ভিডিও EN
  1. Home/
  2. বিশেষ প্রতিবেদন

ভারতের এবারের নির্বাচন হচ্ছে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ

সায়েম সাবু | প্রকাশিত: ০৫:৫৯ পিএম, ২৭ মার্চ ২০১৯

আলতাফ পারভেজ। গবেষণা করছেন দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাস নিয়ে। লিখছেন রাজনীতি, ইতিহাসের নানা প্রসঙ্গে। ভারতের আসন্ন পার্লামেন্ট নির্বাচন নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র। দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে নির্বাচনের সার্বিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন নির্মোহভাবে।

বলেন, বিশ্বের বৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারতে এখন রাজনৈতিকভাবে জাতীয়তাবাদের বিস্তার ঘটছে। এ কারণে গণমানুষের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট ইস্যুগুলো নির্বাচনে চাপা পড়ছে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার যুদ্ধের খবরে। যার পেছনে রয়েছে পুঁজির কর্তৃত্ব।

এ বিশ্লেষকের মতে, কংগ্রেস আঞ্চলিক দলগুলোর সঙ্গে বিশেষ ছাড় দিয়ে জোট গঠন করতে না পারলে নির্বাচনের ফলাফল বিজেপির পক্ষে যাবে। তবে আঞ্চলিক দলগুলোও এবারের নির্বাচনে ভালো করতে পারে বলেও মত দেন। তিন পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে প্রথমটি।

জাগো নিউজ : গবেষণা করছেন দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির ইতিহাস নিয়ে। ভারতের নির্বাচন কীভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন?

আলতাফ পারভেজ : ভারতের এবারের নির্বাচন আমি একটু অন্যভাবে ব্যাখ্যা করতে চাই। মহাভারতের পৌরাণিক কাহিনি রয়েছে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ নিয়ে। কেউ কেউ বলতে চাইছেন, ভারতের এবারের নির্বাচন হচ্ছে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ। ভারতের মিডিয়া এবারের নির্বাচনকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে সংবাদ প্রচার করছে।

মিডিয়া বলতে চাইছে, ভারতের ইতিহাসে এমনকি পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় নির্বাচন হচ্ছে দেশটিতে। হিন্দু মিথলজিতে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধকে সবচেয়ে বড় যুদ্ধ বলে মনে করা হয়। ওই যুদ্ধ হয়েছিল পাণ্ডবদের সঙ্গে কৌরবদের। পাণ্ডবরা ছিলেন ধর্ম-ন্যায়ের প্রতীক। তার উল্টো ছিল কৌরবরা। যুদ্ধে কৃষ্ণ পাণ্ডব ও কৌরবদের জন্য দুটি প্রস্তাব দিলেন। বললেন, একদিকে আমি অন্যদিকে সৈন্যরা। তোমরা বাছাই করে নেবে। তখন পাণ্ডবরা কৃষ্ণকে বেছে নেয়। কিন্তু কৃষ্ণ নিরস্ত্র থাকবেন। কৃষ্ণ কোনো যুদ্ধ করবেন না। সৈন্যরা কৌরবদের পক্ষ নিলেন। যুদ্ধে পাণ্ডবরা জিতে গেল ন্যায়ের বলে।

ভারতে এখন মূল দল বিজেপি ও কংগ্রেস। ক্ষমতাবান পুঁজিপতিদের জন্য প্রস্তাব কার কেমন, সেটাই এখন সেখানে মুখ্য। ভারতের সুশীল সমাজ একটু সহনীয় ধারা পছন্দ করে। তারা কংগ্রেসের প্রতি অনেকটাই সহানুভূতিশীল। তারা নিজেদের প্রস্তাব করছেন কংগ্রেসের জন্য। যেমন- কৃষ্ণ প্রস্তাব রেখেছিলেন পাণ্ডবদের জন্য। ভারতের পুঁজি, সৈন্য-সামন্ত, রসদ চলে যাচ্ছে বিজেপির জন্য। সব মিডিয়া বিজেপিকে সমর্থন দিচ্ছে। সামাজিক মাধ্যমে বিজেপির হাজার হাজার কর্মী প্রচারণা চালাচ্ছেন।

জাগো নিউজ : কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কৃষ্ণপক্ষের পাণ্ডবরা জিতল। এ নির্বাচনে কী ঘটবে?

