ভিডিও EN
  1. Home/
  2. বিশেষ প্রতিবেদন

কেমিক্যাল না এলপিজি, ব্লেইম গেম বন্ধ করে প্রতিকার খুঁজতে হবে

আদনান রহমান , জসীম উদ্দীন | প্রকাশিত: ০৭:৫৫ পিএম, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

‘ঘাতক’ কেমিক্যালের কারণে পুরান ঢাকায় প্রথমবার ঝরে ১২৪ প্রাণ (নিমতলীর অগ্নিকাণ্ড)। এবার চকবাজারে অঙ্গার হলেন ৬৭ জন। এরপরও কেন অবাধে কেমিক্যাল বিক্রি হচ্ছে পুরান ঢাকায়? কীভাবে একজন বাড়িওয়ালা আবাসিক ভবনে কেমিক্যালের গোডাউন ভাড়া দিয়ে বছরের পর বছর লাখ লাখ লোকের জীবন ঝুঁকিতে ফেলছেন? এসব বিষয়ে জানতে সেবা প্রতিষ্ঠান ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আলী আহমদ খানের সঙ্গে কথা হয় জাগো নিউজ’র।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আদনান রহমানজসীম উদ্দীন। পাঠকদের জন্য এটি তুলে ধরা হলো।

জাগো নিউজ : ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও কেন এবং কীভাবে আবাসিক ভবনে কেমিক্যাল মজুত রাখা হচ্ছে?

আলী আহমদ খান : কেমিক্যালের দোকান বা গুদামের লাইসেন্স আমরা দেই না। বিস্ফোরক অধিদফতর লাইসেন্স দেয়। তবে আমি মনে করি, তাদের এ দায়িত্ব দেয়া উচিত নয়। তারা শুধু গিয়ে স্বাক্ষর করেই লাইসেন্স দেয়। তাদের এ দায়িত্ব পালনের ক্যাপাসিটি নেই।

আরও পড়ুন >> মেয়র এক, মন্ত্রী বললেন ছয় মাস

কেমিক্যাল হোক বা এলপিজি (তরলিকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস), তাদের কেউই ফায়ার সার্ভিস থেকে লাইসেন্স নেয় না, এটা বাধ্যতামূলক নয়। আমি চাই, এটা বাধ্যতামূলক করা হোক। ফায়ার সার্ভিসের লাইসেন্স ছাড়া তাদের ব্যবসা করতে দেয়া উচিত নয়। উন্নত দেশগুলো এমনকি সিঙ্গাপুরেও কোনো হোটেলে ফায়ার সার্ভিসের লাইসেন্স ছাড়া এলপিজি লাগাতে পারে না।

ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র নেয়া বাধ্যতামূলক করতে আমরা নিয়মিত মন্ত্রণালয়ে অ্যাপ্রোচ করে যাচ্ছি।

জাগো নিউজ : কেমিক্যাল নাকি এলপিজি? আগুনের সূত্রপাত নিয়ে নানা মত। তদন্ত কমিটির একজন সদস্য হিসেবে আপনার ফাইন্ডিংস (উদ্ঘাটন) কী?

আলী আহমদ খান : প্রাথমিকভাবে আমার মনে হয়, দোতলায় (হাজী ওয়াহেদ ম্যানশন) হাইলি ফ্লেইমেবল এক্সপ্লোশন (উচ্চমাত্রার দাহ্য পদার্থের বিস্ফোরণ) থেকেই আগুনের সূত্রপাত। ভিডিও ফুটেজে আমরা মানুষকে দৌড়াদৌড়ি করতে দেখেছি। যদি নিচ থেকে বিস্ফোরণ হতো তাহলে মানুষ এতো দৌড়াদৌড়ি করতে পারতো না। বুয়েটের বিশেষজ্ঞরাও আমার সঙ্গে একই মতামত ব্যক্ত করেছেন।

southeast

এলপিজি অত সহজে ব্লাস্ট (বিস্ফোরিত) হয় না। আগুনে পড়ে থাকলেও তা সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরিত হয় না। কারণ এর মুখ টাইট (শক্ত) করে লাগানো থাকে এবং গার্ড থাকে। এলপিজির বিস্ফোরণগুলো সাধারণত কেয়ারলেসনেসের (অসাবধানতা) কারণে হয়ে থাকে। চুড়িহাট্টার ওই অগ্নিকাণ্ডে ঘটনাস্থলে থাকা হোটেলের এলপিজিগুলো ঠিক ছিল।

