মাধ্যমিকের নতুন বই নিয়ে ‘অনিশ্চয়তা’
মাধ্যমিক পর্যায়ে বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপা ও বিতরণ নিয়ে নতুন সঙ্কট দেখা দিয়েছে। দ্রুত এ সঙ্কট নিরসন না হলে নির্ধারিত সময়ে শিক্ষার্থীদের হাতে বই পৌঁছানো অনিশ্চিত হয়ে পড়বে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
এখনও নির্ধারিত সময়ে উপজেলা পর্যায়ে বিনামূল্যের বই পৌঁছায়নি। তাই নতুন করে আরও ৩০ দিন সময় বাড়ানো হয়েছে বলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) সূত্রে জানা গেছে।
এনসিটিবির তথ্যানুযায়ী, সারাদেশে বই পৌঁছেছে প্রায় ৬০ শতাংশ। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে উপজেলা পর্যায়ে বই পৌঁছেছে ৫৫ শতাংশের কাছাকাছি। ফলে ২০১৯ শিক্ষাবর্ষের জন্য ছাপার আদেশ দেয়া ৩৬ কোটি ছয় লাখের বেশি বইয়ের মধ্যে এনসিটিবির তথ্যানুসারে অবশিষ্ট ২০ কোটি বা ৪০ শতাংশ বই কবে ছাপা হবে, কখন সেগুলো উপজেলা পর্যায়ে বা বিদ্যালয়ে পৌঁছাবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন, বই ছাপার কাগজ সঙ্কট, পরিবহন সমস্যাসহ নানা কারণে অবশিষ্ট বই ছাপা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। মুদ্রণ শিল্প সমিতির অভিযোগ, এনসিটিবি পাঠ্যবই ছাপার কাজ মনিটরিং, সরবরাহ, অনুমোদন এবং পরিবহনে অসহযোগিতা ও বাধা সৃষ্টি করছে।
এনসিটিবি ও মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর একাধিক সূত্র জানায়, প্রাথমিকের পাঠ্যবই ছাপা ও সরবরাহ কিছুটা হলেও মাধ্যমিকের বই নিয়ে বেশি জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সময় মতো বিল না পেলে এবং মিলগুলো সময় মতো কাগজ সরবরাহ না করলে মাধ্যমিকের বই ছাপা ও সরবরাহ বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
এমন প্রেক্ষাপটে, গত ৭ নভেম্বর বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির পক্ষ থেকে এনসিটিবিকে চিঠি দিয়ে সমস্যার তাৎক্ষণিক সমাধান চাওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন সমিতির সভাপতি শহীদ সেরনিয়াবাত। অপরদিকে গত সপ্তাহে এনসিটিবিতে যান শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। তিনি পাঠ্যবইয়ের ছাপা ও বিতরণের সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন।
বৈঠক শেষে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘এবার প্রায় ৩৬ কোটি পাঠ্যবই বিতরণ হবে। এর মধ্যে ২১ কোটি বই ইতোমধ্যে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।’ বাকি বইগুলো ডিসেম্বরের ১০ তারিখের মধ্যে পৌঁছে দেয়ার জন্য নির্দেশনা দেন মন্ত্রী। তিনি আশা প্রকাশ করেন, এ কাজে কেউ বাধা সৃষ্টি করবেন না। সবাই সহযোগিতা করবেন।
এনসিটিবির একাধিক সূত্র ও মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো জানায়, প্রাথমিকের বই ছাপার কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। অবশিষ্ট বই ছাপার জন্য কাগজ পাওয়া গেলে এবং এনসিটিবি থেকে বিল পাওয়া সাপেক্ষে ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করা গেলেই মাধ্যমিকের কাজে হাত দেয়া হবে।
এ বিষয়ে মুদ্রণ শিল্প সমিতির সভাপতি শহীদ সেরনিয়াবাত জাগো নিউজকে বলেন, ‘শিক্ষামন্ত্রী এনসিটিবি পরিদর্শন করতে এলে, আমরাও তার সঙ্গে কথা বলি। ২০১০ সাল থেকে তিনি আমাদের যেভাবে সহায়তা ও সমর্থন দিয়ে এসেছেন, তার জন্য ধন্যবাদ জানানো হয়। বর্তমান সমস্যাগুলো তার সমানে তুলে ধরা হয়। শিক্ষামন্ত্রী আমাদের সহায়তা করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।’
