক আসাদুল হক। তিনি বলেন, ‘সব টেস্ট রিপোর্টই আছে। সব কাগজপত্রও আছে। আপনি জানেন কিনা, আইএমইডির সচিব মহোদয় গত বছরের জুনে এ প্রজেক্ট পরিদর্শনে আসেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে একটা বড় কমিটি ছিল এবং সেই কমিটি রিপোর্টও দিয়েছে। সেটা পজিটিভ ছিল। আপনি এ বিষয়ে আইএমইডিতে যোগাযোগ করতে পারেন।’
প্রতিবেদনের বিষয়ে কথা বলতে চাইলে আইএমইডির ভারপ্রাপ্ত সচিব আবুল মনসুর মো. ফয়েজউল্লাহ জাগো নিউজকে বলেন, ‘না, আমি বলতে পারব না। এটা আমার নলেজে (জানা) নাই। কনসার্ন (সংশ্লিষ্ট) ডিজির সঙ্গে কথা বলেন, ঠিক আছে। ডিজি, ডিজি।’
আরও পড়ুন >> ‘বিল চান না’ ঠিকাদার, তাই অগ্রগতি শূন্য
ফোন ধরেন না রেলওয়ের ডিজি
এ বিষয়ে কথা বলতে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক (ডিজি) কাজী মো. রফিকুল আলমকে ফোন দেয়া হয় গত ১২ এপ্রিল। তিনি ফোন রিসিভ না করে কেটে দেন। এরপর পরিচয় দিয়ে কথা বলার বিষয়বস্তু উল্লেখ করে একটি ক্ষুদে বার্তা (এসএমএস) দেয়া হয় তার মুঠোফোনে। আবারও তাকে ফোন দেয়া হয়। কিন্তু তিনি রিসিভ করেননি, ফিরতি কল কিংবা ক্ষুদে বার্তাও দেননি। ১৫ এপ্রিল আবার ফোন করা হলে এবারও তিনি কেটে দেন।
প্রকল্প পরিচালক আসাদুল হক আরও জানান, প্রকল্পটি চলতি বছরের জুনের মধ্যে শেষ হবে। সরকারি অর্থায়নে এর প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয় ৯৮২ কোটি ৮৬ লাখ ৫৭ হাজার টাকা। ২০১৩ সালে প্রথম সংশোধনীতেই ব্যয় বাড়ানো হয় ৪৫৩ কোটি ১৬ লাখ ১০ হাজার টাকা। প্রায় ৪৬ শতাংশ ব্যয় বাড়ানোর পর প্রকল্পের মোট ব্যয় দাঁড়ায় এক হাজার ৪৩৬ কোটি দুই লাখ ৬৭ হাজার টাকা।
পিডি/এমবিআর/এমএআর/এমএস