আলতাফ পারভেজ : ভারতের পুঁজিবাদীরা চাইছে নির্বাচনে বিজেপিই জিতুক। কারণ পুঁজি নিয়ে বিজেপির একধরনের আগ্রাসী মনোভাব আছে এবং তারা একেবারে নির্লজ্জভাবে পুঁজির বিকাশ ঘটাতে চায়।

জাগো নিউজ : পুঁজির ওপর ভর করে কংগ্রেসের রাজনীতিও…

আলতাফ পারভেজ : ঠিক তা-ই। তবে কংগ্রেসের নীতির সঙ্গে বিজেপির ফারাক আছে। কংগ্রেসের সঙ্গে নেহেরুর সেই সমাজতন্ত্রের একটি নীতি আছে। এ কারণে তারা বেপরোয়া হতে পারে না। যেমন- একটি আদিবাসী অঞ্চলে যদি খনি থাকে, তাহলে সেখানে উচ্ছেদ চালাতে কংগ্রেস বিবেচনা করবে। বিজেপি কোনো বিবেচনার তোয়াক্কা করবে না। কংগ্রেস যে একেবারেই আগ্রাসী নয়, তা নয়। তবে বিজেপি কোনো বাছ-বিচার করে না। পুঁজির বিকাশে বিজেপি নির্মমভাবে হলেও সফল।

জাগো নিউজ : কংগ্রেসকে এখন জোটবদ্ধ রাজনীতি করতে হচ্ছে। সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে ‘অধিক বিবেচনার’ জন্য বিলম্ব হচ্ছে- এটিও একটি কারণ হতে পারে…

আলতাফ পারভেজ : হ্যাঁ। কংগ্রেস দীর্ঘদিন ধরে জোটবদ্ধ রাজনীতি করে আসছে। কংগ্রেস অপেক্ষাকৃত দুর্বল হচ্ছে বলে দলটিকে জোটের নির্ভর করতে হচ্ছে। জোটকে গুরুত্ব দিয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়া যায় না। সিদ্ধান্তহীনতা পুঁজিপতিদের পছন্দ নয়। আম্বানিদের যদি ভারতীয় পুঁজির প্রতীক ভাবি, তাহলে তাদের পছন্দের ব্যক্তি হচ্ছেন নরেন্দ্র মোদি। ফলে বিজেপি আরও পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকলে আম্বানিরা খুশি হবেন। ভারতীয় পুঁজির ধর্মটা তো বাইরে থেকেও বোঝা যায়।

জাগো নিউজ : কিন্তু বিজেপির জনপ্রিয়তা ধসের খবরও তো আছে…

আলতাফ পারভেজ : তিন মাস আগের চিত্র আর বর্তমান চিত্রের মধ্যে তফাৎ আছে। তিন মাস আগে নির্বাচন হলে নরেন্দ্র মোদি খারাপ করতেন। বেকারত্ব, দুর্নীতি, গ্রামীণ অর্থনীতির ধস- এ তিন কারণে বিজেপির অবস্থান নাজুক ছিল। কিন্তু এখন আর ওই তিন কারণ আলোচনায় নেই।

এখন ভারতে আলোচনা হচ্ছে ‘পাকিস্তান’। পুরো ভারতের মনোজগৎ দখল করে নিয়েছে পাকিস্তান ইস্যু। বোমা মারা হবে কি-না, বোমা ঠিকমতো পড়ছে কি-না, বোমায় কতজন মরলো- এ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। এতে তিন মাস আগের নির্বাচনী ইস্যু বদলে এখন সম্পূর্ণভাবে পাকিস্তান ইস্যু হয়ে গেছে।

জাগো নিউজ : তার মানে নির্বাচন উপলক্ষে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধপরিস্থিতি আবশ্যক করে তোলা হলো...

