প্রকল্প শেষেও ‘আন্তর্জাতিক’ মানের হচ্ছে না বাণিজ্য মেলা
>> রূপগঞ্জে বাণিজ্য মেলার আন্তর্জাতিক রূপ পেতে লাগবে আরও ১০ বছর
>> ২০ একর জমি বরাদ্দ পেলেও স্থাপনা নির্মাণে লাগবে আরও ১৭ একর
>> ২০২০ সালে নির্মাণকাজ হস্তান্তর, বাকি কাজগুলো করবে বাংলাদেশ
>> পরবর্তীতে কোথায় হবে বাণিজ্য মেলা : মন্ত্রী-সচিবের দুই ধরনের মন্তব্য
রাজধানীর শেরে বাংলা নগরে চলছে ২৪তম ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা। মেলাকে আন্তর্জাতিক রূপ দিতে ২০১৫ সালে চীনের সহায়তায় ৭৯৬ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগামী দুই বছরের মধ্যে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। তবে এখনই তা আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন হচ্ছে না। আরও অন্তত আট থেকে ১০ বছর সময় লাগবে কিংবা লাগতে পারে ২০ বছরও! এতে খরচও বাড়বে।
আরও পড়ুন >> দুই যুগে কতটা সফল ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা?
‘বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশিপ এক্সিবিশন সেন্টার কমপ্লেক্স’ (বিসিএফইসি) নামের এ প্রকল্প নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার ব্রাহ্মণখালীর বাগরাইয়াটেকের ২০ একর জায়গার ওপর বাস্তবায়ন হচ্ছে।
প্রকল্পের কাজ শুরুর পাঁচ বছরের মাথায় গত ২৮ জানুয়ারি (সোমবার) বিসিএফইসির প্রকল্প পরিচালক রেজাউল করিম জাগো নিউজকে বলেন, ‘ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলাকে আন্তর্জাতিক মানের করে নির্মাণ করতে ২০ একর জায়গা যথেষ্ট নয়। লাগবে আরও ১৭ একর।’
“প্রকল্পের মোট ব্যয়ের ৭৯৬ কোটি টাকার মধ্যে চীন সরকার ৬২৫ কোটি এবং বাংলাদেশ সরকার ১৭১ কোটি টাকা দিচ্ছে। বাস্তবায়ন চুক্তি অনুযায়ী, চীন সরকার নির্মাণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে ‘চাইনিজ স্টেট কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশন’ নামের প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেয়।”
চীনা ওই প্রতিষ্ঠানের নির্মাণকাজের অনেক কিছুই বাংলাদেশের মনমতো হচ্ছে না বলেও জানান বিসিএফইসির প্রকল্প পরিচালক রেজাউল করিম।
তিনি বলেন, ‘চীন যে কাজগুলো করছে, তা তাদের ডিজাইন অনুযায়ী। এর অনেক জিনিসই আছে যেগুলো হয়তো আমরা আমাদের মনমতো ব্যবহার করতে পারব না।’
“২০২০ সালের মধ্যে ‘চাইনিজ স্টেট কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশন’র নির্মাণকাজ শেষ হলে পরবর্তী কাজ বাংলাদেশই করবে” বলেও জানান রেজাউল করিম।
তিনি আরও বলেন, ‘চাহিদা অনুযায়ী জমি পেলে সেগুলো আমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী করব। যাতে এটি সম্পূর্ণ আন্তর্জাতিক মানের হয়।’ ইতোমধ্যে ২০ একরের বাইরে আরও ছয় একর জমি এ প্রকল্পের আওতায় বরাদ্দ হয়েছে বলেও জানান তিনি।
বিসিএফইসি প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘২০ একর জমিতে প্রকল্পের কাজ চলছে। আমাদের জায়গার চাহিদা মোট ৩৭ একর। আগে ২০ একর পেয়েছি, পরবর্তীতে আরও ছয় একর দেয়া হয়েছে। সবমিলে এখন আমাদের ২৬ একর জায়গা আছে। আমরা আরও ১২ একর জমি চেয়েছি। এগুলো রাজউক আমাদের কাছে হস্তান্তর করবে।’
প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০ বছরও লাগতে পারে। এখন আমরা যেটা করছি, ২০২০ সালের মধ্যে কাজ শেষ করতে। আবার নতুন পরিকল্পনায় বিভিন্ন ধাপ থাকতে পারে। প্রথম ধাপ সম্পন্ন করতে এটার পর আরও তিন বছর সময় লাগতে পারে। কিন্তু এ এক্সিবিউশন সেন্টারকে পরিপূর্ণভাবে আন্তর্জাতিক রূপ দিতে ২০ বছর নয়, কমপক্ষে আট থেকে ১০ বছর সময় লাগবে।’
