পদোন্নতি বঞ্চনায় পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ
বাংলাদেশ পুলিশ যে কয়টি সেক্টরে কাজ করে তার মধ্যে ক্রাইম ও পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্টের পরই গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে রোড সেফটি ও ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট। প্রাকৃতিক কিংবা মানবসৃষ্ট যেকোনো দুর্যোগে ট্রাফিক বিভাগের দায়িত্বে বিরতি নেই। রোদ-ঝড়-বৃষ্টি নিরবচ্ছিন্ন শ্রম দিয়েও একটু উনিশ-বিশ হলে অপবাদ শুনতে হয় ট্রাফিক বিভাগে কর্মরতদের। উপরন্তু এই বিভাগে যোগদান করা (এএসপি বা তদূর্ধ্ব বাদে) সদস্যদের পদোন্নতি বঞ্চনার অভিযোগ দীর্ঘ দিনের।
ট্রাফিক বিভাগে কর্মরত একাধিক ট্রাফিক ইন্সপেক্টর (টিআই) ও সার্জেন্টের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নীরবে কাজ করে যেতে হয় এই সেক্টরে। আবার এখানে প্রত্যাশাও বেশি। দিন-রাত রাস্তায় থাকায় নানা রোগেও আক্রান্ত হচ্ছেন তারা। সাইনোসাইটিস, শ্বাসকষ্ট, মাথাব্যথা সারা বছরই লেগে থাকে। তবুও নেই কাঙ্ক্ষিত পদোন্নতি, নেই ঝুঁকিভাতাও।
পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, উপরের দিকে পদোন্নতি না থাকলে নিচের দিকের পদোন্নতি এমনিতেই কমে যায়। তবে ট্রাফিক বিভাগে পদোন্নতি আগে কম ছিল এখন তা বাড়ছে। বেশকিছু পদ সৃষ্টি হয়েছে। ঝুঁকির ভাতার বিষয়টিও বিবেচনাধীন। তবে ট্রাফিক বিভাগে ট্রাফিক ভাতা দেয়া হয়।
পুলিশ সদর দফতরের তথ্য মতে, ট্রাফিক বিভাগে কর্মরতদের মধ্যে সবচেয়ে জনবল বেশি ডিএমপিতে। এখানে প্রায় চার হাজার জনবল রয়েছে। এর বাইরে অন্য মেট্রোপলিটন এলাকার পাশাপাশি জেলা শহরেও গুরুত্ব অনুযায়ী কাজ করছে ট্রাফিক সদস্যরা।
ডিএমপির চারটি ট্রাফিক বিভাগে চার উপ-কমিশনার (ডিসি) ছাড়াও রয়েছেন চারজন অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি)। রয়েছেন জোন ভিত্তিক একাধিক সহকারী কমিশনার (এসি), শতাধিক ট্রাফিক ইন্সপেক্টর (টিআই) ও সাত শতাধিক সার্জেন্ট। অন্যরা ট্রাফিক কনস্টেবল হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
১৯৯৯ সালে ট্রাফিক বিভাগে যোগ দিয়ে বর্তমানে ডিএমপিতে দায়িত্ব পালন করা এক ট্রাফিক ইন্সপেক্টর নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রায় ২০ বছর হচ্ছে সার্জেন্ট হিসেবে যোগ দিয়েছি। ২০ বছরে বলতে পারেন একটা মাত্র প্রমোশন মিলেছে। সার্জেন্ট থেকে টিআই হয়েছি। আমার মতো অনেক সার্জেন্ট বা টিআই মনঃকষ্ট নিয়ে হতাশায় ভুগছেন।
তিনি বলেন, ‘আমরা যখন সার্জেন্ট হিসেবে ট্রেনিং নিয়েছি সমসাময়িক এএসপি হিসেবে যারা যোগদান করেছেন তাদের অনেকে অ্যাডিশনাল ডিআইজি পর্যন্ত হয়ে গেছেন। অথচ ট্রাফিক বিভাগে কর্মরতরা ঝুলে আছেন।’
