ভিডিও EN
  1. Home/
  2. বিশেষ প্রতিবেদন

সেই সিডরের রাতের এই সিডর

প্রকাশিত: ০৬:৫৯ পিএম, ১৭ আগস্ট ২০১৫

সিডর সরকার। বয়স ৭ বছর ৯ মাস। খ্রিস্টান বাবা জরজি সরকার ও মা সাথী সরকারের একমাত্র আদরের ধন। সেই আদরের ধন সিডরকে দাদির কাছে রেখেই বাবা-মাকে পেটের দায়ে সংসারের খরচ যোগাতে চট্টগামে পাড়ি জমাতে হয়েছে গত তিন বছর আগে। বাগেরহাটের বাগেরহাট জেলার মংলা উপজেলার কানাইনগরে দাদির কুঁড়ে ঘরে পরম স্নেহে বেড়ে উঠছে সিডর। এখন সে দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র। পড়াশুনা করছে উপজেলার চাঁদপাই ইউনিয়নের সেন্ট লুক প্রাথমিক স্কুলে।

২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর। দেশের উপকূলজুড়ে সুপার সাইক্লোন সিডরের তাণ্ডবলীলা চলছে। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাতের গভীরতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে প্রকৃতির রূঢ় আচরণ। সে রাতে প্রকৃতির করাল গ্রাসের শিকার হয়ে হাজার হাজার মানুষের যখন প্রাণ প্রদীপ নিভতে শুরু করছে ঠিক এমনই এক বিভীষিকাময় রাতে মংলার শ্যালাবুনিয়া এলাকার সেন্ট মেরিজ প্রাথমিক স্কুল কাম সাইক্লোন শেলটারে জন্ম নেয় এক শিশু। গভীর রাতে চরম প্রতিকূল পরিবেশে (রাত আড়াইটার দিকে) সাইক্লোন শেল্টারের দোতালায় পানির মধ্যে জন্ম নেয়া এ শিশুর নাম তার দাদা রেখেছিলেন ‘জোনা’। অবশ্য একদিন পর ১৬ নভেম্বর এ শিশুকে দেখতে গিয়ে এক জাপানি তার নাম রাখেন ‘সিডর’। ঝড়ের রাতে চরম প্রতিকূলতার মধ্যে বেঁচে থাকা সেই বিস্ময়কর বালক এখন কানাইনগরের আবাল বৃদ্ধার কাছে অতি পরিচিত মুখ।

গত শুক্রবার সকাল ৮টা। মংলা বন্দরের পশুর হোটেলে মোটরসাইকেল রেখে সিডর নামের বালকের খোঁজ নিতে নৌকায় পশুর নদী পার হয়ে ইঞ্জিলচালিত ভ্যানের সওয়ারী হলাম। ভাঙাচোরা রাস্তায় ভ্যানে চেপেই সুন্দরবন সংলগ্ন চাঁদপাই ইউনিয়নের কানাইনগর পৌঁছে মহিলা এক মুদি দোকানির কাছে সিডরের বাড়ি কোন দিকে জিজ্ঞাসা করতেই তিনি দেখিয়ে দিলেন। আধাপাকা ইট ও কর্দমাক্ত মাটির রাস্তা পেরিয়ে সিডরের থাকার গৃহের সামনে দিয়ে দরজায় তালা ঝুলানো দেখে এক প্রতিবেশির সরণাপন্ন হতে হয়।

