একটি পোস্টারে ‘তারুণ্যের জয়’
রাজধানীর নিউ মার্কেট সংলগ্ন ঢাকা কলেজের আশপাশের দেয়ালে সবসময় নানা ধরনের পোস্টার লাগানো থাকে। ‘বাসা ভাড়া’, ‘রুম ভাড়া’, ‘সিট খালি’, ‘পড়াতে চাই’- এমন বাহারি পোস্টারে ছেয়ে থাকে দেয়ালগুলো। রাজধানীজুড়ে এমন পোস্টার প্রায়শ সবার চোখে পড়ে।
কিন্তু ঢাকা কলেজের আশপাশে সাঁটানো 'পড়াতে চাই' পোস্টার দেখে যে কেউ একটু হলেও যেন থমকে যান। পোস্টারটি দ্বিতীয়বার এমনকি তৃতীয়বারও কেউ কেউ পড়ে দেখেন। পোস্টারটি যিনি দেয়ালে লাগিয়েছেন তার প্রতি কেন জানি আলাদা একটা শ্রদ্ধাবোধ ও ভালোবাসা এমনিতেই চলে আসে।
আরও পড়ুন >> ‘সন্তানের জন্য কোনো কষ্টই কষ্ট না’
কারণ সেই পোস্টারের নিচে লেখা, ‘দরিদ্র ও মেধাবী দুজন ছাত্র/ছাত্রীকে পড়াতে চাই’। (২য়-৭ম শ্রেণী; সকল বিষয়)। একটু বড় করেই লেখা আছে ‘বিনা পারিশ্রমিকে’। যোগাযোগ : আবীর হাসান আকাশ। বিএসসি (অনার্স), ঢাকা কলেজ। এরপর যোগাযোগের জন্য দেয়া আছে ফোন নম্বর।
পোস্টারটি সবাইকে আকৃষ্ট করেছে। ‘বিনা পারিশ্রমিকে’- এ শব্দ দুটিই আবীর হাসান আকাশের পোস্টারকে অন্যসব পোস্টার থেকে আলাদা করে দিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও ছড়িয়ে পড়েছে ছবিটি।
আগ্রহের জায়গা থেকে পোস্টারে দেয়া আবীর হাসান আকাশের মোবাইল নম্বরে যোগাযোগ করা হয়। নিজের এমন মহতী উদ্যোগের বিষয়ে কথা হয় তার সঙ্গে।
আবীর হোসেন আকাশ ঢাকা কলেজের মনোবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। ঢাকা কলেজের দক্ষিণ ছাত্রাবাসে (হোস্টেলে) থাকেন তিনি। বাড়ি গোপালগঞ্জ সদরে। ব্যবসায়ী বাবার সন্তান আবীর হোসেন আকাশ। বলেন, ‘ছোট বেলা থেকেই দরিদ্র, অসহায়, বঞ্চিত ও অভাবী মানুষের প্রতি কেন জানি আলাদা ভালোবাসা কাজ করে। তাদের জন্য কিছু করতে ইচ্ছে করে সবসময়। নিজের চলার টাকা জমিয়ে এই শীতে ১০টি কম্বল হতদরিদ্রদের মাঝে বিতরণ করেছি। এই তো কদিন আগেও এতিম এক মাদরাসা শিক্ষার্থীকে পাঞ্জাবি বানিয়ে দিয়েছি।’
আরও পড়ুন >> ছেলে বিসিএস ক্যাডার, অনাহারে মরতে বসলেন মা
‘আমার অনেক বন্ধু আছে যারা আর্থিক সমস্যার কারণে পরীক্ষার ফরম ফিলাপ করতে পারেন না। সেক্ষেত্রে নিজের বাড়ি থেকে টাকা এনে তাদের ফরম ফিলাপ করতে সহযোগিতা করি। সামান্য এ সহযোগিতায় তাদের মুখে যে হাসি দেখেছি, লাখ টাকা খরচ করেও এমন তৃপ্তি পাওয়া যায় না।’
কার কাছ থেকে এমন অনুপ্রেরণা পেয়েছেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এমন কাজে মা-ই আমাকে অনুপ্রাণিত করেন। ভালো কাজে সবসময় তিনি আমাকে সাপোর্ট দিয়ে আসছেন।’
‘পরিবারে সচ্ছলতা আছে, প্রাইভেট পড়িয়ে চলতে হবে- এমন পরিস্থিতি আমার নেই। সেজন্যই এমন উদ্যোগ নিয়েছি’- যোগ করেন তিনি।
আবীর হাসান আকাশ বলেন, ‘এই ঢাকা শহরে গরীব ও অসচ্ছল ফ্যামিলিতে অনেক শিক্ষার্থী আছে যারা খুবই মেধাবী। কিন্তু অর্থের অভাবে ভালো প্রতিষ্ঠানে বা প্রাইভেট পড়তে পারে না। সবাই তো প্রাইভেট পড়িয়ে অনেক টাকা নেয় কিন্তু আমার চলতে তো টাকার দরকার নাই, পরিবার থেকেই সেই টাকা পাই। এ কারণে সিদ্ধান্ত নেই, যেহেতু হাতে সময় আছে তাই দরিদ্র পরিবারের দুই মেধাবী শিক্ষার্থীকে বিনা পারিশ্রমিকে পড়াব। এমন আগ্রহ থেকে কয়েকটি পোস্টার ঢাকা কলেজের আশপাশে লাগায়।’
তিনি বলেন, পোস্টার লাগানোর পর অসংখ্য কল আসে। অনেকে তাদের ছেলে-মেয়েদের পড়ানোর জন্য অনুরোধ জানান। এর বাইরে অসংখ্য মানুষ এমন উদ্যোগ নেয়ায় আমাকে ধন্যবাদ, ভালোবাসা ও অনুপ্রেরণা দেন।
বিনা পারিশ্রমিকে পড়ানোর জন্য শিক্ষার্থী খুঁজে পেয়েছেন কিনা- জানতে চাইলে আবীর হাসান আকাশ বলেন, ইতোমধ্যে ১০/১২টি বাসায় আমি নিজে গিয়ে দেখে এসেছি। যাচাই-বাছাইয়ের পর দুই শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট পড়ানোর জন্য বেছে নিয়েছি। একজন চা বিক্রেতা এবং অন্যজন আইসক্রিম বিক্রেতার ছেলে। তাদের প্রতি সপ্তাহে তিন-চারদিন করে পড়াতে যাব।
আরও পড়ুন >> নিজের মায়ের নামে ‘পাগলির সন্তানের’ নাম রাখলেন ওসি
এদিকে আবীর হাসান আকাশের দেয়ালে লাগানো পোস্টারের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়। নানা প্রশংসায় ভাসেন আকাশ। জুয়েল সরকার নামে একজন তার টাইম লাইনে ছবিটি পোস্ট দিয়ে লেখেন, ‘জয় তারুণ্যের জয়, মানবতা বেঁচে থাকুক আপনার মতো শত কোটি তরুণের মাঝে। স্যালুট ব্রাদার।’
শতাব্দী জুবায়ের নামে আরেকজন লেখেন, ‘ব্যাপারটা দারুণ। এভাবেই পরিবর্তন আসুক মননে।’
এএস/এমএআর/আরআইপি