একটা কথা মনে রাখতে হবে, তিনটা কারণে আগুন তীব্র হয় এবং দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। হিট (গরম ভাব/তাপ) থাকলে, সোর্স (দাহ্য পদার্থ) থাকলে এবং অক্সিজেন থাকলে। এ তিনটার যে কোনো একটা যদি কাট-অফ (বিচ্ছিন্ন) করা যায় তাহলে আগুন বাড়তে পারে না। যেমন- কার্বন ডাই-অক্সাইড দিয়ে আমরা অক্সিজেনকে দমাতে পারলে আগুন বন্ধ হয়ে যেত। কিন্তু এখানে অতিরিক্ত দাহ্য পদার্থ থাকায় কোনোটাই দমানো যাচ্ছিল না।

জাগো নিউজ : বিস্ফোরণ এত ভয়াবহ রূপ নেয়ার কারণ কী?

আলী আহমদ খান : ঘটনাস্থলের আশপাশে থিনারের দোকান ছিল। থিনার থাকার কারণে একের পর এক বিস্ফোরণ হয়। দোতলায় স্পিরিট, বিউটেন, ফিনাল (দাহ্য কেমিক্যাল) ছিল। ওখানে এগুলো রিফিল করা হতো। রিফিলের সময় স্পার্ক (স্ফুলিঙ্গ) থেকে বা অন্য কোনো কারণে আগুন লাগে। বিস্তারিত তদন্তের পর বলা যাবে।

আরও পড়ুন >> কেমিক্যাল কারখানা অপসারণে কাউকে ছাড় নয়

জাগো নিউজ : চকবাজারসহ গোটা পুরান ঢাকায় মুখোমুখি অবস্থানে এলপিজি ও কেমিক্যাল ব্যবসায়ীরা। আগুনের সূত্রপাত নিয়ে একে-অন্যের ওপর ব্লেইম (দোষারোপ) দিচ্ছে। বিক্ষোভ করে স্লোগান দিচ্ছে। পুরান ঢাকাবাসীর এখন কী করা উচিত বলে আপনি মনে করেন?

আলী আহমদ খান : এখন দোষারোপের সময় নয়। যদি পুরান ঢাকার চকবাজারে না হয়ে আগুনটা যদি অন্য জায়গায় লাগতো তাহলে এতটা মর্মান্তিক রূপ ধারণ করতো না। বুঝতে হবে এটা পুরান ঢাকা। পুরান ঢাকার পুরো পরিবেশটাই ভোলাটাইল, পুরোটাই আন-অথরাইজড। তাহলে শুধুমাত্র সিলিন্ডার কিংবা কেমিক্যালকে দোষারোপ করা হচ্ছে কেন?

southeast

সাংবাদিকরাও বারবার একই প্রশ্নের উত্তর চান। আমি বলব, পুরো জিনিসটাই তো আন-অথরাইজড। এ ধরনের ব্লেইম গেমের (দোষারোপ) কারণে বাংলাদেশ পিছিয়ে যাবে। অনেক উন্নত দেশেও এ ধরনের দু-একটা ঘটনা হয়। কিন্তু দেখতে হবে ঘটনা ঘটার পর তারা কী করে? প্রতিরোধমূলক কী ব্যবস্থা নেয়? আমাদেরও এসবের প্রতিকার খুঁজতে হবে।

জাগো নিউজ : চকবাজারের আগুন নেভানোর সময় কী কী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে?

আলী আহমদ খান : প্রথমত, এটা পুরান ঢাকা। ঢাকার অন্যান্য এলাকায় আগুনের সঙ্গে ফাইট করা আর পুরান ঢাকায় ফাইট করা এক নয়। সরু গলি, মানুষের জটের কারণে ঢুকতে সমস্যা…, তবে আমরা মনে করি, আগুন লাগার ৫-৭ মিনিটের মধ্যেই আমরা দ্রুত রেসপন্স করতে পেরেছি।

southeast

দ্বিতীয়ত, সেখানে প্রচুর দাহ্য পদার্থ ছিল, সে কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। আগুন নেভানোর পুরো প্রচেষ্টা আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জিং ছিল।

