ভিডিও EN
  1. Home/
  2. বিশেষ প্রতিবেদন

আলুর উৎপাদন বাড়ছে, কমছে রফতানি

মাসুদ রানা | প্রকাশিত: ১১:০৯ এএম, ০৯ মার্চ ২০১৯

 

> ৪০টি উন্নত দেশের অন্যতম প্রধান খাদ্য আলু
> আলু রফতানির মূল সমস্যা জাতের অভাব
> বিশ্বে পাকিস্তানের আলুর চাহিদা ব্যাপক
> দেশে আলু হয় ১২০ দিনে, বিদেশে ছয় মাসে

বাংলাদেশে প্রতি বছর বাড়ছে আলুর উৎপাদন। কিন্তু আলু রফতানি বাড়ার পরিবর্তে ক্রমেই তা কমছে। মানসম্মত জাতের অভাব, আলুর রোগ, পর্যাপ্ত অ্যাক্রেডিটেড ল্যাবরেটরি না থাকাসহ বিভিন্ন সমস্যার কারণে আলু রফতানি দিনদিন কমছে।

অন্যদিকে, চাহিদার চেয়ে বেশি উৎপাদন, সংরক্ষণাগারের অভাব ও অতিরিক্ত রফতানি না হওয়ায় ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন কৃষক। তাই আলুর বাম্পার ফলন আশীর্বাদ না হয়ে তা কৃষকদের কাছে অভিশাপ হিসেবে দেখা দিয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশের দুটি বড় বাজার রাশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় ২০১৫ সাল থেকে আলু রফতানি বন্ধ। কৃষি মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, রফতানি বাড়ানো ও আলুতে কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে সরকার আন্তরিক এবং এ বিষয়ে সরকার কাজ শুরু করেছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের আরেক কর্মকর্তা জানান, আলু একটি জনপ্রিয় কন্দাল জাতীয় ফসল। অনুকূল আবহাওয়া ও রাসায়নিক সার পর্যাপ্ত থাকায় প্রতি বছর আলুর উৎপাদন বাড়ছে। প্রায় ৩০টি জাতের আলুর চাষ হচ্ছে বাংলাদেশে। ধান ও গমের পর বিশ্বে আলু একটি গুরুত্বপূর্ণ ও নেতৃস্থানীয় প্রধান ফসল। আলু বিশ্বের ৪০টি উন্নত দেশের অন্যতম প্রধান খাদ্য হিসেবে পরিচিত।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে আলুর বার্ষিক চাহিদা প্রায় ৭০ লাখ টনের মতো। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে আলুর উৎপাদন এক কোটি টনেরও বেশি। চলতি বছর চাষ করা আলু এখন পর্যন্ত ৬০ শতাংশ উত্তোলন করা হয়েছে, ধারণা করা হচ্ছে এ বছরও উৎপাদন এক কোটি টন ছাড়িয়ে যাবে।

ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) এর তথ্য অনুযায়ী, এখন বাজারে প্রতি কেজি আলু বিক্রি হচ্ছে ১৫-২০ টাকায়।

কৃষি বিপণন অধিদফতর থেকে জানা গেছে, দেশে ৩৬৩টি আলু সংরক্ষণাগারের ধারণক্ষমতা ৩০ লাখ টনের মতো। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে চার লাখ ৭৬ হাজার হেক্টর জমিতে ৯৪ লাখ ৫৪ হাজার টন আলু উৎপাদিত হয়েছে। পরের বছর চার লাখ ৯৬ হাজার হেক্টর জমিতে আলু চাষ হয়, উৎপাদিত আলুর পরিমাণ এক কোটি তিন লাখ টন। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে পাঁচ লাখ ২৮ হাজার হেক্টর জমিতে আলু উৎপাদিত হয় এক কোটি ১৩ লাখ ৩৩ হাজার টন। তবে গত বছর আলুর উৎপাদন কিছুটা কমে দাঁড়ায় এক কোটি ৩ লাখ টনে।

২০১৩-১৪ অর্থবছরে আলু রফতানি হয় এক লাখ দুই হাজার ৯৮৩ টন। এটাই সর্বোচ্চ রফতানি। পরের বছর রফতানি কমে হয় ৯৪ হাজার ৬১৩ টন। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৪০ হাজার ২২৯ টন আলু রফতানি হয়। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে আলু রফতানি হয় ৫৫ হাজার ৬৫২ টন। সর্বশেষ গত অর্থবছরে ৫২ হাজার টন আলু রফতানি হয় বলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর থেকে জানা গেছে।