mother
তিনি বললেন, সিডর তার দাদির সঙ্গে স্কুলে গেছে। স্কুলে যেতে পথে এক চা-বিস্কুটের দোকানে সিডরের দাদি রেবা সরকারের (৫৫) দেখা পাই। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে তিনি খানিকটা অখুশিই হলেন। কারণ হিসেবে রাগন্বিত স্বরে বললেন, আমাগে সিডরের ছবি নিয়ে ক্যালেন্ডার ছেপে একেক খান (এক/একটি) ৩০০ টাকা থেকে ৫০০ টাকায় বিক্রি করে লাখ লাখ টাকা আপনাগো এক সাংবাদিক আয় করিছে। ওই সময়ে আমাগো ক্যালেন্ডার বিক্রির টাকা দিয়ে সিডরের জায়গা কিনে দেবে, ওর নামে স্কুল করে দেবে বলেছিল। আমাগো তো টাকা দেয় নাই, সেই টাকা দিয়ে খুলনায় দোতালা বাড়ি করেছে। এমন খবর শুনে কিছুটা বিব্রত হতে হয় আমিসহ বাগেরহাট থেকে যাওয়া আমার এক ছোট ভাইসহকর্মীকে। তখন চা-বিস্কুটের দোকানে বসে থাকা অনেকেই রেবাকে উদ্যেশ্য করে বলেন, আগে শোনো ওনারা কেন আইছে। এক পর্যায়ে আমার উদ্দেশ্যের কথা তাকে বলায় খানিকটা শান্ত হয় তিনি। দোকান থেকে বেরিয়ে ইটের রাস্তা ধরে কিছুদূর এগিয়ে গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই নজর আসে সাধু কাথলিক গির্জার। অনেক পরে পূর্ব পরিচয়ের সূত্র ধরে গির্জার সিড়িতে বসে তার আক্ষেপ তুলে ধরেন।

কী বলবো কস্টের কথা, সিডরের পর একটি পত্রিকা থেকে কাইনমারী রাস্তার পাশে একটি মুদি দোকান করে দেয়। দোকানের মালপত্রও তারা কিনে দেয়। এভাবে বেশ চলছিল। এক পর্যায়ে দোকানের মালামাল চুরি হয়ে যায়। এক সাংবাদিক শিশু সিডরের ছবিযুক্ত ক্যালেন্ডার বিক্রির টাকা দিয়ে জায়গা কিনে দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয়। এক পর্যায়ে জায়গাও দেখতে বলে। কিন্ত দেয়নি। সরকারিভাবে জাল নৌকা ও গাভি দেয়া হলেও আমাদের ভাগ্যে তা জোটেনি। ওই সময় সবাই বলতো তোমাদের তো পত্রিকা থেকে অনেক টাকা দেবে এই কথার কারণ গির্জার লোকজনও তেমন কোনো সাহায্য করেনি। তবে খ্রিস্টান মিশনারিজে থাকার জন্য তাদের জায়গায় টিনের ঘর তুলে দিয়েছে।

এমনি পাওয়া না পাওয়ার এক পর্যায়ে সেখানেই এসে হাজির হয় সিডরের দাদা রনজিৎ সরকার। ২০ দিন আগে চট্টগ্রাম থেকে তিনি বাগেরহাট এসেছেন। ক্ষোভের সঙ্গে ৬৮ বছরের এ বৃদ্ধা বলেন, নাতির লেখাপড়ার খরচ যোগাতে এখন আমারে বুড়ো বয়সে চট্টগ্রাম গিয়ে ছেলের সঙ্গে কাজ করতে হচ্ছে। সংসারের খরচ চালাতে সুন্দরবনে বনদস্যুদের ভয়ে জেলে বাওয়ালির পেশা ছেড়ে ২০১২ সালের পর একমাত্র ছেলে জরজি সরকার চট্টগ্রামে পাড়ি জমায়। সঙ্গে নিয়ে যায় সিডরের মা সাথী সরকারকেও। জীবিকার সন্ধানে চট্টগ্রামের ইপিজেডে রাস্তার পাশে খাবারের হোটেল দেয়। সংসারের আয় বাড়াতে স্ত্রী সাথীকে সেখানকার একটি গার্মেন্টসে চাকরি করতে পাঠায়। ছেলে জরজির খাবারের দোকান চালাতে তার সহযোগী হিসেবে রনজিৎ সরকারকেও চট্টগামে পাড়ি জামাতে হয়েছে। এ অবস্থায় মংলায় দাদি রেবা সরকারের কাছেই সিডরকে থাকতে হয়। স্কুলের ছুটির ফাঁকে ফাঁকে সিডরকে দাদা রনজিতের সঙ্গে করে মাঝে মধ্যে বাবা-মায়ের কাছে যায়।

