ভিডিও EN
  1. Home/
  2. বিশেষ প্রতিবেদন

প্রকল্পের ভারে পিষ্ট পরিচালকরা

প্রদীপ দাস | প্রকাশিত: ১১:১১ এএম, ০৭ মার্চ ২০১৯

হবিগঞ্জ সদর উপজেলায় স্বল্প ও মধ্যম আয়ের মানুষদের জন্য ‘সাইট অ্যান্ড সার্ভিসেস আবাসিক প্লট উন্নয়ন প্রকল্প’ পরিচালনার দায়িত্ব নেন বিজয় কুমার মণ্ডল। ২০১৬ সালের জুলাইয়ে শুরু হওয়া ওই প্রকল্প চলতি বছরের জুনে শেষ হওয়ার কথা। ৩৬ মাসের মধ্যে বাকি মাত্র পাঁচ মাস। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নের অগ্রগতি এখনও শূন্যের কোটায়।

সিলেটের সুনামগঞ্জে ‘সাইট অ্যান্ড সার্ভিসেস আবাসিক প্লট উন্নয়ন প্রকল্প’ নামে আরও একটি প্রকল্পের পরিচালক বিজয় কুমার মণ্ডল। ওই প্রকল্পের মেয়াদকাল ২০১২ সালের জুলাই থেকে ২০১৯ এর জুন পর্যন্ত। অর্থাৎ ৮৪ মাসের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা। বাকি আছে মাত্র পাঁচ মাস। অথচ এখনও প্রকৃত ব্যয়শূন্য, উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনার (মোট বরাদ্দের) মাত্র ৬ দশমিক ৪৫ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে।

জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের ঢাকা সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত বিজয় কুমার মণ্ডল। তিনি জাগো নিউজকে জানান, ঢাকায় তার ওপর আরও আটটি প্রকল্পের দায়িত্ব রয়েছে। সিলেট অঞ্চলের ওই দুই প্রকল্প এলাকায় তার পক্ষে অবস্থান করা সম্ভব হয় না। এ কারণে তাকে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

শুধু বিজয় কুমার মণ্ডল নন, একাধিক প্রকল্পের দায়িত্বে যারা রয়েছেন তাদের অধিকাংশের প্রকল্পের অগ্রগতি নেই। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরীবিক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) তথ্য অনুযায়ী, সিলেট বিভাগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাস্তবায়নাধীন ৫৮টি প্রকল্পের মধ্যে ২১টি আটজনের হাতে। এর মধ্যে দুটি প্রকল্পের অগ্রগতি শূন্যের কোটায়, ধীরগতি সম্পন্ন ১২টি এবং তুলনামূলক ভালো অগ্রগতি সম্পন্ন প্রকল্পের সংখ্যা সাতটি।

গত ২৩ ফেব্রুয়ারি সিলেট সার্কিট হাউজে সিলেট বিভাগের প্রকল্প পরিচালকদের সঙ্গে বৈঠক করেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। এ সময় সেখানে পরিকল্পনা সচিবও উপস্থিত ছিলেন। সেখানে প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণ হিসেবে একই ব্যক্তির একাধিক প্রকল্পে দায়িত্বে থাকার বিষয়টিকে দায়ী করা হয়।

‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কিছু অনুশাসন রয়েছে’ উল্লেখ করে ওই বৈঠকে মন্ত্রী বলেন, ‘প্রকল্পের কাজ যথাসময়ে শেষ করতে হবে। এক ব্যক্তি একাধিক প্রকল্পের দায়িত্বে থাকতে পারবেন না। কাজে গতি আনতে সংশ্লিষ্ট পরিচালকদের প্রকল্প এলাকায় অবস্থান করতে হবে।’

‘প্রকল্প বাস্তয়ান করে তার সুফল জনগণের মাঝে পৌঁছে দিতে প্রধানমন্ত্রীর এসব অনুশাসন অবশ্যই মানতে হবে’ বলেও প্রকল্প পরিচালকদের হুঁশিয়ার করেন পরিকল্পনামন্ত্রী।

একাধিক প্রকল্পের দায়িত্ব থাকার কারণে সেগুলো বাস্তবায়নে হিমশিম খাওয়ার কথা কেউ কেউ স্বীকার করলেও কোনো কোনো প্রকল্প পরিচালক বলছেন, তারা স্বেচ্ছায় এসব প্রকল্পের দায়িত্ব নেননি। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় তাদের এসব দায়িত্ব দিয়ে থাকে। একাধিক প্রকল্প পরিচালক হওয়ার দায় তাদের নয়। এছাড়া সিলেট অঞ্চলে প্রকল্প পরিচালক করা যায় এমন মানুষের সংখ্যাও কম।

একাই ছয় প্রকল্পের পরিচালক

সিলেট বিভাগের ছয় প্রকল্পের পরিচালকের দায়িত্ব একাই পালন করছেন সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের (সওজ) অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী তুষার কান্তি সাহা। এর মধ্যে তিনটির অগ্রগতি ধীর এবং বাকি তিনটির অগ্রগতি মোটামুটি ভালো।

