নির্বাচন নিয়ে মানুষের মাঝে নির্লিপ্ততা কাজ করছে
শরীফ নুরুল আম্বিয়া। বাংলাদেশ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল- জাসদের সভাপতি। ছাত্র রাজনীতি, স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষক ছিলেন। স্বাধীনতার পর বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অন্যতম সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। আন্দোলন-সংগ্রামের পথ পরিক্রমায় বর্তমানে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পরিষদ সভার প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেন। সমসাময়িক রাজনীতি এবং বিভিন্ন ইস্যুতে জাগো নিউজের মুখোমুখি হন। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের প্রথমটি থাকছে আজ।
জাগো নিউজ : জামায়াতের শীর্ষ নেতার পদত্যাগ, দলটির বিলুপ্তির পরামর্শ, ক্ষমা চাওয়া এবং কেউ কেউ মনে করছেন জামায়াত নতুন নামে আবার রাজনীতিতে সক্রিয় হতে পারে। বিষয়গুলো কীভাবে দেখছেন?
আরও পড়ুন >> রব কীভাবে জামায়াতের সঙ্গে হাত মেলায়?
শরীফ নুরুল আম্বিয়া : জামায়াত নতুন নামে রাজনীতি করবে কিনা- এ ব্যাপারে আমার কোনো ধারণা নেই। তবে জামায়াত যে অন্যায়-অপরাধ করেছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে; সেটার জন্য ক্ষমা চাইলে তাদের প্রতি মানুষের রাগ-ক্ষোভ কিছুটা হলেও লাঘব হবে। মুক্তিযুদ্ধের সরাসরি বিরোধিতাসহ পাক হানাদারদের প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতার জন্য জামায়াতে ইসলামী নামের দলটাকে নিষিদ্ধ করা উচিত।
জাগো নিউজ : একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশ জাসদের জাতীয় পরিষদ সভার মূল্যায়ন নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানামুখী আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়। কেউ কেউ মনে করেন, ১৪ দলীয় জোটে থেকে আপনারা এ ধরনের মূল্যায়ন প্রকাশ করলে সেটা জোট নেতৃত্বাধীন দলের জন্য বিব্রতকর। আপনি কী মনে করেন?
শরীফ নুরুল আম্বিয়া : আমাদের জাতীয় পরিষদ সভার প্রস্তাবটি ছিল রাজনৈতিক। সারাদেশ থেকে বিভিন্ন জেলা পর্যায়ের যেসব নেতা এসেছিলেন, নির্বাচন সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণার ভিত্তিতে সর্বসম্মতক্রমে ওই রেজুলেশন নেয়া হয়। আমাদের ওই প্রস্তাব ১৪ দলীয় শরিকরা মানতেও পারেন, নাও মানতে পারেন- সেটা যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার। অন্য দল কী ভাবলো- সেটা দ্বারা আমাদের ভাবনা প্রভাবিত হয় নাই। আমরা মনে করেছি, এটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটা তুলে ধরা উচিত। রাজনীতির স্বচ্ছতার জন্য এটা থাকা উচিত। আড়ালে-আবডালে না বলে যেসব ভুল-ত্রুটি হয়েছে, সেগুলো তুলে ধরে সাংবিধানিক ধারাটাকে অব্যাহত রাখাই চ্যালেঞ্জিং বিষয়।
জাগো নিউজ : নির্বাচনের পর ১৪ দলীয় জোট নিয়ে নানা কথা চলছে। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে প্রত্যাশা ব্যক্ত করা হয়েছে যে, জোটের শরিক দলগুলো একটা গঠনমূলক সমালোচনা বা বিরোধী দলের ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে। আপনি বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
আরও পড়ুন >> জামায়াতকে রাজনৈতিক মাঠ থেকে বিতাড়িত করবই
শরীফ নুরুল আম্বিয়া : আমরা মনে করি, প্রতিটি দলই নিজ নিজ জায়গায় ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করতে পারে। যারা রাজনীতির কর্ণধার, বিশেষ করে গত এক দশক ধরে যারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় তারা একটা কার্যকর সংসদ উপহার দিতে ব্যর্থ হয়েছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করে নাই, তারা সন্ত্রাসের লাইনে ছিল। সেই দায়দায়িত্ব এবং সেই সংসদ সফল না হওয়ার পেছনে প্রধান দায়ভার বিএনপির। কিন্তু এ নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করেছে। নির্বাচনের পর আমরা একটা কার্যকর সংসদ প্রত্যাশা করি।
আমি মনে করি, কার্যকর সংসদের জন্য একটা কার্যকর বিরোধী দল প্রয়োজন। বিগত সংসদে জাতীয় পার্টি না সরকারে, না বিরোধী দলে ছিল। মন্ত্রীও ছিল আবার বিরোধিতায়ও ছিল। এবার তারা ২২টা সিট পেয়ে বিরোধী দলে বসেছে। তাদের নিয়ে মানুষের কোনো আশা-আকাঙ্ক্ষা আছে বলে আমার মনে হয় না।
বিএনপি এবার অল্পকিছু সিট পেয়েছে। সেটা বড় বিষয় নয়। আমার কাছে মনে হয়, প্রশাসনের অতি-উৎসাহী একটা অংশ পুরো নির্বাচনটাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে দিয়েছে এবং কলঙ্কিত করেছে। নির্বাচন কলঙ্কিত করার জন্য অতি-উদ্যোগ যদি গ্রহণ না করা হতো তাহলে হয়তো আমরা একটা প্রাণবন্ত সংসদ পেতাম।
