বিশ্বকে সংসার জেনেছি, তাই আলাদা সংসার অনুভব করিনি
বাবার অনুপ্রেরণায় ডানা মেলেছেন শৈশবেই। উড়ছেন এখনও। সেই যে শিশির ভেজা ঘাসে পা রেখে প্রকৃতির প্রেমে পড়া, সেই প্রেম সিদ্ধ করছেন হয়তো আফ্রিকার কোনো জঙ্গলে অথবা কোনো পর্বতের চূড়ায় মেঘের পরশে।
ভ্রমণই তার নেশা। ভ্রমণ নেশায় বিদেশের পেশা অনেকটাই চাপা পড়া। চাপা পড়েছে সংসার স্বপ্নও। বিশ্বরূপ দেখতে গিয়ে মানুষের রূপ দেখছেন আপন মনে, মানুষের মন খুঁজে ফিরছেন দেশ-দেশান্তরে। প্রকৃতির কোলে নিজেকে সঁপে হয়ে উঠেছেন একজন ভ্রমণপাগল মানুষ।
নাজমুন নাহার। বাংলাদেশের তরুণ পর্যটক। ১২৫টি দেশ ভ্রমণ করে ইতোমধ্যেই রেকর্ড গড়েছেন। জীবনের সব স্বপ্ন দিয়ে ঢেলে সাজিয়েছেন তার বিশ্বভ্রমণের পথ। ইচ্ছা, পৃথিবীর প্রতিটি দেশে পা রাখার।
সম্প্রতি ভ্রমণকথা মেলে ধরেন দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে। তিন পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে শেষটি।
জাগো নিউজ : ২০০০ সালে বিশ্ব ভ্রমণের যাত্রা শুরু করলেন। এর মধ্যে বিশ্বে বেশ কয়েকটি যুদ্ধও হলো। পাসপোর্টে আপনি মুসলিম। এমন পরিচয় নিয়ে কোনো ঝামেলায় পড়তে হয়েছে?
নাজমুন নাহার : না। মুসলমান পরিচয় থাকার কারণে আমাকে কোনো ঝামেলায় পড়তে হয়নি। আসলে লক্ষ্য স্থির থাকলে কোনো সমস্যাই আর বড় হয়ে সামনে আসে না। তবে নিউজিল্যান্ডে যখন গেলাম, তখন আমাকে ইমিগ্রেশনে বেশ জেরা করা হলো বেশ সময় নিয়ে। ইমিগ্রেশন ক্রস করার পর তাদের প্রশ্ন করলাম, তোমরা জেরা করলে কেন? জবাবে বলল, ম্যাডাম আপনার পাসপোর্টে বহু দেশের ভিসা লাগানো। এ কারণেই দ্বিধার জায়গা থেকে জেরা করা।
কারণ, এশিয়া থেকে ইউরোপ, আফ্রিকা থেকে আমেরিকা সব মহাদেশেই যাওয়া। তারা নিছক ভ্রমণকারী কী-না তা নিয়ে সন্দেহে ছিলেন।থাকাটাও স্বাভাবিক। পরে সেখান জ্যেষ্ঠ এক কর্মকর্তা আমাকে সহযোগিতা করেছেন।
আরও পড়ুন>চামড়া ফেটে গেল, চুলগুলো খাড়া হলো, যেন ভিন্ন জগতে আছি
জাগো নিউজ : বিদেশ ভ্রমণে গিয়ে বাংলাদেশের দূতাবাসে যোগাযোগ হয়?