kids
গির্জার সিড়িতে বসে এমন কথা বলতে বলতেই সিডরের রাতের কথা বলতে গিয়ে চোখ গড়িয়ে পানি পড়তে থাকে রনজিৎ সরকারের। দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে স্ত্রী রেবার পাশে বসেই বলেন, সেই বিভীষিকাময় রাতের কথা। কানাইনগর এলাকার খালের পাড়ে পাঁচ শতক জমি কিনে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছেন তার পরিবার। ২০০৫ সালে একমাত্র ছেলে জরজি সরকারকে মংলার চিলা বাজারের নাতন বিশ্বাসের মেয়ে সাথীর সঙ্গে বিয়ে দেন। বাপ ছেলে দু`জনেই সুন্দরবনে জেলে বাওয়ালির কাজ করতো। ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর ঝড়ের সময় সন্ধ্যার পর সন্তান সম্ভবা পুত্রবধূ সাথী সরকার ও ছেলে জরজিকে নিয়ে বাড়ির কিছুদূরে সেন্ট মেরিজ প্রাথমিক বিদ্যালয় কাম সাইক্লোন শেল্টারে রেখে আসেন।

রাতে ঝড়ের গতি বাড়তে থাকায় এক পর্যায়ে রনজিৎ তার স্ত্রী রেবা সরকারকে সঙ্গে নিয়ে ওই সাইক্লোন শেল্টারে আশ্রয় নেয়। দোতালার এই স্কুল আশ্রয়কেন্দ্রে তখন হাজার খানেক লোক গাদাগাদি করে প্রাণ বাঁচাতে উঠেছে। ঝড়ের রাতে নিচ তলায় জলোচ্ছ্বাসের পানি ঢুকতে থাকায় আরো বেশি আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। বাতাসের তীব্র ঝাপটায় দোতালার জানালা-দরজা দিয়ে পানি ভিতরে ঢুকে মেঝেতে জমতে জমতে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষদের গোড়ালি পর্যন্ত হয়ে যায়। মেঝেতে পানি গড়াগড়ি দেয় চারদিকে। অন্ধকার এমন এক রাতে (আড়াইটার দিকে) সাথীর সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়ে পানিতে গড়াগড়ি খেতে থাকে। সন্ধ্যা রাত থেকে অসুস্থ সাথী সরকার সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে আরো অসুস্থ হয়ে পড়েন।

সংকটময় এ রাতে ভূমিষ্ঠ হওয়া সন্তানের আশা ছেড়ে দিয়ে সাথীকে বাঁচাতে চেষ্ট চালায় পরিবারের সদস্যরা। ওই রাতে ছিল না কোনো ডাক্তার-নার্স। নিজেদের চেষ্টায় বেঁচে যায় সাথী। ঝড়ের গতিবেগ কমে যাওয়ায় মেঝেতে পড়ে থাকা শিশুর খোঁজ নিতে শুরু হয় মায়ের। নিচের জমে থাকা পানির মধ্যে তখনও বেঁচে রয়েছে শিশুটি। এমনই এক চরম প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকে সাথীর সন্তান। তখন সাইক্লোন শেল্টারে হৈ-চৈ পড়ে যায়। চারিদিকে পানি চরম প্রতিকূলতায় জন্ম নেয়া নাতীর নাম রাখে দাদা ‘জোনা’।

রনজিৎ সরকারের কাছে জানতে চাওয়া হয় শিশুর নাম কেন জোনা রাখলেন? প্রতি উত্তরে তিনি বললেন, ইউনুস নবিকে যখন সমুদ্রের মাছে গিলে খেয়েছিল। তখন তিনি মাছের পেট থেকে মুক্তি পাবার পর তাকে জোনা নামে ডাকা হোতো। তাই ইউনুস নবির সেই নামের জন্য ওর নাম জোনা রাখি। ঝড়ের রাত কেটে গেলে পরের দিন শিশু জোনাসহ সবাইকে নিয়ে কানাইনগরের বাড়ি ফিরে যাই। চারিদিকে সব ধংসস্তূপ বাড়ি-ঘর গাছপালা পড়ে আছে কিন্ত আমার কাঠের ঘর তেমন কিছুই হয়নি। এমনকি আমার বাড়ির একটা গাছও পড়েনি। এমনি অবস্থায় শিশু জোনাকে নিয়ে ঘরে উঠি। পরের দিন ১৬ নভেম্বর এক জাপানি সাংবাদিকসহ কয়েকজন লোক ঝড়ের রাতে সাইক্লোন শেল্টারে জন্ম নেয়া শিশুর খোঁজ নিতে আমার বাড়ি আসে। তখন ওই জাপানি আমার নাতির অনেক ছবি তোলে আর নাম রাখে সিডর।