তিনি উদাহরণ টেনে বলেন, ডিএমপিতে এমনও অনেক টিআই রয়েছেন, ১২ মাসের মধ্যে ১১ মাসই তারা শ্রেষ্ঠ ট্রাফিক ইন্সপেক্টর হিসেবে পুরস্কৃত হয়েছেন। কিন্তু তাদের কপালে জোটেনি কোনো বিপিএম কিংবা পিপিএম পুরস্কার, মেলেনি পদোন্নতিও।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিএমপি উত্তরের এক ট্রাফিক সার্জেন্ট বলেন, ২০০১ সালে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স শেষে সার্জেন্ট হিসেবে ট্রাফিক পুলিশে যোগ দেই। আজ ১৮ বছর পরও আমার পরিচয়, আমি ট্রাফিক পুলিশের একজন সার্জেন্ট। অথচ একই সময়ে পুলিশে এএসআই হিসেবে যোগদানকারী এখন ইন্সপেক্টর। যাকে এখন স্যার সম্বোধন করতে হচ্ছে। মেধা থাকার পরও দীর্ঘদিন ধরে পদোন্নতি বঞ্চিত হচ্ছেন এ বিভাগে কর্মরতরা।
ট্রাফিক, দক্ষিণ বিভাগের এক সার্জেন্ট বলেন, পুলিশ বাহিনীতে কর্মরত কর্মকর্তাদের ঝুঁকিভাতা দেয়ার নিয়ম থাকলেও ট্রাফিক (নিরস্ত্র) পুলিশে কর্মরত কর্মকর্তারা ঝুঁকিভাতা পান না।
তিনি দাবি করে বলেন, ‘কর্মক্ষেত্রে যথাযথ মূল্যায়নটা জরুরি। সুযোগ-সুবিধা কম হলে বা একই বাহিনীর দুই সেক্টরে বৈষম্য হলে সেটা আরও বেশি কষ্ট দেয়। আমরা প্রত্যাশা করছি, সামনের দিনগুলোতে কাঙ্ক্ষিত পদোন্নতি দেয়া হবে।
ডিএমপির লালবাগ ক্রাইম ডিভিশন থেকে প্রেষণে ডিএমপির ট্রাফিক দক্ষিণ বিভাগের উপ-কমিশনার হিসেবে দায়িত্বরত এস এম মুরাদ আলী জাগো নিউজকে বলেন, ‘ট্রাফিক ডিভিশনে আসার পর এখানকার সংকট ও সমস্যাগুলো প্রত্যক্ষ করছি। আগে ধারণা ছিল মাত্র। এখন বাস্তব অভিজ্ঞতা হচ্ছে। এখানে পদোন্নতিতে একটা হতাশা ছিল। সেটা কিন্তু বর্তমান সরকার কমিয়ে এনেছে। উপরে বেশকিছু পদ সৃষ্টি হওয়ায় নিচে বেশকিছু সংখ্যক পদোন্নতি হয়েছে। সামনের দিনগুলোতে ট্রাফিকে কর্মরতদের পদোন্নতি আরও বাড়বে।
এ ব্যাপারে পুলিশ সদর দফতরের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের এএসপি সুদীপ্ত সরকার বলেন, ট্রাফিকে পদোন্নতি ছিল না, এমনটা নয়। তবে সীমিত ছিল। সে জায়গা থেকে বেরিয়ে বেশকিছু পদ সৃষ্ট হয়েছে। সম্প্রতি পদোন্নতিও হয়েছে। সামনে সংখ্যাটা আরও বাড়বে। বাকিটা সংশ্লিষ্ট ডিভিশন ভালো বলতে পারবে।
পুলিশ সদর দফতরের অপারেশন উইংয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ট্রাফিকের পদোন্নতি নিয়ে হতাশা আছে। কারণ উপরে যদি কাঙ্ক্ষিত পদ না থাকে বা পদ সৃষ্ট না হয় তাহলে নিচে এর প্রভাব পড়ে। এটা নিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে দর কষাকষি চলছে। বেশকিছু পদ তৈরি হয়েছে, আশা করি সামনে সমাধানের পথ আরও প্রশস্ত হবে।
জেইউ/এমএআর/পিআর/এসজি