‘ঘুষের হাট’ বসেছে গাজীপুর শিক্ষা অফিসে!
গাজীপুর মাধ্যমিক জেলা শিক্ষা অফিসে ঘুষ ছাড়া কোনো কাজই হয় না! বছরের পর বছর ধরে সংশ্লিষ্ট শিক্ষা অফিসার ঘুষ নিচ্ছেন শিক্ষকদের কাছ থেকে। কিন্তু কারও কোনো প্রতিবাদের সুযোগ নেই।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, ঘুষ না দিলে কাজ আটকে দেন শিক্ষা অফিসার রেবেকা সুলতানা। এমনকি কাজ করে দেবেন না বলে হুমকিও দেন। তার ঘুষ বাণিজ্যে সহযোগিতা করেন শিক্ষা কর্মকর্তার অফিস সহকারী জালাল উদ্দীন ও অফিস পিয়ন নুরুল ইসলাম নুরু। গত সোমবার সরেজমিন শিক্ষা অফিসারের কার্যালয় পরিদর্শন এবং ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে ঘুষ বাণিজ্যের সত্যতা পাওয়া যায়।
জাগো নিউজের হয়ে শিক্ষক পরিচয়ে ওই কার্যালয়ে যাওয়া হয়। সেখানে শিক্ষা অফিসের অফিস সহকারী জালাল উদ্দীন ও পিওন নুরুল ইসলাম নুরুর সঙ্গে এমপিওভুক্তির কাজে এসেছি বলে জানালে, তারা ঘুষের বিষয়টি স্পষ্ট জানিয়ে দেন। নুরু বলেন, ‘আপনারা তো দুজন, পাঁচ হাজারে হবে না, অন্তত আট থেকে দশ হাজার রাখবেন।’
অফিস সহকারী জালাল উদ্দীন বলেন, ‘ম্যাডামের (শিক্ষা অফিসার) কাছে যান, ম্যাডাম নিজেই বলবেন। তিনি কাজের ধরন দেখলেই বুঝে যাবেন কোনটার জন্য কত লাগবে। যান, গিয়ে তার সাথে দেখা করেন।’
এরপর শিক্ষা অফিসার রেবেকা সুলতানার কক্ষে তার সামনে উপস্থিত হলে তিনি ঘুষের ইঙ্গিত দেন। খরচ কত লাগবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কাগজপত্র দেন, তারপর দেখি কত লাগবে?’
এর আগে শিক্ষা অফিসে আসা গাজীপুর জেলার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে কথা হয় জাগো নিউজের এই প্রতিবেদকের। নাম প্রকাশ না করে তারা জানান, এখানে টাকা ছাড়া কোনো কাজ হয় না। যতবার কাজ নিয়ে এসেছি টাকা দিতে হয়েছে। প্রতি কাজের জন্য দুই থেকে ১০ হাজার টাকা নেন ম্যাডাম (জেলা শিক্ষা অফিসার)। এটা সবাই জানেন।
‘টাকা না দিলে ফাইল আটকে দেন। বিভিন্ন কাজের জন্য তার ঘুষের রেট নির্ধারিত’- অভিযোগ করেন তারা।
তারা আরও জানান, শিক্ষকদের এমপিও, টাইম স্কেল, নিয়োগ প্রক্রিয়া- ঘুষ ছাড়া এখানে কোনো কাজই হয় না। ঘুষ লেনদেনের পরিমাণ ও ঘুষের প্রস্তাব দিতে তিনি (শিক্ষা অফিসার) ব্যবহার করেন পিওন নুরু ও অফিস সহকারী জালাল উদ্দীনকে। ফাইল আটকে রেখে তাদের দিয়ে ফোন করে কার্যালয়ে ডেকে ঘুষ দাবি করেন। নতুবা ফাইল আটকে থাকবে বলে ভয়-ভীতি দেখান। ঘুষের টাকা সরাসরি গ্রহণ করেন শিক্ষা অফিসার নিজেই।