জাগো নিউজ থেকে তুষার কান্তি সাহাকে ফোন করা হলে তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি।

তার প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে, ‘বানিয়াচং-আজমিরীগঞ্জ সড়ক উন্নয়ন’, ‘বিমান বন্দর বাইপাস ইন্টারসেকশন-লালবাগ-সালুটিকর-কোম্পানীগঞ্জ-ভোলাগঞ্জ সড়ককে জাতীয় মহাসড়কে উন্নীতকরণ’, ‘গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক মহাসড়ক যথাযথ মান ও প্রশস্ততায় উন্নীতকরণ (সিলেট জোন)’, ‘সিলেট শহর বাইপাস-গ্যারিসন লিংক টু শাহ পরাণ সেতুঘাট সড়ক চারলেন মহাসড়কে উন্নয়ন’, ‘ঢাকা-সিলেট-তামাবিল-জাফলং জাতীয় মহাসড়কের জৈন্তা থেকে জাফলং পর্যন্ত (তামাবিল ল্যান্ডপোর্ট কানেক্টিং ও বল্লাঘাট সংযোগ মহাসড়ক) সড়ক উন্নয়ন প্রকল্প’ এবং ‘জেলা মহাসড়ক যথাযথ মান ও প্রশস্ততায় উন্নীতকরণ (সিলেট জোন)’।

যা বলছেন দুই প্রকল্প পরিচালক

সিলেট বিভাগের তিন প্রকল্পের দায়িত্বে আছেন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. আনোয়ারুল আমিন। আইএমইডির তথ্য অনুযায়ী, তিনটি প্রকল্পই ধীরগতির। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি তিনটা প্রকল্পের পরিচালক। প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দেয় মন্ত্রণালয়। তারা কেন একাধিক প্রকল্পের পরিচালক নিয়োগ দেয়? এটা যারা দেয়, তারাই ভালো বলতে পারবেন।’

‘মতামত না নিয়েই প্রকল্প পরিচালক করা হয়েছে’ বলেও দাবি করেন আনোয়ারুল আমিন। বলেন, ‘আমাকে যে প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছে, এতে কিন্তু আমার মতামত নেয়া হয়নি। আমাকে পাঁচটা নাকি ১০টা প্রকল্পের দায়িত্ব দেয়া হবে- এটা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত। এখানে আমার কিছুই করার নাই।’

এই প্রকৌশলীর প্রশ্ন, ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা আছে, একাধিক প্রকল্পের পরিচালক এক ব্যক্তি হতে পারবেন না। এটা যদি হয়, তাহলে বাইরে থেকে প্রকল্প পরিচালক আনতে হবে। কারণ আমাদের তো অফিসার নাই। সিলেট জেলায় ১২টা প্রকল্প চলছে। প্রকল্প পরিচালক হওয়ার মতো আছেন মাত্র পাঁচ থেকে ছয়জন অফিসার। তারপরও তো দুটার ওপরে পড়ে। তাহলে প্রকল্প পরিচালক পাবে কোথায়?’

অন্যদিকে, সিলেটে দুই এবং ঢাকার আট প্রকল্পের পরিচালক বিজয় কুমার মণ্ডল জাগো নিউজকে বলেন, ‘অবশ্যই হিমশিম খেতে হয়। কারণ আমি ঢাকায় আরও আটটা প্রকল্পের পিডি। ঢাকারগুলোতে সমস্যা হচ্ছে না।’

তিনি বলেন, ‘সিলেটে আমাকে মাসখানেক আগে দায়িত্ব দেয়া হয়। ওই দায়িত্ব ছেড়ে দিলে আমার জন্য ভালো হয়। কারণ দায়িত্ব নেয়ার মানে হচ্ছে, সেখানে সময় দেয়া। কিন্তু আমি তো সময় দিতে পারছি না।’

সিলেটে কাজের বিড়ম্বনা সম্পর্কে তিনি আরও বলেন, ‘প্রকল্প নিয়ে ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগের প্রয়োজন হয়, কিন্তু সেটা ওখান থেকে করা একটু কঠিন। কাগজপত্রের দিক থেকে অফিসিয়াল যোগাযোগ আমি ঢাকায় থাকায় করতে পারছি। কিন্তু সরেজমিন তত্ত্বাবধান তো সম্ভব হয় না। আমাদের ওখানে চারটা জেলা মিলে মাত্র একজন নির্বাহী প্রকৌশলী। এজন্য এটা করা মুশকিল। এছাড়া গাড়ি, বেতন-ভাতা, এগুলো আলাদা লাগে না। এগুলো দিতে গেলে তো প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে যায়।’

নিজেদের প্রকল্পের বিষয়ে যা বলছেন তারা

‘পাগলা-জগন্নাথপুর-রানীগঞ্জ-আউশকান্দি মহাসড়কের রানীগঞ্জে কুশিয়ারা নদীর ওপর সেতু নির্মাণ’, ‘সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়ক উন্নয়ন’ এবং ‘গোবিন্দগঞ্জ-ছাতক-দোয়ারাবাজার সড়কে সুরমা নদীর ওপর ছাতক সেতুর অবশিষ্ট কাজ সমাপ্তকরণ’ – এ তিন প্রকল্পের পরিচালক আনোয়ারুল ইসলাম।