আলতাফ পারভেজ : অনুমানের ওপর ভিত্তি করেই বলতে হয় যে, নির্বাচনের এজেন্ডা বদলানোর জন্য এ ‘যুদ্ধপরিস্থিতি’ তৈরি করা। কারণ যুদ্ধ-পরবর্তীতে যে উন্মাদনা দেখলাম, তা স্পষ্টতই পরিকল্পিত এবং আমরা তা-ই দেখলাম। এ উন্মাদনার মধ্য দিয়ে মোদির বিরুদ্ধে বিমান ক্রয় নিয়ে দুর্নীতি, গ্রামীণ অর্থনীতি ভেঙে পড়া, বেকারত্ব, টাকার নোট বাতিলের মতো ইস্যুগুলো চাপা পড়ে গেল। অথচ বিষয়গুলো এক মাস আগেও ব্যাপকভাবে প্রচার হচ্ছিল।

জাগো নিউজ : পাকিস্তান ইস্যুতে মোদি যে এককভাবে ফসল ঘরে তুলতে পারছেন তাও নয়। হামলা-পাল্টা হামলা নিয়ে মোদিকেও তো বিতর্কের মুখোমুখি হতে হচ্ছে…

আলতাফ পারভেজ : ওই বিতর্কও নরেন্দ্র মোদির জন্য লাভজনক। মোদি অথবা বিজেপি ম্যাচটি এভাবেই সাজাতে চাইছেন। বেকারত্ব, দুর্নীতি, গ্রামীণ অর্থনীতি নিয়ে যদি বিতর্ক থাকত তাহলে মোদিকে কঠোরভাবে জবাবদিহি করতে হতো।

বিতর্ক এখন, ‘মোদি বলছেন, আমরা বোমা ফেলেছি। আর কংগ্রেস বলছে, বোমাটি ঠিক জায়গায় ফেলছে কি-না’। যেমন- মমতা ব্যানার্জি বলছেন, বোমাটি ঠিকমতো পড়েনি। এ বিতর্ক মোদিকে তেমন সমস্যায় ফেলছে না।

এর কারণ হচ্ছে, জাতীয়তাবাদ আলোচনা যদি কেন্দ্রীয় আলোচনা হয়, তাহলে সেই আলোচনায় বিজেপির চাইতে আর কেউ বেশি সুবিধা পাবে না। নরেন্দ্র মোদিরা ঐতিহাসিকভাবেই হিন্দু জাতীয়তাবাদকে ধারণ করে রাজনীতি করে আসছেন। মোদি বোঝাতে চাইবেন, ঠিক আছে, এবার যেহেতু বোমাটি ঠিক জায়গায় পড়েনি বলছ, তাহলে আমাকে আরও পাঁচ বছর সময় দাও। পরেরবার ঠিক জায়গায় ফেলে আসব। বিতর্কটা এ জায়গায় থাকাই তাদের বড় নির্বাচনী লাভ।

মোদিরা হিন্দুত্ববাদী, মুসলিমবিরোধী, মন্দিরের রাজনীতি করেন। জাতীয়তাবাদী এজেন্ডা গুরুত্ব পেলে দিন শেষে মোদিরাই লাভের পক্ষে থাকেন। রাহুল গান্ধী, মমতারা তো জাতীয়তাবাদ নিয়ে মোদির চাইতে বেশি বলতে পারবেন না।