আরও পড়ুন >> বাণিজ্য মেলা আগারগাঁওয়েই থাকছে : বাণিজ্যমন্ত্রী
‘আমরা চাচ্ছি, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে একটা ভালোমানের হোটেল এবং আরও কিছু করার। যাতে সম্পূর্ণ ব্যবহার উপযোগী না হলেও মোটামুটি কিছু একটা দাঁড় করাতে পারি’- যোগ করেন প্রকল্প পরিচালক রেজাউল করিম।
২০ দিনে বদলায় ‘তাদের বচন’
গত ৮ জানুয়ারি ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা উদ্বোধন উপলক্ষে মেলা প্রাঙ্গণে সংবাদ সম্মেলন করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো। এতে উপস্থিত ছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, সচিব মো. মফিজুল ইসলাম, রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর ভাইস-চেয়ারম্যান বিজয় ভট্টাচার্যসহ সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
বাণিজ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতে সেদিন সচিব মো. মফিজুল ইসলাম বলেন, ‘পূর্বাচলে বাণিজ্য মেলার বেশির ভাগ অংশেরই কাজ সম্পন্ন হয়েছে। আপনারা দেখতে পাবেন, অচিরেই সেটা শেষ হলে আমরা সেখানে বাণিজ্য মেলার আয়োজন করব।’
তিনি আরও বলেন, ‘সেখানে বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকবে। ডরমেটরি থাকবে, গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা, থাকার ব্যবস্থা থাকবে। আরও কিছু সুযোগ-সুবিধা আমরা বাড়াতে চাচ্ছি। যারা বিদেশ থেকে এখানে এসে পণ্য প্রদর্শন করবেন, সেটাও করার ব্যবস্থা করছি। ২০২০ সালে সবকিছু শেষ হবে বলে আমরা আশা করছি।’
ঠিক ২০ দিনের মাথায় গত রোববার (২৭ জানুয়ারি) বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, ‘ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা আপাতত আগারগাঁওয়েই হবে। পূর্বাচলে (রূপগঞ্জ) মেলা হবে, তবে তা বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে। শহরের বাইরে তো ওটা, যার কারণে ওখানে যথেষ্ট পরিমাণ জায়গা রেডি হয় নাই, অত জায়গাও নাই। নতুন যে জায়গাটা (রূপগঞ্জে) হবে সেখানে সারা বছর ধরে রফতানিমুখী পণ্য প্রদর্শন হবে। তবে বাণিজ্য মেলা আপাতত আগারগাঁওয়েই অনুষ্ঠিত হবে।’
‘অভিযোগ রয়েছে, বাণিজ্য করতে ইপিবি নিজেই চায় না বাণিজ্য মেলাটা পূর্বাচলে হোক’- এমন অভিযোগের জবাবে গত ৮ জানুয়ারি বাণিজ্য সচিব বলেছিলেন, ‘রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো চায় না পূর্বাচলে বাণিজ্য মেলা যাক, আমার মনে হয় এটা ঠিক নয়। একদমই ঠিক নয় যে, এটা বাণিজ্য করার জন্য…। কারণ আপনারা দেখতে পাবেন, অচিরেই সেটা (নির্মাণকাজ) শেষ হলে আমরা সেখানে বাণিজ্য মেলার আয়োজন করব।’
সরেজমিন যা দেখা গেল
কুড়িল বিশ্বরোড থেকে বিআরটিসি বাসে ২৫ টাকা ভাড়ায় যাওয়া যায় নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার পূর্বাচল অংশের কাঞ্চন ব্রিজ পর্যন্ত। এখান থেকে বরাবর পাঁচ থেকে সাত মিনিট হাঁটলেই পাওয়া যাবে বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশিপ এক্সিবিশন সেন্টার কমপ্লেক্সের অবস্থান।
গত ২৪ জানুয়ারি (বৃহস্পতিবার) সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, প্রকল্পের কাজ যে চীনা প্রতিষ্ঠান করছে সেটার ছাপ স্পষ্ট। প্রকল্পের দেয়ালে লেখা চাইনিজ ভাষা। প্রধান ফটকে চাইনিজ ভাষার পাশাপাশি তুলনামূলক বেশ ছোট হরফে ইংরেজি লেখা।
আরও পড়ুন >> কর ফাঁকি দিচ্ছে বাণিজ্য মেলার অর্ধেক প্রতিষ্ঠান!