আইএমইডির প্রতিবেদনে ‘গোবিন্দগঞ্জ-ছাতক-দোয়ারাবাজার সড়কে সুরমা নদীর ওপর ছাতক সেতুর অবশিষ্ট কাজ সমাপ্তকরণ’ প্রকল্পকে ধীরগতি উল্লেখ করা হয়। কিন্তু এটি মানতে নারাজ আনোয়ারুল আমিন। তার দাবি, ‘এটা ধীরগতিসম্পন্ন নয়। এটার মেয়াদ ২০২০ সাল পর্যন্ত। কখনই ধীরগতির নয়, প্যারালাল আছে।’

সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটার বিরুদ্ধে মামলা ছিল দুটা। হাইকোর্টের নির্দেশে এটার কাজ প্রায় ১০ মাস বন্ধ ছিল।’

অন্যদিকে, হবিগঞ্জ সদর উপজেলায় স্বল্প ও মধ্যম আয়ের মানুষের জন্য ‘সাইট অ্যান্ড সার্ভিসেস আবাসিক প্লট উন্নয়ন প্রকল্প’র বিষয়ে বিজয় কুমার বলেন, ‘জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়াটা জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব। উনি জমি অধিগ্রহণ করতে পারেননি। এক জায়গায় চেষ্টা করেছেন, হয়নি। আরেক জায়গায় চেষ্টা করছেন। ওই জমির মূল্য নির্ধারণ করে আমাদের নোট দেবেন, টাকা জমা দেয়ার জন্য। এই পর্যায়ে আছে। জমি অধিগ্রহণ করে আমাদের কাছে হস্তান্তর করলে আমরা বাকি কাজ এগিয়ে নিতে পারব। অগ্রগতি কম হওয়ার মূল কারণ এটাই।’

সিলেটে আরও যারা একাধিক প্রকল্পের দায়িত্বে

প্রকৌশলী মো. আলী আকবর সিলেট বিভাগের তিন প্রকল্পের দায়িত্বে আছেন। আইএমইডির তথ্য অনুযায়ী, ‘উন্নত শিক্ষা ও পরিবেশের মান উন্নয়নে সিলেট সিটি করপোরেশনের অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প’ ধীরগতির, ‘সিলেট সিটি করপোরেশনের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত প্রধান ১১টি ছড়া সংরক্ষণ ও আরসিসি রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ (প্রথম সংশোধন) প্রকল্প’ তুলনামূলক ভালো অগ্রগতি এবং ‘সিলেট সিটি করপোরেশনের অবকাঠামো নির্মাণ’ প্রকল্পটির অগ্রগতি শূন্যের কোটায়।

‘পল্লী অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প : দক্ষিণ সুনামগঞ্জ ও জগন্নাথপুর উপজেলা, সুনামগঞ্জ জেলা প্রকল্প’ এবং ‘সিলেট বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন’– এ দুই প্রকল্পের পরিচালক এলজিইডির আলী হোসেন চৌধুরী। এর মধ্যে প্রথমটির অগ্রগতি মোটামুটি ভালো এবং দ্বিতীয়টি ধীরগতির।

প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মো. সরফদ্দীনের ‘সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন (প্রথম পর্যায়, দ্বিতীয় সংশোধিত)’ প্রকল্পের অগ্রগতি তুলনামূলক ভালো এবং ‘সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি একাডেমিক ভবন এবং অডিটোরিয়াম ভবন নির্মাণ’ প্রকল্পের অগ্রগতি ধীরগতির।

‘সিলেট টেক্সটাইল ইন্সটিটিউট স্থাপন’ এবং ‘শেখ রাসেল টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, সিলেট’ – প্রকল্প দুটির পরিচালক এ এম মোতাহের হোসেন। প্রথমটির অগ্রগতি শূন্য এবং দ্বিতীয় প্রকল্পটি ধীরগতির।

‘একাধিক প্রকল্পে একই পরিচালক, যে কারণে ধীরগতি।’ এ বিষয়ে টিআইবি'র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, ‘এটা তো অবশ্যই অস্বাভাবিক চিত্র। এজন্য প্রধানমন্ত্রী যথার্থই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এবং নির্দেশনা দিয়েছেন। পরিকল্পনামন্ত্রীও বলেছেন। এখন উচিত হবে অনতিবিলম্বে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।’

তিনি আরও বলেন, ‘একজন ব্যক্তি একাধিক প্রকল্পের দায়িত্বে থাকলে বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রিতা হয়, ব্যয়ও বেড়ে যায়। অন্যদিকে, দুর্নীতিরও সুযোগ সৃষ্টি হয়। এক ব্যক্তিকে একাধিক প্রকল্পে দায়িত্ব দেয়ার পেছনে যদি কোনো প্রকার প্রভাব, যোগসাজশ বা অনিয়ম জড়িত থাকে, তাহলে তাদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনতে হবে।’

পিডি/এমএআর/জেআইএম

আরও পড়ুন