রাজনীতির দ্বন্দ্ব আরও প্রকট হবে
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। লেখক, গবেষক, শিক্ষাবিদ ও বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী। লিখছেন সমাজ, রাজনীতির নানা প্রসঙ্গ নিয়ে। নির্বাচন, রাজনীতি, চলমান সংকট নিয়ে সম্প্রতি মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র। নির্বাচন ঘিরে দুই জোটের রাজনীতিকে ‘বুর্জোয়া মেরুকরণ’ বলে উল্লেখ করেন। এ মেরুকরণের মূল উদ্দেশ্য ‘ক্ষমতা’ হলেও জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের কোনো ভূমিকা রাখবে না বলে উল্লেখ করেন।
আসন্ন নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে চলমান সংকট আরও বাড়বে বলেও মত দেন তিনি। জনগণের ক্ষমতায়নে এই সমাজচিন্তক বাম ধারার শক্তির ওপর ভরসা রাখেন। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে প্রথমটি।
জাগো নিউজ : নির্বাচনমুখী দেশ। চলমান রাজনীতি কীভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : রাজনৈতিক পরিবেশ গুমোট থাকলেও নির্বাচন ঘিরে অনেক কিছুই পরিষ্কার হচ্ছে। অন্তত সংঘাতের বিষয়টি দিনে দিনে স্পষ্ট হচ্ছে এবং এ ইঙ্গিত রাষ্ট্র, সমাজের জন্য কোনোভাবেই শুভ নয়।
একদিকে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছেন, অন্যদিকে বিরোধী পক্ষকে দমনের নামে হাজার হাজার মামলা দেয়া হচ্ছে। গ্রেফতার হচ্ছে। নির্বাচন সামনে রেখে এ ধরনের প্রবণতা সমাজকে আরও সহিংস করে তুলবে।
জাগো নিউজ : দ্বৈতনীতির এমন রাজনীতি তো আমরা আগে থেকেই দেখে আসছি…
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : হ্যাঁ, রাজনীতির এই বৈষম্য নীতিই সমাজকে অস্থির করে তুলেছে এবং দিনে দিনে তা বেড়েই চলছে।
নির্বাচনের মনোনয়নপত্র বিক্রি নিয়ে আমরা সরকার ও প্রশাসনের মধ্যে দুই ধরনের আচরণ লক্ষ্য করলাম। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের কার্যালয় ধানমন্ডিতে এক নীতি আবার বিরোধী জোট বিএনপির কার্যালয়ের সামনে আরেক নীতি। এ ধরনের ইঙ্গিত একটি নির্বাচনের জন্য কোনোভাবেই সহনশীল হতে পারে না। বিশেষ করে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নামের বহুল প্রচারিত একটি কথা যে আছে, তা আরও জটিল হচ্ছে। সংসদীয় গণতন্ত্র নিয়ে যে আশার আলো দেখা দিয়েছিল নব্বইয়ের দশকের শুরুতে, এখন তা রীতিমতো ফিকে হয়ে আসছে।
জাগো নিউজ : রাজনীতিতে নয়া জোট গঠন হয়েছে ড. কামাল হোসেনদের নেতৃত্বে। এটি এখন নির্বাচনী হাওয়ায় উত্তাপ ছড়াচ্ছে। আপনি কী বলবেন?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : নতুন জোট ঐক্যফ্রন্টের যাত্রার মধ্য দিয়ে রাজনীতির নতুন মেরুকরণ হয়েছে। নৌকা প্রতীক এবং ধানের শীষ প্রতীকের মধ্যে লড়াই আগেও ছিল। কিন্তু এতটা স্পষ্ট ছিল না, যা এ জোট গঠনের মধ্যে দিয়ে হয়েছে।
আরও পড়ুন >> সেই সুলতান মনসুর কেন বিরোধী শিবিরে?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হাতি ও গাধার প্রতীক নিয়ে যে লড়াই, বাংলাদেশে এখন সেই ধরনের লড়াই দেখা যাবে।
জাগো নিউজ : তাহলে এ লড়াই রাজনীতি, সমাজের জন্য কী ইঙ্গিত নিয়ে আসছে?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : বুর্জোয়া রাজনীতির মধ্যে আদর্শগত নীতির কোনো ইঙ্গিত থাকে না। তারা লড়াই করে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য। যারা একবার ক্ষমতায় যায়, তারা সর্বোচ্চ শক্তি ব্যবহার করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে। আর যারা ক্ষমতার বাইরে, তারা সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করতে চায় ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য। দুই পক্ষেরই শক্তির কেন্দ্রে থাকে ক্ষমতা।
নতুন জোট গঠনের মধ্য দিয়ে আদর্শহীনতার দ্বন্দ্ব আরও পরিষ্কার হয়ে গেছে। কারণ এ জোটগুলো বিশেষ কোনো আদর্শ কেন্দ্র করে হচ্ছে না।
জাগো নিউজ : মুক্তিযুদ্ধ, জাতীয়তাবাদ ইস্যুতে তো আদর্শের প্রসঙ্গ আসেই। সেটা ধারণ না করলেও আলোচনায় রাখছেন দলগুলো…
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : মুক্তিযুদ্ধের পর এ দেশে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ আর বাঙালি জাতীয়তাবাদ নিয়ে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। ড. কামাল হোসেনদের রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। অথচ তিনি এখন বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা জিয়াউর রহমানের দল বিএনপির সঙ্গে মিশে গেলেন। আবার ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীরাই বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ধারণ করে এতদিন রাজনীতি করে আসছেন, অথচ এখন তারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট করতে চাইছেন।
বুর্জোয়া রাজনীতি হচ্ছে অন্তঃসারশূন্য। জোটগুলোর মধ্যে তা-ই লক্ষ্য করছি আমরা। রাজনীতির নতুন মেরুকরণে দল বা ব্যক্তি বিশেষের স্বরূপ উন্মোচিত হচ্ছে। রাজনীতির দ্বন্দ্ব আরও প্রকট হবে।
আরও পড়ুন >> কঠিন হলেও বিরোধীপক্ষ খেলতে চাইবে এবার
জাগো নিউজ : এ দ্বন্দ্ব জনগণ কীভাবে দেখছে?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : আমি মনে করি, এই দ্বন্দ্ব জনগণের জন্য ভালো। কারণ বুর্জোয়া শক্তি কখনও জনগণের আবেগ ধারণ করে না। আর জনগণ এখন বিকল্প খুঁজছে। বুর্জোয়াদের দ্বন্দ্ব স্পষ্ট হলে বিকল্প খোঁজা সহজ হবে।
জাগো নিউজ : কোথা থেকে আসবে বিকল্প?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : কথিত গণতান্ত্রিক শক্তি থেকে কোনো বিকল্প আসবে না। বিকল্প আসতে হবে বাম গণতান্ত্রিক ধারা থেকে। বাম শক্তি থেকে যদি কোনো জোট বা বিকল্প গড়ে ওঠে তবেই জনগণের আশা জাগবে।
এএসএস/এমএআর/আরআইপি