ভিডিও EN
  1. Home/
  2. বিশেষ প্রতিবেদন

নারীবান্ধব টয়লেট নেই ঢাকা বারে

মুহাম্মদ ফজলুল হক | প্রকাশিত: ১০:৩৬ পিএম, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

এশিয়ার সর্ববৃহৎ বার হিসেবে পরিচিত ঢাকা আইনজীবী সমিতি (ঢাকা বার)। যেখানে নারী-পুরুষ মিলিয়ে প্রায় ৩০ হাজার আইনজীবী কর্মরত। এর মধ্যে নারী আইনজীবী প্রায় পাঁচ হাজার। কিন্তু তাদের জন্য টয়লেট আছে মাত্র চারটি। সেখানেও নেই পর্যাপ্ত পানি, টিস্যু ও সাবানের কোনো ব্যবস্থা। তাই নারী আইনজীবীদের বিশেষ মুহূর্তে বা পিরিয়ডকালীন সময়ে পড়তে হয় চরম বিড়ম্বনায়। নারী আইনজীবী এবং কোর্টের নারী কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

কর্মস্থলে নারীবান্ধব টয়লেটের ব্যবস্থা না থাকায় পিরিয়ড চলাকালে অনেকে টয়লেটে যাওয়া থেকে বিরত থাকেন। বাধ্য হয়ে দীর্ঘক্ষণ পরে থাকতে হয় একই স্যানিটারি প্যাড। এতে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে তাদের।

দেশের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে কর্মক্ষেত্রে পুরুষের পাশাপাশি নারীদের অংশগ্রহণ দিনদিন বাড়ছে। তাই কর্মস্থলে নারীবান্ধব টয়লেট ব্যবস্থাপনা শুধু প্রয়োজনই নয় বরং এটা নারীদের মৌলিক অধিকারে পরিণত হয়েছে। অথচ কর্মক্ষেত্রে সে ব্যবস্থাপনা না থাকায় প্রতিনিয়ত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন নারীরা।

ঢাকা আইনজীবী সমিতির (ঢাকাবার) তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ঢাকা জজ কোর্টে নারী আইনজীবীর সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার। এর মধ্যে নিয়মিত প্র্যাকটিস করেন আড়াই হাজারেরও বেশি নারী। এছাড়া তাদের সঙ্গে জুনিয়র হিসেবে কাজ করেন সদ্য পাস করা শিক্ষানবিশ প্রায় আট থেকে নয় শতাধিক নারী আইনজীবী। সেই সঙ্গে কোর্টের প্রশাসন ও দফতরে কর্মরত নারী কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং নারী বিচারপ্রার্থীরাও প্রতিদিন কোর্টে আসছেন। তাদের জন্য নেই পর্যাপ্ত টয়লেট, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য পানি, টিস্যু ও সাবানের ব্যবস্থা।

এ বিষয়ে ঢাকা বারের সিনিয়র সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট কাজী শাহানারা ইয়াসমিন জাগো নিউজকে বলেন, ২৯ হাজার আইনজীবীর বারে আমরা পাঁচ হাজার নারী। সেখানে বাথরুম খুবই কম। পাঁচ হাজার নারীর জন্য মাত্র চারটি টয়লেট। একটি কমন রুম রয়েছে। তবে প্রধানমন্ত্রী ২০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়ার পর নির্মিত ১০ তলা ভবনে একটি কমন রুম করেছি আমরা। যদিও সেখানে কোনো টয়লেট তৈরি করা হয়নি। ১০ তলা ভবনের প্রতিটি তলায় টয়লেট আছে। যা নারী-পুরুষ সবাই গণহারে ব্যবহার করেন।

তিনি বলেন, এসব ওয়াসরুমে (টয়লেটে) নারীদের জন্য পিরিয়ড চলাকালীন বা মাতৃত্বকালীন কোনো ব্যবস্থা তো দূরে কথা, পর্যাপ্ত পানি কিংবা নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নের উদ্যোগ নেয়া হয় না। সেখানে টিস্যু, সাবানসহ হাইজেনিক কোনো ব্যবস্থা নেই। মাসিক আর মাতৃত্বকালীন ব্যবস্থা তো আরও পরে।

