ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রদলের অর্জন ‘ক্যাম্পাসে ফেরা’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়ার ব্যাপারে ছাত্রদলের মধ্যে মতবিরোধ থাকলেও শেষ পর্যন্ত প্যানেল ঘোষণা করে ছাত্রদল। নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ তুললেও তাদের প্রার্থীদের শোচনীয় পরাজয়ে বাকরুদ্ধ সংগঠনটির অনেক নেতা। দীর্ঘ ১০ বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের ফেরাকে অর্জন হিসেবে দেখছেন কেউ কেউ।
ডাকসুর ২৫টি পদের একটিতেও জয় পায়নি। এমনকি প্রার্থীদের মধ্যে সম্পাদকীয় একটি পদ ছাড়া কেউ হাজারের ওপরে ভোট পাননি। ১২টি সম্পাদকীয় পদের মাত্র একটিতে ছাত্রদলের প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আসতে পেরেছেন। কমনরুম ও ক্যাফেটেরিয়া বিষয়ক সম্পাদক পদে প্রার্থী কানেতা ইয়া লাম-লাম ৭ হাজার ১১৯ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় হন।
ভিপি পদে এই সংগঠনের প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান ২৪৫ ভোট পেয়ে পঞ্চম হন। জিএস প্রার্থী আনিসুর রহমান খন্দকার ৪৬২ ভোট পেয়ে ষষ্ঠ হন। আর এজিএস প্রার্থী খোরশেদ আলম সোহেল পান মাত্র ২৯৪ ভোট। এ ছাড়া ১৮টি হল সংসদের কোনো পদেও ছাত্রদল জয় পায়নি। প্রতিদ্বন্দ্বিতায়ও ছিল না। হল সংসদগুলোতে ২৩৪টি পদের বিপরীতে ছাত্রদলের প্রার্থী ছিল মাত্র ৫৪ জন।
ছাত্রদলের একজন শীর্ষ নেতা জাগো নিউজকে বলেন, সংগঠনের অনেক নেতাকর্মী ডাকসু নির্বাচনে যাওয়ার বিপক্ষে ছিলেন। নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য একটা সিন্ডিকেট বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে ভুল বুঝিয়ে ডাকসুতে অংশগ্রহণে রাজি করায়। ডাকসু নির্বাচন নিয়ে ছাত্রদলের দ্বিতীয় বৈঠকে বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে সিনিয়র নেতাদের সামনেই একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা ডাকসু নির্বাচনের পক্ষে মত দিলে বাকিরা নেতারা তাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করতে উদ্যত হয়। ডাকসু নির্বাচনে অংশ না নেয়ার কারণ হিসেবে নেতাকর্মীদের বক্তব্য ছিল-ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্যানেল দেয়ার মত সেই রকম প্রাথী নেই। সি গ্রেড ছাত্রনেতাদের প্রার্থী করা হয়েছে। জগন্নাথ হল এবং মেয়েদের হলগুলোতে ছাত্রদল নেই বললেই চলে।’
তিনি বলেন, সাবির্ক কারণে অনেকের মত ছিল নির্বাচনে না গিয়ে সংগঠন গোছানোর পক্ষে। ডাকসু নির্বাচনের মাধ্যমে একটা অর্জন হয়েছে যে ছাত্রদলের প্রকৃত করুণ চিত্র স্পষ্ট হয়েছে। সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে ছাত্রদলের যে আবেদন নেই সেটিই ফুটে উঠেছে।
ছাত্রদলের সহ সভাপতি নাজমুল হাসান তার ফেসবুকে ওয়ালে লিখেছেন, ‘ডাকসু নির্বাচনে অনন্ত একটা লাভ হয়েছে। রাজনীতি এবং রাজনীতির বাইরে বিশাল একটা উপদেশ দেয়ার গ্রুপ তৈরি হয়েছে। যারা সংগঠন, বাস্তবতা ও বিদ্যমান পরিস্থিতি অনুধাবন না করে একের পর এক উপদেশ দিয়ে যাচ্ছেন।’
ডাকসু নির্বাচনের মাধ্যমে ছাত্রদলের অর্জন প্রশ্নে কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বায়েজিদ আরেফিন বলেন, ‘এর মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং ভবিষ্যত রাষ্ট্রনায়ক তারেক রহমানকে নিয়ে দীর্ঘ ১০ বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্লোগান হয়েছে। পাশাপাশি আওয়ামী লীগের আমলে যেকোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হয় না সেটাই প্রমাণ হয়েছে।’