আরও পড়ুন >> সিলিন্ডার নয়, দোতলার কেমিক্যাল বিস্ফোরণে আগুনের সূত্রপাত

সাধারণত একটি আগুন লাগার পর ছোট থেকে বড় আকার ধারণ করে। কিন্তু এ আগুন প্রথম থেকেই বড় মাত্রা ও ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে। অতিরিক্ত মানুষের কারণে আমাদের বেগ পেতে হয় কিন্তু আমরা আস্তে আস্তে চুড়িহাট্টার চারদিক থেকে আগুনকে অ্যাটাক করি।

একসময় আমাদের পানি কমে আসে। তখন আমরা পুরান কেন্দ্রীয় কারাগার, চুড়িহাট্টা জামে মসজিদ ও আশপাশের বাড়িগুলো থেকে পানি সংগ্রহ করি। কারণ উন্নত দেশের মতো আমাদের এখানে ফায়ার হাইড্রেন্ট নাই। বিদেশিরা শুনলে অবাক হয় যে, বাংলাদেশ কীভাবে এ ধরনের আগুন নেভায়!

আগুন নেভাতে গিয়ে আমরা আরেকটি অদ্ভূত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হই। আগুনের একপর্যায়ে ফায়ার সার্ভিসের একটি রেসকিউ কার (উদ্ধারযান) ঘটনাস্থলে আসে। এর ভেতরে মানুষের জানমাল রক্ষার প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ছিল। তবে স্থানীয়রা যখন দেখে যে, ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি অথচ ভেতরে পানি নাই তখন বিক্ষোভ শুরু করে।

southeast

‘পানি ছাড়া খালি গাড়ি নিয়ে আসছেন কেন’ বলে চিৎকার করতে থাকে। এত মানুষকে আমাদের পক্ষে বোঝানো সম্ভব ছিল না। তাই একপর্যায়ে আমি গাড়িটি নিয়ে সেখান থেকে দূরে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেই। এটা একটা অদ্ভূত অভিজ্ঞতা।

ভবনে এত বেশি দাহ্য পদার্থ ছিল যে, একটার পর একটা বিস্ফোরণ হয়েছে। অনেক সময় আমরা কাছে যেতে পারিনি। তারপরও চারদিক থেকে অ্যাটাক করে আমাদের আগুন থামাতে হয়েছে।

জাগো নিউজ : হাজী ওয়াহেদ ম্যানশনের বেসমেন্টে যেসব কেমিক্যাল পাওয়া গেছে সেগুলো বিস্ফোরিত হলে কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হতে পারত? বেসমেন্ট অক্ষত থাকলো কীভাবে?

আলী আহমদ খান : হাজী ওয়াহেদ ম্যানশনের ওপরের আগুনের হিটটা বেসমেন্টে ট্রান্সফার হয়নি (পৌঁছায়নি)। বেসমেন্টে গেলে পরিণতি অন্যরকম হতে পারত। তবে বেসমেন্টে কী কেমিক্যাল ছিল তা আমরা চেক করতে পারিনি। আমরা নিশ্চিত নই যে, কেমিক্যালগুলো দাহ্য পদার্থ ছিল কি-না।

southeast

আরও পড়ুন >> ফুটেজ বলছে, আগুনের সূত্রপাত সিলিন্ডার : মেয়র

জাগো নিউজ : আগুন নেভাতে অংশ নেয়া ৩০০ ফায়ার ফাইটিং সদস্যের পারফরমেন্স নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?

আলী আহমদ খান : একের পর এক বিস্ফোরণ হচ্ছিল। আগুনের বড় বড় কুণ্ডলী দেখা যাচ্ছিল। এর মধ্যেও বাংলাদেশের ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা সামনে গিয়ে আগুন নেভানোর কাজ করেছে।

অন্যকোনো দেশের কর্মীরা হলে আগে নিজের জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করতো। সামনে যেত না। আমাদের কর্মীরা অনেক সাহসী, জনগণ সাহসী। এটা ঠিক যে, তারা হেলমেট পরা ছিল, কিন্তু হেলমেট-ইউনিফর্ম থাকলেও বিস্ফোরণের সামনে যেতে সাহস লাগে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা সাহসিকতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছে। একটুও নড়চড় করেনি।

এআর/জেইউ/এমএআর/এমএস