ঢাকা দায়রা জজ আদালতের দ্রুত বিচার আদালত-৬ এর স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর এবং ঢাকা জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট সালমা হাই টুনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিদেশে যারা কোর্ট ব্যবস্থা দেখে এসেছেন, তারা দেশের কোর্ট আঙ্গিনার টয়লেট ব্যবস্থাপনা দেখলে প্রথমেই ধাক্কা খাবেন। আমার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম কিছু হয়নি। আমাদের ঢাকা বারের মূল ভবনে নারীদের জন্য একটি কমন রুম তার সঙ্গে চারটি টয়লেট, দুটি বেসিন রয়েছে। সঙ্গে একটি নামাজের জায়গা। কিন্তু টয়লেটে নেই পর্যাপ্ত পানি ও টিস্যুর ব্যবস্থা। আর নারীর বিশেষ মুহূর্তের কথা তো বাদই দিলাম। কমন রুমে বসে খাওয়া ও বিশ্রামের জায়গা হয় না। সেখানে নারীর মাসিক ও স্বাস্থ্যবান্ধব টয়লেট তো অনেক দূর। কমপক্ষে ১০টি টয়লেট থাকলে মোটামুটি চলতো।

সুপ্রিম কোর্টের এই আইনজীবী আরও বলেন, ‘কোর্ট ভবনে যখন কোনো মামলার শুনানির জন্য যেতে হয়, তখন টয়লেট ব্যবহার অপরিহার্য হয়ে উঠলে দীর্ঘপথ হেঁটে আমাকে আইনজীবী সমিতি ভবনের টয়লেটে আসতে হয়। সেখান থেকে আবার কোর্ট রুম। ততক্ষণে কোর্টে মামলার শুনানি শুরু হয়ে যায়।

‘টয়লেটের জন্য এত দূর যাওয়ার বিষয়টি সব নারী আইনজীবীর কাছেই বিরক্তিকর।’

তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিটি ভবনের প্রতি তলাতে নারীদের জন্য টয়লেট থাকা প্রয়োজন। এ নিয়ে আমি নিজেও কয়েকবার ভেবেছি। অনেক নারী আইনজীবী কোর্টের টয়লেট ব্যবস্থাপনা নিয়ে আমার কাছে আপত্তি জানিয়েছেন। আমি নিজেও অনেকের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা করেছি। কিন্তু কোনো সমাধান পাওয়া যায়নি।’

সালমা হাই টুনি বলেন, ‘টয়লেট ব্যবস্থা উপযুক্ত না হওয়ায় আমাদের নারী আইনজীবীদের মধ্যে অনেকেই এখানকার টয়লেট ব্যবহার না করে বাসায় চলে যান কিংবা কম পানি খেয়ে সকাল বেলা বাসা থেকে বের হন। এতে তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়তে হয়। এভাবে তো আর দীর্ঘদিন চলা যায় না। পিরিয়ড চলাকালে অনেক নারী আইনজীবী কোর্টে আসা থেকে বিরত থাকেন।’

যে কারণে পিরিয়ডকালীন নারীবান্ধব টয়লেট দরকার
পিরিয়ডকালে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত প্রকল্প নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান রেড অরেঞ্জ মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশনের হেড অব প্রোগ্রাম নকীব রাজীব আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘পিরিয়ডকালে নারীবান্ধব টয়লেটে তাদের জন্য নিরাপদ পানি, সাবান, হাত ধোয়ার ব্যবস্থা ও একটি ঢাকনাযুক্ত ঝুড়ি বা বিন থাকা জরুরি। এছাড়া যদি টয়লেটে স্যানিটারি প্যাডের সরবরাহ সবসময়ের জন্য নিশ্চিত করা যায়, তাহলে আমরা অবশ্যই সেই টয়লেটকে পিরিয়ডকালে নারীবান্ধব টয়লেট বলতে পারব।’

নকীব রাজীব আহমেদ আরও বলেন, ‘স্যানিটারি প্যাড পরিবর্তনের জন্য টয়লেটের ভেতরের জায়গাটিও প্রয়োজন অনুযায়ী বেশি হওয়া দরকার। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, টয়লেটে শুধু বসার জায়গা ছাড়া আর কোনো স্থান থাকে না। তাই নারীদের গোপনীয়তা রক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করতে তাদের টয়লেটগুলো একটু বেশি জায়গা নিয়ে বিশেষভাবে নির্মাণ করা উচিত।’

