আমার মাইয়ার কবরের চিহ্নটা কি থাকব?
বৃহস্পতিবার, বিকেল সোয়া ৫টা। আজিমপুর পুরাতন কবরস্থানের মাঝামাঝি নতুন পল্টন লাইন সংলগ্ন পশ্চিম পাশের রাস্তার বাউন্ডারি দেয়ালের কয়েক ফুট দূরে ইট-পাথরের স্তূপের সামনে নিচু হয়ে বসে আছেন মধ্যবয়সী এক ভদ্র মহিলা। পাগলের মতো দু’হাতে ইট ও মাটি সরিয়ে একপাশে রাখছিলেন।
পাশেই গোলাপজলের দুটি বোতল হাতে নিথর হয়ে বসে আছেন তার স্বামী। কয়েক ডজন ইট সরিয়ে একটি ভাঙা কবর খুঁজে পেয়ে পরম মমতায় দু’হাত দিয়ে বুলাতে লাগলেন। তার দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। এ সময় স্বামীকে গোলাপ জলের কৌটার মুখ খুলে কবরে তা ছিটাতে দেখা যায়।
ভদ্র মহিলা কান্নাজড়িত কন্ঠে তার স্বামীর কাছে জানতে চাইলেন, ‘দেখ, কত কবর বিলীন হইয়া গেছে, আমার মাইয়ার কবরের চিহ্নটা কি থাকব?’
এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে লালবাগের আতশখানা লেনের বাসিন্দা রনি ও পারভীন দম্পতি জানান, দেড় বছর আগে তাদের কলেজপড়ুয়া মেয়ে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। ওই সময় রনি চাকরি সূত্রে সৌদি আরবে অবস্থান করছিলেন। মেয়েকে শেষবারের মতো দেখতেও পারেননি। সম্প্রতি দেশে ফিরেছেন তিনি।
‘আজ মেয়ের কবর জিয়ারত করতে এসে তা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। স্ত্রী যেখানে কবরটি দেখাচ্ছিলেন সেখানে ইটের স্তূপ ও মাটির ঢিবি। পরে ইট সরিয়ে সাইনবোর্ড দেখতে পান। কবর জিয়ারত করে চলে যাওয়ার সময় আবার এ প্রতিবেদকের কাছে জানতে চান, মেয়ের কবরটা থাকবে নাকি রাস্তায় বিলীন হয়ে যাবে?’
স্বজনের কবর থাকবে কিনা- এ প্রশ্ন শুধু এ দম্পতির নয়। আজিমপুর কবরস্থানের পশ্চিম পাশের সীমানা প্রাচীর সংলগ্ন স্থানে যাদের স্বজনের কবর রয়েছে তাদের সবার।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) আওতাধীন শত বছরের পুরনো এ কবরস্থানে গত কয়েক মাস ধরে সংস্কার কাজ চলছে। এরই অংশ হিসেবে বিজিবি তিন নম্বর গেট সংলগ্ন আজিমপুর নতুন পল্টন লাইনের রাস্তা সম্প্রসারণের সুবিধার্থে অর্থাৎ মানুষ ও যানচলাচলের সুবিধার জন্য কবরস্থানের ভেতরকার বেশকিছু জায়গা নিয়ে প্রশস্ত রাস্তা তৈরির কাজ চলছে। এ কারণে ইতোমধ্যে সীমানা প্রাচীর সংলগ্ন কমপক্ষে চার সারির শত শত কবর নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
বৃহস্পতিবার সরেজমিন কবরস্থান ঘুরে দেখা গেছে, সর্বত্র সংস্কারের কাজ চলছে। কবরস্থানের ভেতরে পানি নিষ্কাসনের সুবিধার জন্য আগের রাস্তা খুঁড়ে মোটা ড্রেনেজ ও তার ওপরে স্ল্যাব ফেলে সুন্দর রাস্তা নির্মাণ করা হচ্ছে। উত্তর দিকে বিজিবির তিন নম্বর গেট থেকে দক্ষিণ দিকে নতুন করে রাস্তা নির্মাণের কাজ দ্রুতগতিতে চলছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ঠিকাদারের ম্যানেজার জানান, ছয় ফুট গভীর করে মজবুত দেয়াল নির্মাণ করা হবে। ইতোমধ্যে রড-সিমেন্ট দিয়ে ফাউন্ডেশনের কাজ হয়ে গেছে। তিনি আরও জানান, রাস্তা প্রশস্ত করতে গিয়ে কমপক্ষে চার সারির কবর বিলীন হয়েছে।
রাস্তা প্রশস্ত করার খবরে লালবাগ, হাজারিবাগ ও কামরাঙ্গীরচর থানার হাজার হাজার বাসিন্দা খুশী। নতুন পল্টন লাইন এলাকার রাস্তাটি এ তিন থানার বিভিন্ন এলাকার মানুষের নিত্যদিনের চলাচল। কিন্তু রাস্তা সরু হওয়ায় দিনভর যানজট লেগে থাকে। রাস্তাটি প্রশস্ত করার উদ্যোগ নেয়ায় এলাকাবাসি বেশ খুশী।
তারা জানান, ইতোপূর্বে আরও একবার রাস্তাটি প্রশস্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল। কিছুটা প্রশস্তও করা হয়েছিল। কিন্তু জনৈক ব্যক্তি আদালতে এ মর্মে মামলা করেন যে, তার বাবা-মায়ের কবর ভেঙে রাস্তা করা হচ্ছে। আদালত থেকে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হলে সেই উদ্যোগ ভেস্তে যায়।
কবরস্থানের কর্মচারী ও স্থানীয়রা জানান, যে চার সারির কবর ভাঙা পড়েছে সেগুলো ১৫ থেকে ২০ বছরের পুরনো। তবে ভাঙা পড়া কবরের স্বজনরা বলছেন, দুই থেকে চার বছরের আগের কবরও ভাঙা পড়েছে।
এমইউ/এমএআর/পিআর