ভারতে শ্রেণি বিভাজন করে দেখলে দেখতে পাবেন, নিচুতলার মানুষ হচ্ছেন দলিতরা এবং মুসলমানরা। বিতর্কটা যদি হয় বোমা বা মিসাইল নিয়ে, তাহলে ওই দুই সম্প্রদায়ের আর কিছু চাওয়া-পাওয়ার থাকে! ভোট দেয়া ছাড়া তাদের আসলে কিছুই করার নেই। ভারতের নির্বাচনী প্রচারণায় ওই দুই সম্প্রদায়ের মানুষ সম্পূর্ণ অসহায়। দলিত ও মুসলিম সম্প্রদায়ের এজেন্ডা না রাখতে সব ব্যবস্থা করেছেন নরেন্দ্র মোদি।

আরেকটি সংকীর্ণ বিষয় সামনে এসেছে এবার। সাত দফায় এবার সেখানে নির্বাচন হবে। অথচ রমজান মাসে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে মুসলিমপ্রধান এলাকাগুলোতে। এটি এখন নির্বাচনী এজেন্ডা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে না। অথচ কুম্ভমেলায় কি সেখানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতো? একজন মুসলমান প্রশ্ন তুলতেই পারেন, রমজান মাসে আমরা ভোট দিতে যাব কেন? আমাদের সিডিউল অন্য সময়ে করো। সেই প্রশ্ন কিন্তু মুসলমানরা তুলছেন না।

জাগো নিউজ : সম্প্রতি পাঁচটি রাজ্যসভার নির্বাচনে ধরাশায়ী বিজেপি। সেখানে জাতীয় নির্বাচনের ইঙ্গিতও মিলেছে- এমনটি অনেকে মনে করছেন। এর কী কোনোই প্রভাব পড়বে না?

আলতাফ পারভেজ : বলতে পারেন, ওই পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনী ফলাফলই এ যুদ্ধাবস্থা তৈরি করেছে। মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, ছত্তিশগড় বিজেপির কড়া সমর্থক গোষ্ঠী রয়েছে। ওই তিন রাজ্যে লোকসভার আসন সংখ্যা ৬৫টি। ভারতের লোকসভার মোট আসন হচ্ছে ৫৪৩টি। ওই তিন রাজ্যে লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি পেয়েছিল ৬২টি আসন। সম্প্রতি রাজ্যসভার নির্বাচনে কংগ্রেস জিতেছিল বড় ব্যবধানে। যেখান থেকে বিজেপি বড় ধরনের বার্তা পেয়েছিল।

এ কারণেই আমি মনে করছি, পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ এবং যুদ্ধপরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ স্থানীয় ওই নির্বাচন থেকেই সৃষ্টি। অন্তত আমি এর মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক দেখি-ই। বিজেপি দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে এবং ছক সেভাবেই এঁকেছে। বিরোধী দলগুলো বিজেপির সেই পরিকল্পনা বুঝতেই পারেনি।

জাগো নিউজ : বিজেপির ওই পরিকল্পনার নির্ধারক কে হতে পারেন?

আলতাফ পারভেজ : এবারের নির্বাচন বিজেপি বা মোদি বনাম অন্যরা নয়। নির্বাচন হচ্ছে বিজেপিপ্রধান অমিত শাহ বনাম অন্যরা। বিজেপির মাস্টার প্লান অমিত শাহ-ই করছেন। মোদি থেকে অমিত শাহ ১৩ বছরের ছোট। কিন্তু নিজের চাইতেও মোদি এখন অমিত শাহের ওপর বেশি নির্ভর করেন। পুরো নির্বাচনটাই বিজেপির হয়ে সাজিয়েছেন অমিত শাহ।

গত লোকসভা নির্বাচনের পর বিধানসভার নির্বাচনে যে অকল্পনীয় সাফল্য বিজেপি পেয়েছে, তার পেছনের কলকাঠি নেড়েছেন অমিত শাহ। এ কারণে লড়াইটা হচ্ছে অমিত শাহ বনাম অন্যরা।

এএসএস/এমআরএম/এমএআর/পিআর

আরও পড়ুন