১৪ দল বা মহাজোটের বিজয়ের বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ ছিল না। যদিও অনেকের এ ব্যাপারে সন্দেহ ছিল। আমরা দলগতভাবে মনে করি, ক্ষমতা আমাদের হাত থেকে চলে যাবে- এ ধরনের কোনো পরিবেশ-পরিস্থিতি তৈরি হয় নাই। কারণ যারা বিরোধী দলে ছিল, নৈতিক দিক থেকে তারা সে অবস্থান ছিল না। আর উন্নয়নের জোয়ারের দিকে মানুষের যে আকাঙ্ক্ষা ছিল, সেখানে আমাদের যত দুর্বলতাই থাকুক না কেন, সেটা কাটিয়ে ভোটাররা আমাদের বিজয়ী করবে- এটাই আমাদের বিশ্বাস ছিল। হয়তো ১৪ দলীয় জোটের সবায় এমন ধারণায় একমত নাও হতে পারেন।
আরও পড়ুন >> রাজনীতিই সমাজকে বর্বর করে তুলছে
জাগো নিউজ : জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের শপথ না নেয়ার বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
শরীফ নুরুল আম্বিয়া : শপথ নেয়া, না নেয়া তাদের ব্যাপার। আমরা মনে করি, তারা যতটুকু অংশগ্রহণ করার সুযোগ পেয়েছে তাতে তাদের শপথ নেয়া উচিত। সংসদে অংশগ্রহণের যতটুকু সুযোগ তারা পেয়েছে, সেটুকু তাদের ব্যবহার করা উচিত।
জাগো নিউজ : উপজেলা নির্বাচনসহ এ সরকারের অধীনে অন্য কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার ঘোষণা দিয়েছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও বিএনপি। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
শরীফ নুরুল আম্বিয়া : নির্বাচনে যে ঘটনাগুলো ঘটেছে সে ঘটনাগুলোর ফলে মানুষের মধ্যে এক ধরনের বিতৃষ্ণা দেখা দিয়েছে। নির্বাচন নিয়ে মানুষের মাঝে এক ধরনের নির্লিপ্ততা কাজ করছে। এমনকী আমাদের ১৪ দলীয় জোটের মাঝেও উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে একই ধরনের ভাবনা আছে। সেই জায়গা থেকে আমি মনে করি, সরকারের একমাত্র এবং বিশেষ দায়িত্ব হলো মানুষকে নির্বাচনে আনার জন্য সেই পরিবেশটা তৈরি করা।
আমরা সংসদ নির্বাচনে সবাইকে নিয়ে আসলাম কিন্তু স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আনতে পারলাম না- এটা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য সুখকর নয়, ভালো জিনিস নয়। আমরা ১৪ দলের সভায় প্রস্তাব দিয়েছিলাম, স্থানীয় সরকারের সব পর্যায়ের নির্বাচন উন্মুক্ত করে দেয়ার। দলগতভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলে পুরনো সূত্র অনুযায়ী এটা ভালো নির্বাচন হবে না। আমরা মনে করি, স্থানীয় সরকারকে দলভুক্ত না করে দলমুক্ত করা উচিত।
জাগো নিউজ : দলীয় প্রতীকে বা দলগতভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বিরোধিতা করে আপনারা একটা প্রতিবাদ সমাবেশ করেছেন। এ প্রক্রিয়ার নির্বাচনে আপনারা অংশগ্রহণ করবেন কিনা?
শরীফ নুরুল আম্বিয়া : পূর্বের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা মনে করি, বিশেষ করে বিগত ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর পরিস্থিতি দাবি করে যে, স্থানীয় সরকার নির্বাচনটা উন্মুক্ত হওয়া উচিত। আমাদের টেকনিক্যাল সমস্যা আছে, কাজেই আমরা ওইভাবে নিতে পারছি না। মানুষের মাঝে নিষ্ক্রিয়তা আছে আর নেতাকর্মীদের মাঝে আগ্রহ-উদ্যোগটা তেমন দেখা যাচ্ছে না।
জাগো নিউজ : বিগত সরকারে ১৪ দলীয় জোটের শরিকদের মন্ত্রিসভায় স্থান দেয়া হয়েছিল। একাদশ নির্বাচনের পর গঠিত সরকারে জোটের শরিকদের কাউকে মন্ত্রিসভায় নেয়া হয়নি। এটা কি পারফরমেন্সের বিষয়, নাকি অন্য কিছু?
আরও পড়ুন >> স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা রিফর্ম জরুরি
শরীফ নুরুল আম্বিয়া : গতবার দুজন মন্ত্রী ছিলেন। তারা যে ১৪ দলের প্রতিনিধি হিসেবে ছিলেন, এমন নয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাদের পছন্দ করেছিলেন, মন্ত্রিসভায় নিয়েছিলেন। এবারও প্রধানমন্ত্রী যাদের পছন্দ করেছেন তাদের নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করেছেন। এখানে যোগ-বিয়োগের বিষয়টি উনার এখতিয়ারের বিষয়।
আমরা মনে করি, জোটগতভাবে নির্বাচন করেছি। এখানে জোটগত স্বার্থ সবারই আছে, সাংগঠনিক স্বার্থও আছে। দীর্ঘদিন ১৪ দলীয় জোটের একসঙ্গে পথচলার পর আওয়ামী লীগ দলগতভাবে শক্তিশালী হয়েছে, সেটা সংসদে বা অন্যান্য জায়গায়, অন্যান্যভাবে। এখানে অন্য যে দলগুলো আছে তাদের শক্তি বৃদ্ধির পরিবর্তে অবনমন ঘটেছে বা অবনতি হয়েছে।
এইউএ/এমএআর/বিএ