গবেষণায় মন নেই, বাণিজ্যে ব্যস্ত এনসিটিবি!
জাতীয় পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) মূল কাজ হচ্ছে, প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যক্রম নিয়ে গবেষণা ও সৃজনশীল পাঠ্যবই শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেয়া। কারিকুলাম নিয়ে গবেষণা ও পাঠ্যবই তৈরির পরিবর্তে এ প্রতিষ্ঠানের (এনসিটিবি) এখন মূল কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে কেনাকাটা ও পাঠ্যবই নিয়ে বাণিজ্যের অংশীদার হওয়া। ফলে গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি এখন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
জানা গেছে, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে রূপ নেয়ায় এনসিটিবি তার মূল চরিত্র হারিয়ে এখন অনিয়ম-দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। সেখানে গড়ে উঠেছে নানামুখী সিন্ডিকেট। এ সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে কর্মচারীরাও।
জাতীয় পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) ২০১৭ সালের কার্যক্রম নিয়ে পরিচালিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে এমনটাই বলেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সিন্ডিকেটের খপ্পরে পড়ে খোদ সরকারকেও কোটি কোটি শিক্ষার্থীর পাঠ্যবইয়ের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে তাদের সঙ্গে সমঝোতা বা তাদের চাহিদা ও দাবির কাছে নতিস্বীকার করতে বাধ্য হতে হচ্ছে। এমন ঘটনা ঘটেছে চলতি বছরের প্রাথমিকে পাঠ্যবই ছাপার পুনঃটেন্ডার করতে গিয়ে। পুনঃটেন্ডার করে প্রাথমিকের পাঠ্যবই বিদেশে ছাপাতে হয়েছে। অথচ দেশীয় মুদ্রাকররা এর তীব্র বিরোধিতা করলেও এনসিটিবির শীর্ষপর্যায় থেকে ছাপার কাজ বিদেশিদের হাতে তুলে দেয়ার জন্য সব ধরনের নাটক সাজানোর অভিযোগ রয়েছে। এমনকি টেন্ডারের শর্ত ও বিধি লঙ্ঘন করে এ কাজ করা হয়েছে।
এনসিটিবির সামগ্রিক চরিত্র ও কর্মকাণ্ড সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও ভাষা বিজ্ঞানী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. জীনাত ইমতিয়াজ আলী বলেন, ‘এনসিটিবি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নয়। এটি একটি রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান। এখানে শিক্ষাবিদরা শিক্ষার্থীদের পাঠ্যক্রম ও কারিকুলাম নিয়ে গবেষণা করবে। নতুন নতুন ধারণা ও সৃজনশীল মেধা দিয়ে শিক্ষাবিদদের পরামর্শ অনুসারে কারিকুলাম সাজাবে। পৃথিবী অনেক দূর এগিয়ে গেছে, কিন্তু আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ও কারিকুলাম এখনও সেকেলে।’
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘এনসিটিবি প্রতি বছর পাঠ্যবই ছাপার বাণিজ্যের সঙ্গে নিজেদের জড়িয়ে ফেলেছে। অথচ তাদের দায়িত্ব ছিল, কয়েক বছর পরপরই পাঠ্যবইয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন কিছু দেয়া। এনসিটিবি পাঠ্যপুস্তকের গবেষক ও শিক্ষাবিদদের নিয়ে বৈঠক না করে, বৈঠক করছে বই ছাপার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে।’
শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও এনসিটিবি সূত্রে জানা গেছে, সর্বশেষ ২০১২ সালে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যবইয়ের কারিকুলাম পরিবর্তন করা হয়। ২০১৩ সালে তা পাঠ্যবইয়ে সংযুক্ত করা হয়। এর আগে হয়েছিল ১৯৯২ সালে। পাঠ্যবইয়ের কারিকুলামের পরিবর্তন আগামীতে কবে হবে- তা নিয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত নেই নীতিনির্ধারক মহলে।