বাংলাদেশ আলু রফতানিকারক সমিতির (বিপিইএ) সভাপতি শেখ আব্দুল কাদের জাগো নিউজকে বলেন, ‘আলু রফতানির ক্ষেত্রে আমাদের মূল সমস্যা হচ্ছে জাতের অভাব। প্রোডাক্ট ছাড়া তো ব্যবসা হয় না। আমাদের এক্সপোর্টেবল ভ্যারাইটি নেই। আমাদের অ্যাক্রেডিটেড ল্যাবরেটরির অভাব রয়েছে। আমরা দীর্ঘদিন ধরে এ সমস্যার কথা বলে আসছি। কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি, তবে বর্তমানে কিছু উদ্যোগ দেখতে পাচ্ছি। রাশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় আলু রফতানি খুলে দেয়ার জন্যও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা কাজ করছেন।’

নাম প্রকাশ না করে এক আলু রফতানিকারক জানান, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটকে অধিক পরিমাণে ড্রাইমেটার (শুকনো অংশ) সমৃদ্ধ আলুর জাত উদ্ভাবন করা দরকার। এখন শুধু গ্রানুলার জাতটি রফতানি হচ্ছে। কিন্তু ক্রমান্বয়ে বহির্বিশ্বে এর চাহিদা কমে যাচ্ছে। পাকিস্তানের শান্তি জাতের আলুর মান অত্যন্ত ভালো হওয়ায় বিভিন্ন দেশে এর চাহিদা ব্যাপক।

আমাদের দেশে এখনও আলুভিত্তিক কোনো প্রতিষ্ঠিত শিল্প গড়ে ওঠেনি। কোল্ড স্টোরেজ মালিকরা ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি আলু রাখেন, এতে আলু পঁচে যায়। কোল্ড স্টোরেজে রাখা আলু রফতানি করলে ঝুঁকি থেকে যায়। কারণ এতে আলুর কার্বোহাইড্রেড ভেঙে সুগারে পরিণত হয়, ফলে মিষ্টি আলু আর রফতানি করা যায় না বলেও জানান আরেক রফতানিকারক।

আলুর ‘ব্ল্যাক হার্ট’ এবং ‘হলো হার্ট’ রোগের কারণে রফতানিতে সমস্যা হয়। এখন কৃষিপণ্য রফতানির ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ নগদ সহায়তা দেয়া হচ্ছে। নগদ সহায়তার পরিমাণ বাড়ানোরও দাবি জানিয়েছেন আলু রফতানিকারকরা।

এ বিষয়ে কৃষি সচিব মো. নাসিরুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা অ্যাক্রেডিটেড ল্যাবরেটরি তৈরি করার উদ্যোগ নিয়েছি। আশা করি, এতে রাশিয়া-ইন্দোনেশিয়াতে আলু রফতানির দুয়ার আবার খুলে যাবে।’

তিনি বলেন, ‘বিদেশে আলু হয় ছয় মাসে, আমরা আলুটা করি ১২০ দিনের মধ্যে। ড্রাইমেটারটা হলো বড় একটি বিষয়।’

‘অতিরিক্ত উৎপাদন হওয়ায় কৃষকরা আলুর ন্যায্যমূল্য পান না। আলুটা রফতানি করতে পারলে এটা হতো না। আমরা কৃষককে আলুর পরিবর্তে অন্য লাভজনক ফসল উৎপাদনে উদ্বুদ্ধ করছি। রফতানি বাড়ানোর বিষয়গুলো নিয়েও আমরা চিন্তা করছি। তবে রফতানির বিষয়টি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ারাধীন।’

রফতানির ক্ষেত্রে আলুর ড্রাইমেটার ২৪ শতাংশ বা এর বেশি হতে হয় জানিয়ে সচিব বলেন, ‘আমাদের আলুর ড্রাইমেটার ২০ শতাংশের মধ্যে থাকে। সম্প্রতি আমরা আন্তর্জাতিক আলু কেন্দ্রের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মিটিং করেছি। তারা বলেছেন, ৯০ দিনে ফলানো সম্ভব এমন একটি আলুর জাত আছে যেটা রফতানি যোগ্য, যেটার ড্রাইমেটার ২৪ শতাংশ। এটা তারা আমাদের দেবেন।’