people
রনজিৎ আমাকে সঙ্গে নিয়ে গির্জা ছেড়ে স্কুলের দিকে সিডরকে দেখাতে নিয়ে যায়। স্কুলে ঢুকতেই সেন্ট লুক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আন্তনী সদানন্দ ঘোষের সঙ্গে দেখা হয়। আমার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে শ্রেণি কক্ষে নিয়ে যান তিনি। খ্রিস্টান মিশনারিজদের দ্বারা পরিচালিত একতলা বিশিষ্ট সেন্ট লুক প্রাথমিক স্কুল ১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়। এখানে পাঠদান চলে প্লে থেকে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত। সিডর সরকারসহ দ্বিতীয় শ্রেণির ২৪ জন ছাত্র-ছাত্রীর সবাইকে তাই আগামী বছর এ বিদ্যালয় ছেড়ে পাশ্ববর্তী শ্যালাবুনিয়ার সেন্ট মেরিজ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যেতে হবে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার জন্য।

স্কুলের প্রধান শিক্ষকসহ অন্যান্য শিক্ষকরা জানালেন, সিডর পড়ালেখায় খুব ভালো না হলেও নিয়মিত স্কুলে আসে এবং খেলাধুলায় ভীষণ পারদর্শী। সকলেই তাকে আদর স্নেহ করে তাই অনেকটা চঞ্চলও বটে।

শুক্রবার তাই বেশ আগেই স্কুল ছুটি হবে। রোববার সাপ্তাহিক বন্ধসহ অন্য পাঁচদিন সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত স্কুলেই থাকতে হয় দুরন্তপনা সিডরকে। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জানালেন, অন্য ছাত্র-ছাত্রীর মতো সিডরকেও বেতন ও অন্যান্য ফি দিতে হয়। এখানে বিশেষ কোনো সুযোগ দেবার তেমন একটা সুযোগ নেই। তবে সরকারিভাবে দেয়া বই তারা পায়।

তিনি জানান, এখানের ছাত্রছাত্রীরা যে ধর্মেরই হোক না কেন তারা স্পনসরকারী ব্যক্তিদের মাধ্যমে লেখাপড়ার খরচ পেয়ে থাকেন। এ বছরও দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র ফিলপিস বিশ্বাসকে এক স্পনসরকারী  লেখাপড়ার খরচ যোগাতে দুই হাজার টাকা দিয়েছে।

সিডরের লেখাপড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে দাদী রেবা সরকার জানান, দাদাসহ তার বাবা মায়ের কষ্টার্জিত টাকা পয়সা দিয়ে সংসারের খরচসহ তার লেখাপড়া চলছে। স্কুলের বেতন ছাড়াও প্রাইভেট বাবদ ৫শ টাকা দিতে হয়। কষ্টের ধন সিডরকে মানুষ করতে যথাসাধ্য চেষ্টা রয়েছে তাদের।

তিনি বলেন, ঝড়ের পর অনেকবার বলেছে সিডরের নামে এই এলাকায় স্কুল করে দেবার কথা। সেই স্কুলে লেখাপড়া শেষে পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হবে সিডরকে।

দুপুরে সিডরের বাড়ি কানাইনগরে গিয়ে দেখা যায়, ঘরের বারান্দায় যিশু খ্রিস্টের ছবির পাশেই টানানো সেই ক্যালেন্ডার। যে ক্যালেন্ডারে মা সাথীর কোলে কাপড়ে জড়ানো হাস্যজ্জ্বল সিডর। ছবিসহ তার নামের বিষয়ে জানতে চাইলে শিশু সিডর কেবলই ছবির দিকে তাকায়। সেদিনের বিভীষিকাময় রাতের কোনো ধারণাই তার মধ্যে আজও প্রস্ফূটিত হয়নি।

দাদা রনজিৎ সরকার বললেন, এই সেই ক্যালেন্ডার যা আমাকে তিনশ` টাকা দিয়ে চট্টগাম থেকে কিনতে হয়েছে।

এমএএস/বিএ