সত্যিকার অর্থে নির্বাচন কমিশন কিছুই করছে না
ড. তোফায়েল আহমেদ। উপাচার্য, বেসরকারি ব্রিটানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। লেখক, গবেষক, রাজনীতি ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ। নির্বাচন প্রসঙ্গ নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজ-এর। প্রশ্ন তোলেন নির্বাচনী পরিবেশ এবং নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে।
নির্বাচন আয়োজন এখন পর্যন্ত ‘সাজানো’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিরোধী পক্ষের সঙ্গে সরকার এবং নির্বাচন কমিশন পক্ষপাতমূলক আচরণ করছে। রাজনীতির চলমান সংকট উত্তরণে সরকারের ইচ্ছাশক্তিই যথেষ্ট, বলেও মত দেন। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে প্রথমটি।
জাগো নিউজ : নির্বাচন পরিস্থিতি কীভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন?
তোফায়েল আহমেদ : নির্বাচন পরিস্থিতি নিয়ে এখন পর্যন্ত আমার কোনো গভীর পর্যবেক্ষণ নেই। কারণ এমন একটি নির্বাচনে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন হবে- এমনটি আমি আশা করছি না। মূলত নির্বাচনের শেষের তিনদিন কী হয়, সেটাই বড় কথা। ওই তিনদিনে কী হয়, তা আমরা আগেও দেখেছি।
জাগো নিউজ : ওই তিনদিনই কি আসলে পরিবর্তনের নিয়ামক?
তোফায়েল আহমেদ : হ্যাঁ। চাইলে ওই তিনদিনে অনেক কিছুই করে ফেলা সম্ভব। পুলিশ ধরপাকড় করে যদি ভয়ের পরিবেশ তৈরি করে, তাহলে মানুষ ভোট কেন্দ্রে আসতে চাইবে না। পুলিশ এখনও নামে-বেনামে আটক করছে। প্রতিবাদও হচ্ছে। তবুও এখন যে পরিবেশ বিরাজ করছে, তা মন্দের ভালো। এমন পরিবেশ বিরাজ করলে নির্বাচন মোটামুটি ভালো হতে পারে বলে ধারণা করা যায়।
জাগো নিউজ : তাহলে মানুষ আশা রাখতেই পারে?
আরও পড়ুন >> নির্বাচনের কাঠামোই ভেঙে দিল কমিশন
তোফায়েল আহমেদ : হ্যাঁ। তবে সেটা সরকারের ওপর নির্ভর করছে। সব চাবিকাঠি সরকারের হাতে। সরকার না চাইলে কিছুই সম্ভব নয়।
জাগো নিউজ : সংলাপের দাবি পূরণ না হওয়ার পরও নির্বাচনে যাচ্ছে বিরোধী পক্ষ। সংলাপ আয়োজন সরকারের জন্য কতটুকু চাপ তৈরি করতে পেরেছে বলে মনে করেন?
তোফায়েল আহমেদ : সরকার চাপে আছে, আপনি তা মনে করতেই পারেন। কিন্তু সরকারের ক্ষমতায় থাকারও তো একটা চাপ আছে। ক্ষমতা ছাড়লে ক্ষতি হবে এবং এ কারণেই ছাড়া যাবে না বলে তারা সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকতে পারেন।
জাগো নিউজ : তাহলে কি ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের ইঙ্গিত স্পষ্ট হচ্ছে?
তোফায়েল আহমেদ : ওই নির্বাচনে বিএনপির অংশ না নেয়া এক হিসাব, আর এখন আরেক হিসাব। বিরোধী পক্ষ অনেক চাপে আছে, চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু লাভ কী? সব তো সরকারের হাতে। কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ নেই বিরোধী পক্ষের হাতে।
এখন পর্যন্ত বিরোধী পক্ষের কোনো দাবি মানা হয়নি। এরপরও তারা হয়ত নির্বাচনে গিয়ে প্রমাণ করতে চাইবে নির্বাচন সঠিক হয়নি।
জাগো নিউজ : এমন প্রমাণে কী আর আসে-যায়?