জানা যায়, রেবেকা সুলতানা গাজীপুরের একাধিক সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২০১০ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি তিনি গাজীপুরে শিক্ষা অফিসার হিসেবে নিয়োগ পান। ২০১৪ সালের ৪ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের শিক্ষা অফিসে বদলি হন। ২০১৫ সালের ৩ ডিসেম্বর আবারও গাজীপুরে ফিরে আসেন এবং বর্তমানে এখানেই আছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গাজীপুর অঞ্চলের এক প্রধান শিক্ষক ক্ষোভ প্রকাশ করে জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক। স্কুলের উন্নয়ন নিয়ে সবসময় চিন্তায় থাকি। কিন্তু তিনি (শিক্ষা অফিসার) আমার অনেক বড় ক্ষতি করেছেন। তিনি আকার-ইঙ্গিতে ঘুষ চাইতেন, পরে বিভিন্ন সময় তাকে খুশি করেছি। তারপরও তিনি আমার স্কুলের নামে উল্টপাল্টা রিপোর্ট দিয়ে স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত করেছেন।
গাজীপুরের আড়াইগঞ্জ আজিম উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য তাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমি যখন তার (শিক্ষা অফিসার) অফিসে যাই, দেখি শিক্ষকরা যে কাজেই আসুক না কেন তিনি খাম ছাড়া কোনো ফাইল জমা রাখেন না। কোনো কোনো শিক্ষকের সঙ্গে প্রচুর দুর্ব্যবহারও করেন। তার এসব কার্যকলাপ দেখার যেন কেউ নেই!’
তিনি বলেন, আমার স্কুলের প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে ২৫ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে। তদন্তে সেটি প্রমাণিত হয়, মামলাও হয়। কিন্তু ওই শিক্ষা অফিসার দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা ঘুষের বিনিময়ে ওই শিক্ষককে এমপিওভুক্তি করেন। আমি এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করি। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি।
গাজীপুর জেলা শিক্ষা অফিসের এক প্রবীণ কর্মচারী জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার ৩৬ বছরের চাকরির জীবনে এমন ঘুষখোর কর্মকর্তা দেখি নাই। চাকরির মেয়াদ আর তিন বছর আছে। এখান থেকে যেতে পারলেই বাচি।’
সাংবাদিক পরিচয়ে পরে শিক্ষা অফিসার রেবেকা সুলতানার মুখোমুখি হলে তিনি ঘুষের বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করেন। বলেন, ‘আপনাদের কাছে কোনো টাকা চাওয়া হয়নি। আমার এখানে তো কোনো টাকা-পয়সার লেনদেন হয় না।’
জালাল উদ্দীন, নুরু ও আপনার সঙ্গে আমাদের কথোপকথনের ভিডিও রেকর্ড আছে। এরপরও তিনি বিষয়টি অস্বীকার করেন। একপর্যায়ে নুরু ও জালাল উদ্দীনকে তার কক্ষে ডেকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তারা ‘স্বীকার না করলেও অস্বীকার করেননি’, চুপ থাকেন।
গাজীপুর জেলা শিক্ষা অফিসে ‘ঘুষ লেনদেনের’ অভিযোগের বিষয়টি বিস্তারিতভাবে জানানো হয় শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনিকে। সব শুনে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিষয়টি আমাদের জানা ছিল না। গাজীপুরের ওই জেলা শিক্ষা অফিসারের বিষয়ে খোঁজ-খবর নেব। ঘুষ গ্রহণের বিষয়ে সত্যতা মিললে তার বিরুদ্ধে দ্রুততার সঙ্গে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
তাৎক্ষণিক বিষয়টি দেখার জন্য সচিবকে নির্দেশ দিয়ে তিনি বলেন, ‘দুর্নীতি করে কেউ পার পাবে না।’
এমএইচএম/এমএআর/এমএস