নাজমুন নাহার : দূতাবাসের কোনো সহযোগিতা আমার প্রয়োজন পড়েনি। এককভাবে ভ্রমণ করছি এবং সেটা নিজের দৃঢ় মনোবলের কারণে।তবে ভবিষ্যতে দরকার পড়লে অবশ্যই দূতাবাসের সহায়তা নেব।
সম্প্রতি ১২৫ দেশ ভ্রমণের পর আমাকে দুবাই প্রবাসীরা সংবর্ধনা দিয়েছেন। দুবাইয়ে বহুবার গিয়েছি। সেখানকার বাঙালিরা আমাকে অকৃত্রিম ভালোবাসা দিয়েছেন। বাঙালি স্কুলে ভিজিট করেছি। বাচ্চাদের পেয়ে খুবই ভালো লেগেছে। তারাও আমাকে পেয়ে মজা করেছে। আমাকে দেখে তারাও উৎসাহিত হয়েছে বিশ্ব ভ্রমণে। আবুধাবিতে বাংলাদেশের দূতাবাসে গেলে তাদের পক্ষ থেকে আমাকে শুভেচ্ছা জানানো হয়। লন্ডনেও বাঙালিরা আমাকে অনেক ভালোবাসা দিয়েছেন। শেষবার সেখানকার বাঙালি সাংবাদিকরা আমাকে সংবর্ধনা দিয়েছিলেন।
জাগো নিউজ : এরপর কোন অঞ্চলে যেতে চাইছেন?
নাজমুন নাহার : এবার ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, লাওস হয়ে ভ্রমণ শুরু করতে চাইছি। এটি একটা ম্যাপ করে রেখেছি। পরের ম্যাপ করেছি তুর্কিমেনিস্তান, কাজাকিস্তান, উজবেকিস্তান দিয়ে। শুরু করব সিল্করুট-কারাকান দিয়ে তিব্বত পর্বতমালা হয়ে। আর মধ্য আফ্রিকায় যাব গাবোন হয়ে। এরপর ইরিত্রিয়া দিয়ে শেষ করব।
জাগো নিউজ : ব্যক্তিগত বিষয়ে জানতে চাই। ভ্রমণের জন্য তো প্রচুর টাকার প্রয়োজন পড়ে?
নাজমুন নাহার : কোনো কাজের জন্য টাকা বড় বিষয় না। আপনার ইচ্ছাটাই মুখ্য। কীভাবে কম খরচে ভ্রমণ করা যায়, সেটাই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। অনেকেই আমার মতো কৌশল করেই ভ্রমণ করছেন। অনেক দেশেই কম টাকায় হোটেলের রুম মেলে। ফ্রি থাকার ব্যবস্থাও আছে। জানতে হবে। বাংলাদেশি ৫০০ টাকার রুম ভাড়াতেও থেকেছি।
আমি বেশির ভাগ ভ্রমণই করেছি সড়কপথে। এক দেশ থেকে আরেক দেশে গিয়েছি সড়কপথেই। বিমানপথে সুইডেন থেকে মৌরতানিয়ায় যেতে লাগে ৬০০ ডলার। আমি কম খরচে যাওয়ার জন্য স্টাডি করেছি। সুইডেন থেকে স্পেনের একটি দ্বীপে গিয়েছি মাত্র ২০ ডলারে। সেখান থেকে মৌরতানিয়া গিয়েছি ১২০ ডলারে। আমার যেতে খরচ হলো মাত্র ১৪০ ডলার। আপনার কৌশলই আপনাকে এগিয়ে নেবে।
সুইডেনে আমি চাকরি করে টাকা জমিয়ে রেখেছি, শুধুই ভ্রমণের জন্য। আমি সেখানে রিসার্চ প্রজেক্টে কাজ করে একটি ঘণ্টাও নষ্ট করিনি। যখন শিক্ষার্থী ছিলাম তখন পার্টটাইম চাকরি করে অর্থ জমিয়েছি। আমার কোনো অলঙ্কার নেই। বাড়ি নেই, গাড়ি নেই। কোনো বাজে খরচও করি না। কত কম খরচে বেশি ভ্রমণ করা যায়, সেটিই আমার কৌশল।
জাগো নিউজ : পরিবার থেকে...
নাজমুন নাহার : পরিবার আমার ইচ্ছাকেই বড় করে দেখে। আমি আমার মাকে নিয়ে ১৪টি দেশ ঘুরেছি। সেখানে মায়ের কিছু টাকাও ব্যয় হয়েছে। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত হচ্ছে, মায়ের সঙ্গে ভ্রমণ। আমেরিকা এবং ইউরোপের দেশগুলোতে মাকে নিয়ে ঘুরেছি। আমেরিকার জাদুঘরে চাঁদের মাটি ছুঁয়েছি মাকে নিয়ে। জাহাজে করে ঘুরেছি। মায়ের সঙ্গে সুইজারল্যান্ডে সময়গুলো অসাধারণ কেটেছে। সেখানকার কটেজে মা এবং আমি মেঘ ছুঁয়েছি। মনের আনন্দে মাকে গান গাইতে শুনেছি।
আরও পড়ুন> ১২৫টি ঘুরেছি, ঘুরব বাকি দেশগুলোও
জাগো নিউজ : বাবা আপনার অনুপ্রেরণা। তাকে নিয়ে ভ্রমণ হয়নি?