এনসিটিবিকে চিঠি দেয়ার কথা স্বীকার করে শহীদ সেরনিয়াবাত বলেন, ‘এনসিটিবি কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত সমস্যা সৃষ্টি করছে। এ সব নিয়ে আলোচনা এবং তাৎক্ষণিক সমাধানের জন্য লিখিতভাবে এনসিটিবিকে জানানো হয়েছে। বিগত বছরগুলোতে এনসিটিবি বই ছাপার কাজে যতটুকু সহায়তা করেছে এবার ঠিক ততটুকুই অসহযোগিতা করছে।’
সামগ্রিক বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা জাগো নিউজকে বলেন, ‘শিক্ষামন্ত্রী এনসিটিবিতে আসেন রুটিন ওয়ার্ক হিসেবে। পাঠ্যবই নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। সময় মতোই শিক্ষার্থীদের হাতে বই পৌঁছাবে। মন্ত্রী স্যারের কাছে সার্বিক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।’
মুদ্রণ শিল্প সমিতির চিঠি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘চিঠিতে কী লেখা হয়েছে, এখনও দেখিনি। এটা ফাইল নোট হয়ে আমার কাছে আসবে।’
অপর এক প্রশ্নের জবাবে এনসিটিবি চেয়ারম্যান বলেন, ‘ভারতীয় মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনে যাওয়া এনসিটিবির মনিটরিং টিমের প্রতিবেদন দিয়ে কী হবে? তাদের ৫৬ লাখ বই ইতোমধ্যে উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। অবশিষ্টগুলো আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই দেশে প্রবেশ করবে, ফলে সে বই নিয়ে কোনো টেনশন নেই।’
জানা গেছে, ঢাকা, রাজশাহী ও বগুড়ার সাতটি বড় প্রতিষ্ঠান এখন পর্যন্ত একটি বইও দেয়নি। তারা বিল না পাওয়ায় বই ছাপার কাজ কমিয়ে দিয়েছে।
প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কাগজ কিনতে হচ্ছে বেশি দামে। এছাড়া বিলের টাকা দিচ্ছে না এনসিটিবি। বই ছাপা হলেও পরিবহন সঙ্কটে আগে একাধিক লট পথে আটকে ছিল। এখন আবারও রাস্তায় বই পড়ে থাকলে পরিবহন ব্যয় বেড়ে যাবে। তাই সমস্যা সমাধানের জন্য মুদ্রণ নেতাদের কাছে প্রতিকার চেয়েছি, তারা সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন। দেখা যাক কী হয়।
মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা যায়, রাজধানী ও রাজধানীর বাইরে বই পরিবহনে পুলিশের নানা ধরনের হয়রানির ব্যাপারে অন্য বছর এনসিটিবি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষে বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু এবার তা শেষ বেলায় এসে নেয়া হয়েছে। ফলে বই পরিবহনকারী ট্রাক-ভ্যানগুলো পথে পথে নানা ধরনের বাধার মুখে পড়ে। ফেরিতে দু-তিনদিন বিলম্ব এবং লাইনে পড়ে থাকতে হয়েছে। বিগত বছরগুলোতে ফেরিতে মন্ত্রী-এমপিদের মতো অগ্রাধিকার পেয়েছিল বই পরিবহনকারী ট্রাক-ভ্যান। এবার উল্টো ঘটছে।
জানা গেছে, বিগত বছরগুলোতে বই ছাপা, মনিটরিং ও বিতরণে এনসিটিবি সর্বাত্মক সহায়তা করেছিল। কিন্তু এ বছর শুরু থেকেই নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়ছে দেশীয় মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। ছাপাখানাগুলোতে এনসিটিবির মনিটরিং টিম পরিদর্শনে গেলেও সময় মতো কাগজ ও ছাপার মানের অনুমোদন দিতে নানা অজুহাত দেখাচ্ছে। ফলে ছাপার কাজ শেষ করতে পারছে না মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। এমন বেশকিছু সুস্পষ্ট অভিযোগ এনসিটিবিতে দেয়া হলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। একই ধরনের অভিযোগ পাঠ্যবই সরবরাহ ও পরিবহনের ক্ষেত্রেও ঘটছে। ফলে সময় মতো বই সরবরাহ ও পৌঁছাতে বিলম্ব হচ্ছে।
এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এনসিটিবি চেয়ারম্যান নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলেন, ‘এনসিটিবি মুদ্রণকারীদের সব ধরনের সহায়তা আগের মতোই দিচ্ছে। কোনো ধরনের সমস্যার কথা জানার সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সমাধানে সক্রিয় ভূমিকা রাখছেন।’
এমএইচএম/এনডিএস/এমএআর/আরআইপি