সফলতার জন্য পরিবারের সমর্থন বেশি প্রয়োজন
দু’চোখে স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হওয়ার। বাবার স্বপ্নটাই নিজের চোখে দেখছিলেন তিনি! এইচএসসি পরীক্ষার পর সে পথ পেরোনোর প্রস্তুতিও চলছিল বেশ জোরেসোরেই। কিন্তু হঠাৎই মোড় পরিবর্তন! সেই পরিবর্তনটাও বাবার সিদ্ধান্তে।
ডিআইজি প্রিজন বাবার দুর্বলতা ছিল সেনাবাহিনীর প্রতি। দেশ স্বাধীনের আগে নিজেও পাকিস্তান আর্মিতে সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ ঘনিয়ে এলে ‘বাঙালি হওয়ার অপরাধে’ সেই সুযোগ মো. আমিনুল ইসলামকে দেয়নি তৎকালীন পাক সরকার। তবে স্বাধীন দেশে নিজ যোগ্যতায় ডিআইজি প্রিজন হয়ে অবসরে যান তিনি।
নিজের সেই অপ্রাপ্তিবোধ হয়তো পূরণ করতে চেয়েছিলেন মেয়েকে দিয়ে। যখন দেখলেন সেনাবাহিনীতে নারী অফিসার নিয়োগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার, তখন ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখানো মেয়েকে একটু ‘চেষ্টা’ করতে বললেন শুধু। নিজেই পূরণ করে দেন ভর্তির আবেদনও।শুরুটা এভাবেই।
পাকিস্তান আমলে বাবা বঞ্চনার শিকার হলেও আফরীনকে বঞ্চিত করেনি বাংলাদেশ। তিনি এখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে প্রথম নারী লেফটেন্যান্ট কর্নেলদের একজন। লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফারহানা আফরীন। নারী হিসেবে দ্বিতীয় ব্যাচে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন তিনি।
নারী দিবস উপলক্ষে সফল এ নারীর মুখোমুখি হয়েছিল জাগো নিউজ। আলাপে উঠে আসে তার সফল উত্থানের পেছনের কথা। যেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে এসেছেন সেসবও। আর বলতে ভুললেন না দু’চোখ ভরা স্বপ্নের কথাও।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফারহানা আফরীন এখন ঢাকা ক্যান্টমেন্টের সাপোর্ট আর্মি এভিয়েশন গ্রুপের কমান্ডিং অফিসার। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে তৃতীয় আফরীন। বাবার চাকরিসূত্রে থেকেছেন দেশের বিভিন্ন এলাকায়। কঠিন প্রশিক্ষণ শেষে সেনাবাহিনীতে যোগদান করে বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে পারাটা জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি বলে জানালেন আফরীন।
বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমির (বিএমএ) ৪৮তম দীর্ঘমেয়াদি কোর্সের অফিসার ক্যাডেটদের কমিশন প্রাপ্তির দিনের কথা স্মরণ করে বলেন, ‘আমার যখন ট্রেনিং শেষ হয় তখন বাবারও অবসরে যাওয়ার সময় চলে আসে। আমাকে র্যাংক পরাতে এসে বাবা বললেন, ‘‘তোমার হলো শুরু, আমার হলো সারা’’ কথাটা এখনো কানে বাজে।’
তবে আজকের উচ্চতায় পৌঁছাতে মোকাবেলা করতে হয়েছে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জে। সেসব গল্প বলতে গিয়ে লেফটেন্যান্ট কর্নেল আফরীন বলেন, ‘এ অবস্থানে আসতে পদে পদে যে স্ট্রাগল করতে হয়েছে তা ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষের জন্যই প্রযোজ্য। তবে মেয়েদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে দরকার তা হলো পরিবারের সমর্থন। পারিবারিক সহযোগিতা যদি সম্পূর্ণরূপে না থাকে সেটা আমাদের জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ। এরপরই সহকর্মীদের বোঝাপড়া বা সহযোগিতা অনেক বেশি প্রয়োজন।’