নাজমুন নাহার : বাবার মৃত্যু হয়েছে ২০১০ সালে। আমি তখন পড়াশোনা শেষ করেছি। সবে চাকরি পেয়েছি। বাবাকে নিয়ে বিদেশ ভ্রমণ হয়নি।
জাগো নিউজ : বাবা কী করতেন?
নাজমুন নাহার : বাবা ব্যবসায়ী ছিলেন। আমরা আট ভাইবোন। সবার ছোট আমি। সবাই বিয়ে করে সংসার করছেন। কেউ কেউ চাকরি করছেন। আমি এখনও বিয়ে করিনি। আমি আমার ভ্রমণ নেশা নিয়ে আছি।
জাগো নিউজ : ভ্রমণ ইচ্ছায় সংসার আড়ালে পড়ে গেল?
নাজমুন নাহার : আড়াল ঠিক না। সংসারেই তো আছি। বিশ্বকে সংসার জেনেছি, তাই আলাদা সংসার অনুভব করিনি। তবে আমি বিয়ে বিরোধীও নই। যদি সব ঠিক রেখে সুযোগ আসে বিয়ে করতেই পারি। বিয়ে না হলেও যে সব হারিয়ে ফেললাম ঠিক তা নয়। সবাইকে একই ধাঁচে জীবনযাপন করতে হবে আমি সে নীতিতে বিশ্বাস করি না। আনন্দটা আসলে কোথায় তা নির্ধারণ করে নেয়াই হচ্ছে মুখ্য। আমি যদি আমার কাজের মধ্যে আনন্দ পাই, তাহলে অন্য কিছুর অভাব নিয়ে মন খারাপ করে থাকব কেন?
পৃথিবীতে অনেক মহৎ মানুষ আছেন যারা সংসারে অনুরাগী ছিলেন না। ইবনে বতুতা তাদেরই একজন। তিনি সংসার পাতেননি। মাদার তেরেসাও বিয়ে করেননি। বিয়ে জীবনের একটি অংশ। কিন্তু এর বাইরেও বহু কাজ, দায়িত্ব, আনন্দ আছে। তবে সময় সমর্থন করলে অবশ্যই বিয়ে করব।
জাগো নিউজ : সেক্ষেত্রে কেমন সঙ্গী প্রত্যাশা করবেন?
নাজমুন নাহার : একজন সহজ মনের মানুষ, যিনি নিজেকে চিনবেন, আমাকে বুঝবেন। তাকেও আমার মতো ভ্রমণ পাগলা হতে হবে এমনটি নয়। স্বপ্ন দেখা, কাজকে সহযোগিতা করবেন এমন সঙ্গী সবারই কাম্য।
জাগো নিউজ : বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ভ্রমণপিপাসুদের জন্য কী বলবেন?
নাজমুন নাহার : সবার আগে ভয়কে জয় করতে হবে। পৃথিবীতে ভয় বলে কিছু নেই। লক্ষ্য স্থির করাই প্রধান কাজ। ভ্রমণ করার ইচ্ছাটাই আসল কথা। কে কী বলল, সেদিকে কান দিলে চলবে না এবং সেটা যে কোনো কাজের বেলাতেই। শিক্ষিত এবং আত্মনির্ভরশীল হতে হবে। শিক্ষা এবং আত্মনির্ভরশীলতা মানুষের স্বাধীনতার দরজা খুলে দেয়। স্বাধীনতা স্বপ্ন জয়ে সহায়ক হয়। দেশের জন্য, মানুষের জন্য কিছু করার প্রত্যয় থাকলেই সে স্বপ্ন পূরণ হয়। সবাই সবাইকে মানবিক জায়গা থেকে চিনতে পারলেই সুন্দর বিশ্ব পাবো, সুন্দর মনের মানুষ পাবো।
এএসএস/এমআরএম/এমএস