তবে কৃষি মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘আলু উৎপাদনকারীরা যদি কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ে (কৃষকদের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে ফসল ফলানো) না যায় তবে আলু রফতানির ক্ষেত্রে এ অবস্থার উন্নতি হয়তো হবে না। রফতানিকারকরা মনে করেন, তারা কারওয়ানবাজার থেকে আলু কিনবেন আর বিদেশে পাঠাবেন। কোয়ালিটি নিশ্চিত করতে না পারলে রফতানি ধরে রাখা সম্ভব হবে না। কোয়ালিটি আলু নিশ্চিত করতে হলে কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ে যেতেই হবে।’

আলু রফতানিকারকরা জানান, ইন্দোনেশিয়ার কৃষি মন্ত্রণালয় ২০১৫ সালে সেই দেশের ফ্রেস ফুড প্ল্যান্ট অরিজিন (এফএফপিও)’ আমদানি নিয়ন্ত্রণে কতিপয় বিধি-নিষেধ আরোপ করে। এজন্য ইন্দোনেশিয়ার কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে ফুড সেফটি পরীক্ষার জন্য বাংলাদেশের কৃষি মন্ত্রণালয়কে ল্যাবরেটরি রেজিস্ট্রেশনের আবেদন দাখিলের পরামর্শ দেয়া হয়। সেই আবেদন এখনও পাঠানো হয়নি।

জানা গেছে, ইন্দোনেশিয়ায় আলু রফতানির প্রতিবন্ধকতা দূর করার জন্য প্রেস্টিসাইড রেসিডিউস, হেভি মেটাল, মাইকোটক্সিন ও মাইক্রোবায়োলজিক্যাল কন্টামিন্যান্টস পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকতে হবে। এ চারটি পরীক্ষার মধ্যে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের ল্যাবরেটরিতে প্রেস্টিসাইড রেসিডিউস ও বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের ল্যাবরেটরিতে হেভি মেটাল পরীক্ষার ব্যবস্থা আছে। আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাবে অন্য দুটি পরীক্ষার ব্যবস্থা আমাদের দেশে নেই।

অন্যদিকে, ২০১৫ সালের ৬ মে থেকে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার (ব্রাউন ড্রাউট) অস্তিত্ব পাওয়ায় বাংলাদেশ থেকে আলু আমদানিতে সাময়িকভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে রাশিয়া। সেই নিষেধাজ্ঞা এখনও উঠানো সম্ভব হয়নি।

কৃষি বিপণন অধিদফতরের সুপারিশ

আলুর ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত ও রফতানি বাড়াতে এর আগে কৃষি বিপণন অধিদফতর মন্ত্রণালয়ের কাছে কিছু পদক্ষেপ নিতে সুপারিশ করেছিল। সেগুলোও বাস্তবায়ন হয়নি।

সুপারিশগুলোর মধ্যে ছিল- আলু উৎপাদন হয় এমন এলাকায় ব্যাপকভাবে হিমাগারের সংখ্যা বাড়ানো, সরকারিভাবে কৃষকদের কাছ থেকে আলু কিনে রাখা ও পরবর্তী সময় ভর্তুকি দিয়ে বিক্রি করা, আলু রফতানির সম্ভাবনার দিকটি আরও সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয়া।

এছাড়া ভিজিডি, ভিজিএফ, কাবিখার মতো উন্নয়ন কর্মসূচিতে আলু বিতরণ; আলু উৎপাদন হয় এমন এলাকায় ব্যাপকহারে গৃহপর্যায়ে বসতবাড়িতে স্বল্পব্যয়ে আলু সংরক্ষণাগার নির্মাণ; বেসরকারি পর্যায়ে আলু প্রক্রিয়াজাতের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে সরকারি সহায়তা বৃদ্ধি; নতুন বৈশিষ্ট্য সম্বলিত উচ্চ ফলনশীল আলুর জাত উদ্ভাবন; উৎপাদন খরচের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আলুর ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণেরও সুপারিশ করেছিল কৃষি বিপণন অধিদফতর।

আরএমএম/জেএইচ/এমএআর/এমএস

আরও পড়ুন