নারীবান্ধব টয়লেট না থাকায় স্বাস্থ্যঝুঁকি
রিপ্রোডাকটিভ হেলথ সার্ভিসেস, ট্রেনিং অ্যান্ড এডুকেশন প্রোগ্রামের উপ-পরিচালক ডা. এলভিনা মোস্তারী বলেন, ‘কর্মস্থলে নারীদের পিরিয়ডকালে ব্যবহার উপযোগী টয়লেট থাকা খুবই প্রয়োজন। প্যাড পরিবর্তনের বিড়ম্বনার জন্য অনেকেই কর্মস্থলে যাওয়া থেকে বিরত থাকেন। যারা কর্মস্থলে যাচ্ছেন, তারাও ব্যবহার উপযোগী টয়লেট না পাওয়ায় একটি প্যাড দীর্ঘসময় পরে থাকছেন। অথচ প্রয়োজন মাফিক কিংবা প্রতি ছয় ঘণ্টা পর স্যানিটারি প্যাড পরিবর্তন না করলে নারীদের শরীরে বিভিন্ন ধরনের রোগ-জীবাণুর সৃষ্টি হয়। এতে নারীর জরায়ুতে ফাঙ্গাল ইনফেকশন, চুলকানি, সাদাস্রাব, মূত্রনালীর সংক্রমণ (ইউটিআই) কিংবা তলপেটে প্রচণ্ড ব্যথা হতে পারে। এসব সংক্রমণ থেকে নারীরা জরায়ুর ক্যান্সার, বন্ধাত্ব এমনকি শারীরিক বা মানসিক দিক থেকে স্থায়ী কোনো রোগে আক্রান্ত হতে পারেন।’

সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার গোলাম রব্বানী এ প্রসঙ্গে জাগো নিউজকে বলেন, সুপ্রিম কোর্টে নারীবান্ধব ও স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট ব্যবস্থাপনা সার্বিক তদারকি করা হচ্ছে। আমরা সুপ্রিম কোর্টের সব টয়লেট সংস্কার ও ভালোভাবে পরিষ্কার করাচ্ছি। এখানে নারীদের জন্য আলাদা টয়লেটের ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু, অনেক পুরুষই ভুলক্রমে নারীদের টয়লেটে চলে যাচ্ছেন, এটি একটি সমস্যা। তবুও আমাদের পরিচ্ছন্নকর্মীরা টয়লেট পরিষ্কারের বিষয়ে সবসময় সচেতন থাকেন।

তিনি বলেন, সুপ্রিম কোর্টের বাইরে লোয়ার কোর্টে (নিম্ন আদালতে) গিয়ে আমরা খোঁজখবর নিতে পারি না। কারণ সেখানে জেলা জজ কোর্টের জন্য জেলা জজ, জেলা ও দায়রা আদালতের জন্য জেলার দায়রা জজ এবং মেট্রোপলিটন আদালতের জন্য সিএমএম দায়িত্বে রয়েছেন। তারা বিষয়টি তদারকি করতে পারেন। তবে এসব আদালতে নারী আইনজীবীদের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট ব্যবস্থাপনার জন্য যদি কেউ আমাদের নোটিস করেন তবে আমরা উদ্যোগ নিতে পারি।

রেজিস্ট্রার গোলাম রব্বানী আরও বলেন, বর্তমান সরকারের সময়ে ঢাকা সিএমএম কোর্টের ভবনগুলো নতুন করে তৈরি করা হয়েছে। সেখানে পর্যাপ্ত টয়লেট আছে। কিন্ত এসব টয়লেট ব্যবস্থাপনা বা তদারকির অভাবে অপরিচ্ছন্ন বা ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে একসময়। তাই আগে থেকেই এসব তদারকি করা দরকার। কিছু টয়লেট নারীদের জন্য সংরক্ষণও দরকার।

এফএইচ/এমএমজেড/এমএআর/আরএস

আরও পড়ুন