স্থান একজনের, ঘুমাচ্ছেন ৩ বন্দি
মাদকবিরোধী নিয়মিত অভিযান, নাশকতা ও ভাঙচুর মামলায় পাইকারি গ্রেফতার; সব মিলিয়ে ধারণক্ষমতার তিনগুণ বেশি বন্দি রয়েছে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। কারা কর্তৃপক্ষের কেউ স্বীকার না করলেও রাতের ঘুম ও খাওয়া-দাওয়ায় বেশি সমস্যা হচ্ছে তাদের।
কারা অধিদফতরের সহকারী মহা-পরিদর্শক (এএইজি-অ্যাডমিন) মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মামুন জাগো নিউজকে বলেন, কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে মোট চার হাজার ৫৯০ বন্দির ধারণক্ষমতা রয়েছে। গত ১৪ জানুয়ারি পর্যন্ত এখানে বন্দি ছিলেন ১১ হাজার ১৭২ জন।
অতিরিক্ত বন্দির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সাধারণত তারা (ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার কর্তৃপক্ষ) ম্যানেজ করতে পারছেন বলে জানি।’
শুধু ঢাকায় নয়, সারাদেশের কারাগারে বন্দির সংখ্যা স্বাভাবিকের তুলনায় প্রায় আড়াইগুণ। অধিদফতর জানায়, দেশের ১৩টি কেন্দ্রীয় ও ৫৫ জেলা কারাগারে মোট ধারণক্ষমতা ৩৬ হাজার ৭১৪ জনের। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার কারাগারগুলোতে বন্দির সংখ্যা ছিল প্রায় ৯০ হাজারের মতো। এছাড়া নারী বন্দিদের সঙ্গে রয়েছে তাদের শিশু সন্তানও (ছয় বছরের নিচে)।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার সূত্রে জানা গেছে, আগে এখানে প্রতিদিন গড়ে ছয় থেকে সাত হাজার বন্দি থাকত। তবে গত নয় মাস ধরে মাদকবিরোধী অভিযান, ভাঙচুর, নাশকতা ও বিস্ফোরক আইনে মামলার কারণে এ সংখ্যা বাড়তে থাকে। সর্বশেষ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বন্দির সংখ্যা ১১ হাজারের মতো ছিল। ওই সময় আদালত বন্ধ থাকায় আসামিদের জামিন না হওয়া, মামলার তদন্তে ধীরগতি এবং বিচারের দীর্ঘসূত্রিতার কারণে বন্দীদের সংখ্যা বেড়ে যায়।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার মাহবুব আলম বলেন, বন্দিদের মধ্যে ৭০ থেকে ৮০ ভাগ আসামি মাদক মামলায় গ্রেফতার, বাকিরা অন্যান্য অপরাধে।
জাতীয় সংসদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দেয়া সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, মাদকবিরোধী অভিযানে জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৬২ হাজার ৪৪৭টি মামলায় ৮৩ হাজার ৩২৩ মাদকব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এছাড়া বিএনপির দাবি, বিস্ফোরকদ্রব্য আইন, হামলা, ভাঙচুরসহ বিভিন্ন মামলায় নভেম্বর থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত তাদের তিন হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এ কারণেই ঠাঁই মিলছে না কারাগারগুলোতে।
এদিকে কারাগারে অতিরিক্ত বন্দি থাকায় নানা অনিয়ম ও দুর্ভোগের অভিযোগ পাওয়া গেছে। জাগো নিউজের সঙ্গে কথা হয় মাদক মামলায় সাত মাস এবং নাশকতার মামলায় চার মাস কারাভোগ করে সদ্য জামিনে মুক্ত দুই বন্দীর সঙ্গে। তাদের একজন বলেন, ভেতরে বন্দিদের অতিরিক্ত চাপের কারণে দুপুর ও রাতের খাবার পরিবেশনে বিলম্ব হচ্ছে। রাতে ঘুমানো ও গোসলের সময়ও কষ্ট হয়।
অপরজন বলেন, আগে থেকেই স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতে অনেক ভোগান্তি পোহাতে হতো। এখন সেটি আরও বেড়েছে। এখন স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতে সারাদিনই পার হয়ে যায়।
তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন সময় এখান থেকে কাশিমপুরের কারাগারে আসামি পাঠানো হয়। কিন্তু কেরানীগঞ্জ কারাগারের চাপটা এখনও কমেনি। পয়ঃনিষ্কাশনে প্রতিনিয়ত সমস্যায় পড়তে হয়।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক প্রতিবেদনে যথাসময়ে খাবার পরিবেশন করতে না পারায় বন্দিদের অসন্তোষের বিষয়টি উঠে এসেছে। এছাড়া অতিরিক্ত বন্দির কারণে সাক্ষাতে বিশৃঙ্খলা ও বিড়ম্বনার বিষয়টিও প্রতিবেদনে উঠে আসে। এতে বন্দী ও স্বজনদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
জেল কোড অনুযায়ী, প্রতি বন্দির থাকার জন্য ছয় ফিট দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ অর্থাৎ ৩৬ স্কয়ার ফিট জায়গা থাকার কথা। তবে সদ্য কারামুক্তদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বন্দির জন্য বরাদ্দকৃত নির্ধারিত ওই স্থানে এখন তিনজন করে অবস্থান করছেন। ফলে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে তাদের।
বিষয়টি স্বীকার করলেও এটি ‘স্বাভাবিক’ বলে মন্তব্য করেন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার মাহবুব আলম। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, “অনেকেই বলেন, কারাগারে ঠাঁই নেই, কথাটি ঠিক নয়। কারণ কারাগারের ‘রূপসা’ নামের একটি ভবন এখনও খালি রয়েছে। প্রয়োজন হলে সেখানে বন্দিদের স্থানান্তর করা হবে।”
‘জেল কোড অনুযায়ী একজন বন্দিকে ৩৬ স্কয়ার ফিট জায়গা দেয়ার বিধান থাকলেও ওই স্থানে অনায়াসে তিন বন্দি থাকতে পারেন। এটাই বাস্তবতা। কারাগারের ধারণক্ষমতা চার হাজার ৫৯০ হলেও এখানে তিনগুণ বেশি বন্দি থাকতে পারেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখন আদালতের কার্যক্রম শুরু হয়েছে, আসামিরা জামিনও পাচ্ছেন। অনেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন। আবার অনেককে কাশিমপুর কারাগারে পাঠানো হচ্ছে। আপাতত কারাগারে কোনো সমস্যা নাই।’
বন্দিদের খাওয়া-দাওয়ার সমস্যার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘তাদের তেমন কোনো সমস্যা হচ্ছে না।’
‘কারাগারে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে’- ২০১৬ সালের আগস্টে বিভিন্ন গণমাধ্যমে এমন খবর পরিবেশন হলে একই মাসের ২৩ তারিখ কারাগার পরিদর্শনে যান মানবাধিকার কমিশনের চেয়ামান কাজী রিয়াজুল হক। আড়াই বছর আগে তিনি কারা কর্তৃপক্ষের নানা অসঙ্গতি সংশোধন করে বন্দিদের মানবাধিকার রক্ষার কথা বলেন। তবে অতিরিক্ত বন্দির কারণে সেগুলোর অনেক কিছু এখনও বাস্তবায়িত হয়নি।
এ বিষয়ে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘কারাগারের ধারণক্ষমতার মধ্যেই বন্দিদের থাকার কথা। সাড়ে চার হাজার ধারণক্ষমতার কারাগারে এত বন্দি রাখা কোনোভাবেই যুক্তিসঙ্গত নয়। এতে বন্দিদের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অধিকার আমাদের কারও নেই।’
‘তারা কারাবন্দি, এখনও দোষী নয়। তাছাড়া দোষী হলেও তার মানবাধিকার থাকে। অতিরিক্ত বন্দি থাকায় খাওয়া-দাওয়া, থাকা, গোসল ও বাথরুমের সমস্যা হয়। সরকারের এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া উচিত।’
তিনি আরও বলেন, ‘কারাগারের বন্দিদের রাষ্ট্রীয় খরচে রাখতে হয়। এ কারণে আসামি ধরার সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। যাতে নিরাপরাধ কেউ আটক না হন। এতে বন্দির সংখ্যা কমে আসবে। এছাড়া আইনগতভাবে যারা জামিনযোগ্য তাদের বয়স, শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে মুক্তি দিয়ে বন্দিদের সংখ্যা কমিয়ে আনা সম্ভব।
এআর/এমএআর/এমএস