তোফায়েল আহমেদ : বিশ্লেষণ করার মতো পর্যাপ্ত তথ্য নেই। সব ধারণার ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করতে হচ্ছে। ২০১৪ সালের মতোও হতে পারে। আবার বরিশাল, খুলনা বা গাজীপুর সিটি নির্বাচনের মতোও হতে পারে। প্রতিটি নির্বাচনই তো উদাহরণ হয়ে থাকছে। আবার নির্বাচন ভালোও হতে পারে। সবই ধারণার ওপর থেকে বলা।
জাগো নিউজ : চলমান পরিস্থিতি নিয়ে কী বলবেন?
আরও পড়ুন >> আকাঙ্ক্ষা তীব্র হলেই সংশোধন হবে রাজনীতি
তোফায়েল আহমেদ : একটি পক্ষ দীর্ঘদিন ধরে মাঠে অবস্থান করে সবকিছু সুন্দরভাবে সাজিয়ে ফেলেছে। আরেক পক্ষ এখনও অগোছালো। সবকিছু সরকারের দখলে। মিডিয়ায় সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের প্রচার-প্রচারণা হচ্ছে। বিজ্ঞাপন যাচ্ছে। সবই তো নির্বাচনের ওপর প্রভাব ফেলছে। অথচ বিরোধী পক্ষ প্রতিবাদ ছাড়া আর কিছুই করতে পারছে না। গ্রেফতার বা মামলার প্রতিবাদ করতেই তাদের দিন পার। সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারছে না। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচনী মাঠে কোনোভাবেই সমতা আসতে পারে না। এরপরও বিরোধী পক্ষ নির্বাচনে অংশ নিতে যাচ্ছে। এটি একটি শুভ লক্ষণ বলে মনে করি।
জাগো নিউজ : অসম পরিস্থিতিতে শুভ লক্ষণ!
তোফায়েল আহমেদ : অন্তত নির্বাচনে অংশ না নেয়ার অভিযোগ থেকে রেহাই পাচ্ছে বিরোধীরা। নির্বাচনে অংশ নিয়েও নিজেদের অবস্থান জানাতে পারবে বিরোধী পক্ষ। তবে নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে এখনও কিছু বলা যাবে না। কারণ সবকিছুই সরকারের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করছে। নির্বাচন কমিশনের স্বতঃস্ফূর্তভাবে কতগুলো কাজ করার কথা ছিল। সত্যিকার অর্থে নির্বাচন কমিশন কিছুই করছে না।
জাগো নিউজ : কী করার কথা ছিল?
তোফায়েল আহমেদ : নির্বাচনের জন্য ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেয়া হয়েছে। কিন্তু তাদের কাজ কী, কীভাবে দায়িত্ব পালন করবে তা এখনও বুঝিয়ে দেয়নি। তফসিল ঘোষণার পরই মাঠে সক্রিয় থাকার কথা ম্যাজিস্ট্রেটদের। কিন্তু কোনো তৎপরতা নেই। তফসিল ঘোষণার পর অনেক ঘটনাই ঘটল। কিন্তু ভ্রাম্যমাণ আদালত কী এখন পর্যন্ত কোনো অ্যাকশন নিয়েছে? তাহলে কমিটি করে বিচার বিভাগীয় লোকদের মাঠে নামিয়ে লাভ কী হলো?