ছাত্রদলের দফতর সম্পাদক আব্দুস সাত্তার পাটোয়ারীর মতে, যদিও ডাকসু নির্বাচন ব্যাপকভাবে কলঙ্কিত হয়েছে সেখানে কোনো ভোট দিতে দেয়া হয়নি। ছাত্ররা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি। দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাঙ্গনের ভোট ছিনতাই করা হয়েছে। তবু সেখানে ছাত্রদলের কিছু অর্জন অবশ্যই আছে। এই নির্বাচনের মাধ্যমে আমরা অনেকদিন পর ক্যাম্পাসে নিজেদের অবস্থান জানান দিতে পেরেছি। তার থেকেও বড় কথা জাতীয় নির্বাচনের প্রহসনের পর আমরা জাতির সামনে আবার তুলে ধরতে পেরেছি বর্তমান সরকার এবং তার অঙ্গসংগঠন ছাত্রলীগের ভোট ডাকাতি এবং জোরজবরদস্তির নমুনা। দেশের সাধারণ জনগণের মতো প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাও ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীদের কাছে কতটা অসহায় সেটা দেশবাসী প্রত্যক্ষ করতে পেরেছে। এটি আমরা আমাদের বিশাল অর্জন বলে মনে করি।
ডাকসু নির্বাচন নিয়ে ছাত্রদলের অর্জন প্রশ্নে বিএনপির প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক এবিএম মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘দীর্ঘ ১০ বছর জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ক্যাম্পাসে যেতে পারছে না। সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারছে না এবং ছাত্রদলের কর্মী সমর্থক ও নেতাদের হলে থাকতে দেয়া হচ্ছে না। এমন একটি অবস্থায় ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রদলের আগমনকে আমরা ইতিবাচক হিসেবে দেখতে চাই। যেখানে সমতল মাঠ ছিল না বা সবার সমান সুযোগ ছিল না। শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় সরকারি দলের জেতানোর জন্য জন্য কর্তৃপক্ষ সব আয়োজন করেছে। সেখানে ছাত্রদলকে সুযোগ না দেয়াটাই স্বাভাবিক ছিল।’
একই প্রশ্নে ডাকসুর সাবেক জিএস বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন বলেন, ‘২৮ বছর পর ডাকসুর যে নির্বাচন হলো তা কাঙ্ক্ষিত হয়নি। একটা কলঙ্কিত নির্বাচন হয়েছে। গত দশ বছর ধরে ছাত্রদলকে ছাত্রলীগ ক্যাম্পাসে যেতে দেয়নি। এ নির্বাচনকে ঘিরে ছাত্রদল ক্যাম্পাসে গিয়েছে এটাই ছাত্রদলের অর্জন হিসেবে ধরা যায়।
তিনি বলেন, নির্বাচন নিয়ে যে অনিয়ম হয়েছে আমরা বিচারভিাগীয় তদন্তের দাবি জানাই এবং পুনরায় তফসিল ঘোষণার মাধ্যমে ৩১ মার্চের মধ্যে যে নির্বাচনের দাবি উঠেছে আমরা সেটা সমর্থন করি। ’
ডাকসু নির্বাচনের মাধ্যমে ছাত্রদলের সাংগঠনিক দুর্বলতা ফুটে উঠছে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘কিছুটা তো রয়েছে। কারণ স্বাভাবিকভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করা যায়নি। ছাত্রদল ১০ বছর ক্যাম্পাসে যেতে পারেনি। ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের নেতারা ছাত্রদল নেতাদের পিটিয়ে বের করে দেয়। সে ক্ষেত্রে কার্যক্রম তো ব্যাহত হয়েছে।’
ডাকসু নির্বাচনকে ঘিরে ছাত্রদল ক্যাম্পাসে সরব পরিস্থিতি অব্যাহত থাকবে নাকি, শঙ্কা আছে জানতে চাইলে খোকন বলেন, ‘কতটুকু তারা কন্টিনিউ করতে পারবে এটা বলা মুশকিল, আমরা তো চাই তাদের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড হোক, সেখানে ছাত্রদলীগ বাধা দিলে সেটা জাতি দেখবে। ছাত্রসমাজ প্রতিহত করবে।
কেএইচ/জেএইচ/এমএস