প্রশ্নবিদ্ধ রিজভী!
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী আহমেদের ‘ঝটিকা মিছিল’ নিয়ে দলটির নগর নেতাদের মধ্যে ‘অস্বস্তি’ দেখা দিয়েছে। এসব কর্মসূচি থেকে বিরত থাকতে রিজভীর প্রতি আহ্বানও জানিয়েছেন তারা।
গত বছর ৮ ফেব্রুয়ারি দলীয়প্রধান বেগম খালেদা জিয়া কারাবন্দি হওয়ার পর ওই বছর ১০ মার্চ ভোর সাড়ে ৬টায় নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনের সড়কে রিজভীর নেতৃত্বে বিক্ষোভ মিছিল হয়। নির্দলীয় সরকারের অধীনে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ মিছিলটি হয় বলে কেন্দ্রের দফতর থেকে গণমাধ্যমে প্রেস বিজ্ঞপ্তি পাঠানো হয়। তারপর থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত ২০টি বিক্ষোভ মিছিল করেছেন রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে। রিজভীর এসব বিক্ষোভ গণমাধ্যমে ‘ঝটিকা মিছিল’ হিসেবে প্রচার পায়।
এসব মিছিলের অধিকাংশই নয়াপল্টন ও এর আশপাশের সড়কে হলেও গুলশান, মিরপুর, কল্যাণপুর, ধানমন্ডি, বাংলামোটর সড়কে রিজভীর নেতৃত্বে মিছিল হয়।
চলতি বছরের ১১ জানুয়ারি রাজধানীর ফকিরাপুল এলাকায় খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে রিজভীর নেতৃত্বে বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। এতে হাতোগোনা ২০/২৫ নেতাকর্মীর উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেলেও তারা কোন সংগঠনের এবং কোন ইউনিটের সে বিষয়ে দায়িত্বশীলরা কিছুই বলতে পারেননি।
সর্বশেষ শুক্রবার একই দাবিতে রুহুল কবির রিজভী রাজধানীর বাটা সিগন্যালে ‘ঝটিকা মিছিলের’ নেতৃত্ব দেন। বিএনপির সহ-দফতর সম্পাদক মো. মনির হোসেনের পাঠানো এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিএনপি চেয়ারপারসনের মুক্তির দাবিতে রাজধানীর বাটা সিগন্যাল সড়কে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদের নেতৃত্বে শুক্রবার দুপুর ১২টার দিকে এক বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল আয়োজিত এই মিছিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অংশ নেন। এ সময় তারা খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে মুহুর্মুহু স্লোগান দেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিভিন্ন সময় রিজভীর বিক্ষোভ মিছিলে উল্লেখযোগ্য নেতাদের মধ্যে দলটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য আমিনুল ইসলাম, নিপুন রায় চৌধুরী (বর্তমানের কারাবন্দি) এবং ঢাকা জেলা বিএনপির নেতা খন্দকার আবু আশফাকের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে।
রিজভীর এসব বিক্ষোভ মিছিলের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা মহানগর নেতাদের মধ্যে প্রচণ্ড অস্বস্তি লক্ষ্য করা গেছে। নগর বিএনপির এক নেতা নাম প্রকাশ না করে বলেন, রিজভী আহমেদ দলের যে পদে রয়েছেন সে পদে থেকে রাজপথে বিক্ষোভ মিছিলের নামে যে কর্মসূচি পালন করছেন তা মূলত খেয়ালিপনা ছাড়া কিছুই নয়। কর্মসূচি তিনি করতেই পারেন, কিন্তু যে এলাকায় কর্মসূচি পালন করবেন সেই এলাকার বিএনপি এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনসমূহের নেতাদের জানিয়ে করতে পারতেন। তাহলে সংশ্লিষ্ট থানা বা ইউনিটের দায়িত্বশীল নেতাদের অস্বস্তিতে পড়তে হতো না। ওনার কর্মসূচিতে আরও বেশি নেতাকর্মীর উপস্থিতি থাকা উচিত।