এদিকে প্রতিষ্ঠানটির (এনসিটিবি) শীর্ষ এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাগো নিউজকে বলেন, ‘নতুন সরকারের শিক্ষামন্ত্রী ও উপমন্ত্রী কারিকুলাম পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিয়েছেন। তাই ধারণা করা হচ্ছে, আগামী ২/১ বছরের মধ্যে কিছু একটা হতে পারে। কী হবে, সেটা নির্দেশনা পাওয়ার পর জানা যাবে।‘
এনসিটিবির প্রশাসনিক বিন্যাস সম্পর্কে নানা কথা প্রচলিত থাকলেও, এখানে যারা নিয়োগ পান তারা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের আত্মীয়-স্বজন বলেই পরিচিত। এছাড়া রয়েছে প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপিদের তদবিরে পদায়ন। কারিকুলাম বিশেষজ্ঞ, গবেষণা কর্মকর্তাসহ নানা পদে যারা নিয়োজিত তাদের কারোরই অতীত কোনো অভিজ্ঞতা নেই।
এখানে রয়েছেন অর্থনীতিতে পাস করা কর্মকর্তা, যিনি প্রাথমিকের বাংলা বইয়ের সম্পাদনা করেন। এভাবে জগাখিচুড়ি দিয়ে চলছে বছরের পর বছর। সরকার পরিবর্তন হলে শুধু বদলায় এর কর্মকর্তা। গত তিন দফায় একই সরকার ক্ষমতায় থাকায় এবং টানা দুই মেয়াদে একই ব্যক্তি শিক্ষামন্ত্রী থাকায় এখানে গড়ে উঠেছে বড় ধরনের অনিয়মের সিন্ডিকেট।
টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, প্রতিষ্ঠানটিতে বর্তমানে জুনিয়র কর্মকর্তার শাসন কায়েম হয়েছে। উপ-সচিব (কমন) ও ঊর্ধ্বতন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে ২৪তম বিসিএস কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এ দুটি পদে এর আগে অপেক্ষাকৃত সিনিয়র কর্মকর্তাদের পদায়ন করা হতো। উৎপাদন নিয়ন্ত্রক পদেও অপেক্ষাকৃত জুনিয়র কর্মকর্তা পদায়ন পেয়েছেন। বিদায়ী শিক্ষামন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ এবং তার সাবেক এপিএস মন্মথ রঞ্জণ বাড়ৈর নেতৃত্বাধীন সিন্ডিকেট এখনও সক্রিয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
জানা গেছে, এখানে (এনসিটিবি) কর্মরতদের বেশির ভাগই বছরের পর বছর একই পদে চাকরি করছেন। বিতরণ নিয়ন্ত্রক জিয়াউল হক, ঊর্ধ্বতন ভাণ্ডার কর্মকর্তা আবু হেনা মাশুকুর রহমান, ঊধ্বর্তন বিশেষজ্ঞ মোখলেস উর রহমান, বিশেষজ্ঞ পারভেজ আক্তারসহ অধ্যাপক হাসমত মনোয়ার, আলেয়া আক্তার, মোস্তফা সাইফুল আলম, সৈয়দ মাহফুজ আলী, চৌধুরী মুসাররাত হোসেন জুবেরী, সাহানা আহমেদ প্রমুখ সর্বনিম্ন ছয় বছর থেকে একযুগ পর্যন্ত একই পদে এবং একই কর্মস্থলে কর্মরত। প্রতিষ্ঠানটিতে ক্যাডার কর্মকর্তা আছেন মোট ৬১ জন। বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা হিসেবে মূল চাকরি কলেজে শিক্ষকতা। কিন্তু তারা লেকচারার হিসেবে যোগদান করে এখনও একই প্রতিষ্ঠানে থেকে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেয়েছেন।
মন্ত্রণালয় ও এনসিটিবি সূত্র জানায়, কারিকুলাম গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে কখনোই রূপ পায়নি এটি। এখানে যাদের পদায়ন করা হয় গবেষণা কর্মকর্তা হিসেবে, তাদের কারোরই গবেষণার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। এখানে নিয়োজিত গবেষণা কর্মকর্তারা এখন কাজ করেন ছাপাখানায় বই ছাপা কেমন হচ্ছে তা তদারকিতে। ছাপা হওয়া বই ঠিক মতো ট্রাকে উঠছে কিনা, তার নজরদারিতে।
এনসিটিবির এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, গবেষণার পরিবর্তে আমার কাজ হচ্ছে প্রতিদিন মুদ্রাকরদের সঙ্গে দেন-দরবারে ব্যস্ত থাকা, তাদের সঙ্গে ঝগড়া মেটানো। কারিকুলাম নিয়ে মনসংযোগের ফুরসত কোথায়?
এ ব্যাপারে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, ‘এনসিটিবি গবেষণা বাদ দিয়ে শুধু বইছাপা ও সরবরাহের কাজে নিয়োজিত রয়েছে, এমনটি নয়। এনসিটিবির আইন ও বিধিমালার মধ্যেই রয়েছে বইছাপা ও সরবরাহের কাজ। আর কারিকুলাম নিয়ে গবেষণা হচ্ছে না, এটিও সঠিক নয়। প্রাথমিকের পাঠ্যবই রিভিউয়ের কাজ শেষ হয়েছে। সেই সঙ্গে মাধ্যমিকেরও কাজ চলছে।’
এমএইচএম/এমএমজেড/এমএআর/এমকেএইচ