একই ভাবে ১৫ ডিসেম্বর মাঠে সেনাবাহিনী যাবে। অথচ তাদের কী কাজ, তা এখনও স্পষ্ট নয়। তাদের সঙ্গে অন্য বাহিনীর কী কাজ তাও পরিষ্কার করা হয়নি। নির্বাচনের মাঠে মানুষকে সুরক্ষা দেয়ার দুটি পদক্ষেপ হচ্ছে বিচারক এবং সেনাবাহিনীকে মাঠে নামানো। অথচ তাদের কাজ নিয়ে এখনও মানুষ কিছু বুঝে উঠতে পারছে না।
নির্বাচনের ১৫ দিন আগে মাঠে যাচ্ছে সেনাবাহিনী, এটি আশার কথা। কিন্তু তারা কীভাবে, স্বাধীনভাবে মুভ করবে কিনা, তা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নাকি সেনাবাহিনী এক জায়গায় বসে থাকবে, আর ডাকলে সাড়া দেবে? পুলিশ অতি উৎসাহী হয়ে আটক করছে। মামলা দিচ্ছে। এগুলো তো এখনই দেখার বিষয়।
জাগো নিউজ : এরপরও নির্বাচনী হাওয়া জনমনে…
তোফায়েল আহমেদ : মানুষ ভোট কেন্দ্রে আসবে কিনা- সন্দেহ আছে। নির্বাচনী উৎসব বইছে মিডিয়াতে। আসলে নির্বাচন কোনো উৎসব নয়। নির্বাচনে অংশ নেয়া, ভোট দেয়া হচ্ছে দায়িত্বের বিষয়। দায়িত্ব ও চেতনা নিয়ে মানুষ ভোট দিতে আসবে কিনা- সেটাই এখন ভাবনার বিষয়। ভোট দেয়ার জন্য মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে, সেটা দেখতে পাচ্ছি না।
জাগো নিউজ : মনোনয়নপত্র কেনা নিয়ে একপ্রকার আগ্রহ তো ছিল…
তোফায়েল আহমেদ : মনোনয়ন বেচা-কেনা নিয়ে সাধারণের আগ্রহ এখানে প্রকাশ পায়নি। এমপি পদ অত্যন্ত লাভজনক। এ কারণেই এমপি এবং তার কতিপয় সমর্থক উৎসাহ দেখাচ্ছেন। বাকিটা মিডিয়ার উত্তেজনা। চূড়ান্ত মনোনয়ন না পেলেও মনোনয়নপত্র কেনা হয়েছে ব্যবসার কারণেই। মিডিয়ায় নাম এসেছে। তারা এটিকে অনেক বড় করে দেখেন।
জাগো নিউজ : তার মানে নির্বাচন ঘিরে মানুষ জেগেছে, তা মনে করছেন না?
আরও পড়ুন >> খালেদা জিয়ার জনপ্রিয়তাই শেখ হাসিনার বড় ভয়
তোফায়েল আহমেদ : মানুষ জাগবে কেন? তার স্বার্থ কী? স্বার্থ তো হচ্ছে গুটি কয়েক ব্যক্তির। মন্ত্রী-এমপিদের সম্পদের পাহাড় হচ্ছে। হলফনামা দেখলেই সব চোখে ভেসে ওঠে। যদিও খুবই কম পরিমাণ সম্পদ দেখানো হয় হলফনামায়। এসব অসত্য তথ্য দেখে সাধারণ মানুষ হতাশ।
রাজনীতি এখন পরিবারকেন্দ্রিক। দাদা-বাবা-ছেলের হাতেই একটি আসনের প্রার্থী পরম্পরায় হয়ে আসছে। অন্য কোনো নেতৃত্ব নেই। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টির এমপিরা একই পরিবার থেকে উঠে আসছেন।
জাগো নিউজ : এ পরিস্থিতি রাজনৈতিক দলগুলোর চরম দৈন্যতার প্রকাশ বলা যায় কিনা?
তোফায়েল আহমেদ : অবশ্যই চরম দৈন্যতায় পড়েছে দলগুলো। পরিবার ও ব্যবসার সঙ্গে দলগুলো এমনভাবে সম্পৃক্ত হয়েছে যে, চাইলেই আর বেরিয়ে আসতে পারছে না। এখানে জনস্বার্থ কাজ করছে না। সুতরাং নির্বাচন নিয়ে জনগণ জাগবে- এমনটি মনে করার কোনো কারণ নেই। ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকতে নিজেরা নিজেরাই দ্বন্দ্বে জড়িয়ে খুন হচ্ছে। ক্ষমতার জন্য বেপরোয়া হচ্ছে ক্ষমতাসীনরাই।
এএসএস/এমআরএম/এমএআর/পিআর