প্রধান ফটকে নিরাপত্তার দায়িত্বে একজন বাঙালি। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে প্রকল্পের ভেতর প্রবেশ করতে চাইলে তিনি জানান, অনুমতি ছাড়া প্রবেশ করতে দেয়া হবে না। পাশের দেয়ালে সাঁটানো প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের ছবি ও ফোন নম্বর দেখিয়ে তিনি বললেন, ‘এদের অনুমতি লাগবে।’ যাদের অনুমতি লাগবে বলা হলো তারা সবাই চীনা নাগরিক।
নিরাপত্তাকর্মী জানান, তাদের কেউই বাংলা বা ভালো ইংরেজি জানেন না। তাদের মধ্যে প্রকল্পের প্রকৌশলী হু বো হাঙ’কে ফোন করা হলেও ভাষা জটিলতায় যোগাযোগ সফল হয়নি।
নির্মাণাধীন প্রকল্পের পুরোটাই দেয়াল দিয়ে ঘেরা। তবে এর পেছনের দিকে গিয়ে দেখা যায়, দুজন বাংলাদেশি টিনের দেয়াল দিচ্ছেন। তারা জানান, প্রকল্পের দেয়াল ভেতরের দিকে। দেয়ালের বাইরে প্রকল্পের যে অংশটুকু রয়েছে, সেখানে টিনের বেড়া দেয়া হচ্ছে।
চারপাশ ঘুরে দেখা যায়, কাঞ্চন ব্রিজ থেকে এগোতে থাকলে রাস্তার ডান পাশে এ প্রকল্পের অবস্থান। যেখান থেকে প্রকল্পের শুরু, মূলত মূল রাস্তার সেই অংশ দিয়ে একটি সরু রাস্তা বেরিয়ে গেছে। এ সরু রাস্তা যেখানে গিয়ে বামে মোড় (এক) নিয়েছে, ওই পর্যন্ত প্রকল্পের জমি। বামে মোড় নেয়া রাস্তা দিয়ে সোজা এগোতে থাকলে রাস্তাটি আবার বামে মোড় (দুই) নেয় (প্রকল্পের জমি শেষ)।
বামে মোড় নেয়া সরু রাস্তাটি মূল সড়কে গিয়ে ঠেকেছে। মূল রাস্তা বরাবর প্রকল্পের জমির পাশ দিয়ে অল্প দূর এগোলেই বাউন্ডারি আর চোখে পড়বে না। বর্গাকৃতি জমির ভেতর পর্যন্ত বেশ খানিকটা জায়গা ছেড়ে দিয়ে মূল প্রকল্পের দেয়াল। ছেড়ে দেয়া জায়গায় কৃষিকাজ, কবরস্থান ও মসজিদ রয়েছে। এলাকাবাসী জানান, এই দাগের জমিটুকু প্রকল্পের বাইরে।
এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক রেজাউল করিম বলেন, ‘কবর বলেন, আর ফাঁকা জায়গা বলেন; এগুলো রাজউক আমাদের কাছে হস্তান্তর করবে।’
পিডি/এমএআর/জেআইএম