পল্টন এলাকায় সবচেয়ে বেশি বিক্ষোভ মিছিল করেছেন রিজভী আহমেদ। তার এ কর্মসূচি সম্পর্কে পল্টন থানা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ফিরোজ আলম পাটোয়ারী জাগো নিউজকে বলেন, ‘সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী আহমেদ পল্টন এলাকায় যেসব কর্মসূচি পালন করেছেন সেসব সম্পর্কে আমরা অবগত নই। অবগত হলে নিশ্চয়ই আমরা কর্মসূচিতে অংশ নিতাম। সরকার আমাদের মাকে সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে, অন্যায়ভাবে আটকে রেখেছে। বিক্ষোভ মিছিলের বিষয়টি আমরা জানলে অবশ্যই কর্মসূচিতে থাকতাম।’
শাহবাগ থানা কৃষক দলের সভাপতি এম জাহাঙ্গীর আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘রিজভী ভাই প্রেস ক্লাব এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল করেছেন কিন্তু আমরা জানি না। উনি দলের সিনিয়র নেতা, ওনার মিছিলের খবর জানলে অবশ্যই আমাদের নেতাকর্মীরা তাতে অংশ নিত।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পল্টন থানা বিএনপির এক নেতা বলেন, ‘সিনিয়র নেতাদের মর্নিং ওয়াকের নামে এসব কর্মসূচি জুনিয়র নেতাদের জন্য বিব্রতকর। রিজভী আহমেদের ঘনিষ্ঠরা বলে থাকেন যে, প্রতিবাদ যেকোনো স্থানে যেকোনোভাবে হতে পারে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কারণে তিনি সংশ্লিষ্ট ইউনিটের দায়িত্বশীল নেতাদের তার কর্মসূচির খবর জানাতে পারেন না। আমি মনে করি, এসব কথাবার্তায় এটাই প্রকাশ পায় যে, তিনি নেতাকর্মীদের বিশ্বাস করেন না অথবা তার প্রতি নেতাকর্মীদের আস্থা নেই। এ কারণে রিজভী ভাই এসব করেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিএনপি তো কোনো গোপন বা নিষিদ্ধ সংগঠন নয়। তাহলে রিজভী ভাইকে কাকডাকা ভোরে মিছিল করতে হবে কেন? নগরের অধিকাংশ বাসিন্দা থাকেন ঘুমে, ওই সময় রাস্তায় কিছু কুকুর দেখা যায়। উনি যে ভোরবেলা মিছিল করেন তখন তো ইবাদত-বন্দেগির সময়। বিএনপি তো ধর্মীয় মূল্যবোধে বিশ্বাসী, তাহলে ওনার মিছিল জনগণের কাছে কী বার্তা দেয়? এসব বিষয় ওনার বিবেচনা করা উচিত।’
আদাবর বিএনপির এক নেতা বলেন, ‘বিএনপি বা আওয়ামী লীগের মতো বড় দলে বিভিন্ন ধরনের লোক থাকে যাদের ক্রিয়েটিভ লিডার বলা হয়। গ্রেফতার এড়াতে একবার রিজভী ভাই হাসপাতাল থেকে পালিয়েছিলেন; দফতরের দায়িত্বে থেকে নয়াপল্টনের কার্যালয় থেকে পালিয়েছিলেন- এটা ওনার যেমন ক্রিয়েটিভিটি, বিক্ষোভ মিছিলও তেমনি ওনার ক্রিয়েটিভিটি। এটা নিয়ে নেতাদের কেউ কেউ বলছেন, বিশেষ মহলের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছেন রিজভী ভাই। নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ের বাইরেও তিনি যে সক্রিয় রয়েছেন সেটি দেখাতে তার এই ঝটিকা মিছিল! হয়তো অনুকম্পা পাওয়ার আশায়, হয়তো দলের মহাসচিবের পদ পাওয়াই তার লক্ষ্য; নয়তো স্থায়ী কমিটিতে জায়গা পাওয়া- তিনিই সেটা ভালো জানেন।’
রিজভী আহমেদের সংবাদ সম্মেলনে নিয়মিত উপস্থিত থাকেন কৃষক দলের বহিষ্কৃত নেতা শাহাজান মিয়া সম্রাট। এ বিষয়ে তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যেকোনোভাবেই প্রতিবাদ হতে পারে। তবে সংশ্লিষ্ট ইউনিটের নেতাদের জানানো উচিত এবং ভবিষ্যতে হয়তো জানানো হবে।’
রিজভীর বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে নগর নেতাদের অস্বস্তির বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কাজী আবুল বাশার বলেন, ‘রিজভী ভাই কর্মসূচি পালন করেন। আমি ওনার কাছের মানুষ। ওনার এ বিষয়টি নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না।’
কেএইচ/জেডএ/এমএআর/এমএস