ফরহানা আফরীন বলেন, ‘আমি প্রথম থেকেই সাহস এবং সহযোগিতা পেয়েছি আমার বাবা-মায়ের। বাবার স্বপ্ন ছিল ভালো কিছু করব। তারাও কখনো ভাবেননি আমি এ পেশায় আসব। তবে প্রথম যখন আর্মিতে নারীদের যোগদানের সুযোগ আসল বাবাই উদ্যোগটা নিলেন, যেন আমি একটু চেষ্টা করে দেখি।’
‘ট্রেনিং চলাকালীন কোর্সমেটদের, চাকরিতে সহকর্মীদের সহযোগিতা সিনিয়রদের সঙ্গে বোঝাপড়া আর জুনিয়রদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক এসব মিলিয়েই এ অবস্থানে আসতে পেরেছি,’ যোগ করেন ফরহানা আফরীন।
চাকরিতে যোগদানের কয়েক বছর পর বিয়ের পিঁড়িতে বসেন আফরীন। জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নেন নিজ পেশারই একজনকে। স্বামী লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুস্তাফিজুর রহমান। ১০ বছরের বিবাহিত জীবনে একসঙ্গে সংসার করার সুযোগ হয়েছে মাত্র দু’বছর। তবে স্ত্রীর ক্যারিয়ার গড়তে বাধা হয়ে দাঁড়াননি তিনিও।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল আফরীন বলেন, ‘এখন সবচেয়ে বড় সাপোর্ট নিচ্ছি পরিবারের (স্বামীর) কাছ থেকে। আমার স্বামী একজন সেনা কর্মকর্তা। পোস্টিংয়ের কারণে আমরা একসঙ্গে থাকতে পারি না। তবে আমাদের মধ্যে যে বোঝাপড়া আছে সেটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এটা আছে বলেই আমরা এ পর্যন্ত এসেছি।’
‘নতুন প্রজন্ম যারা এ পেশায় আসবে তাদের যেন পরিবারের সবাই সহযোগিতা করে সেটাই প্রত্যাশা। এটাই তাদের অনেক উপরে নিয়ে যাবে,’ বলেন তিনি।
পেশাদারিত্বের কথাও উঠে আসে আলাপকালে। বলেন, ‘সেনাবাহিনীতে যার যার যোগ্যতায় কাজ করতে হয়। কেউ কাউকে সুবিধা দেয়ার জন্য কিছু করে না। প্রত্যেক কর্মকর্তার নিজস্ব কাজ আছে। সবাই সবার কাজ সম্মিলিতভাবে করলে তখন একটা ভালো কাজ হচ্ছে। এখানে নারী হিসেবে বেশি সুবিধা নেয়ার কিছু নেই।’
প্রথম নারী লেফটেন্যান্ট কর্নেল হিসেবে পদোন্নতি পাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও দেখা করেছেন আফরীনরা। সেই অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী আমাদের উচ্ছ্বসিতভাবে গ্রহণ করেছেন। শুরুর দিকের কথা বলেছেন। যখন তিনি নারী অফিসার নেয়ার উদ্যোগ নিলেন তখন কী কী প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছিলেন এবং পরবর্তীতে কী কী প্রক্রিয়ায় সেসব পার হন সেসব গল্প শুনিয়েছিলেন।’
তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী আমাদের এ অবস্থানে দেখতে পেরে অত্যন্ত খুশি হয়েছেন। উনার বিশ্বাস ছিল আমরা একদিন ভালো কিছু করব।আমরাও খুব আনন্দিত তার স্বপ্নের পথে হাঁটতে পেরে।’
যেমনটি নারী হিসেবে দ্বিতীয় ব্যাচে সেনাবাহিনীতে আসেন, তেমনি দ্বিতীয় ব্যাচের নারী হিসেবেই বিদেশের মিশনে গেছেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল আফরীন। লাইবেরিয়ায় জাতিসংঘ শান্তি মিশনে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। সেখান থেকেও অর্জন করেন নানা অভিজ্ঞতা।
সবশেষে সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ অবস্থানে যাওয়ার স্বপ্নের কথা জানান দুঃসাহসিকভাবে এগিয়ে চলা এ নারী।
জেপি/এনডিএস/পিআর