শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারিকরণে সরকারের রেকর্ড
>> ১০টি পাবলিক ও ৪৯টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন
>> দেশে বর্তমানে সরকারি কলেজের সংখ্যা ৬৩৫টি
>> সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ৬৫ হাজারের বেশি
>> সরকারি হয়েছে ২৬,৩৭০টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়
বর্তমান সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারিকরণে রেকর্ড গড়েছে। সরকারি হাইস্কুল ও কলেজবিহীন উপজেলায় একটি করে স্কুল-কলেজ সরকারিকরণ হয়েছে। সারাদেশে ২৬ হাজারের বেশি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ হয়েছে। উচ্চ শিক্ষা নিশ্চিত করতে জেলাপর্যায় ১০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ ৪৯টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করে বিশ্ব ইতিহাসে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বর্তমান সরকার।
বিগত ১০ বছরে শিক্ষা খাতে আওয়ামী লীগ সরকার বিরাট সাফল্য দেখিয়েছি- এমনটি মনে করেন শিক্ষা প্রশাসনের কর্মকর্তারা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সাল পর্যন্ত দেশে সরকারি কলেজ ও সমমানের প্রতিষ্ঠান ছিল ২৮৯টি। ২০১৬ সালে সরকারি স্কুল ও কলেজবিহীন উপজেলায় একটি করে স্কুল ও কলেজ জাতীয়করণের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তার ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে এরই মধ্যে ৩৩০টি স্কুল ও ৩০১টি কলেজ জাতীয়করণে সম্মতি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সম্মতিপ্রাপ্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো মাউশির (মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর) কর্মকর্তারা সরেজমিন পরিদর্শন করে স্থাবর, অস্থাবর সম্পদ, শিক্ষক-কর্মচারীদের ব্যক্তিগত তথ্যসহ আনুষঙ্গিক সব তথ্য সংগ্রহ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী, এরই মধ্যে ২৯৯টি কলেজ সরকারি করা হয়েছে। এর বাইরে আরও ৪০টি কলেজ সরকারি করা হয়েছে। আর সাতটি নতুন সরকারি কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সব মিলিয়ে দেশে বর্তমানে সরকারি কলেজের সংখ্যা ৬৩৫টি।
অপরদিকে, প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতির ৩৩০টি স্কুলের মধ্যে ২৮৯টি স্কুল সরকারি করা হয়েছে। আর অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্মতির জন্য নয়টি পাঠানো হয়েছে। মামলা জটিলতায় আটকে আছে চারটি স্কুল। বাকিগুলো প্রধানমন্ত্রীর চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। আগে দেশে সরকারি হাইস্কুল ছিল ৩১৭টি। আওয়ামী লীগ সরকারের টানা দুই মেয়াদে ১১টি নতুন সরকারি হাইস্কুল স্থাপনসহ ২৯৬টি স্কুল সরকারি করা হয়েছে। ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরে আরও ১৯টি হাইস্কুল স্থাপনের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।
স্বাধীনতার পরে গত ১২ আগস্ট একযোগে ২৭১টি কলেজ সরকারি করে রেকর্ড গড়ে সরকার। এর আগে, দেশে সরকারি কলেজ ও সমমানের প্রতিষ্ঠান ছিল মাত্র ২৮৯টি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. সোহরাব হোসাইন ও কলেজ উইংয়ের প্রধান অতিরিক্ত সচিব ড. মোল্লা জালাল উদ্দিনের দক্ষ নেতৃত্বে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ছাড়াই কলেজ সরকারি করার কর্মযজ্ঞটি সম্পন্ন হয়েছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে অতিরিক্ত সচিব (কলেজ) ড. মোল্লা জালাল উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘কলেজ সরকারিকরণের মূল প্রতিবন্ধকতা ছিল প্রতিষ্ঠানগুলো সরেজমিন পরিদর্শন। মাউশির নয়টি অঞ্চলের পরিচালকদের মাধ্যমে পরিদর্শন করানো হয়েছে। তাদের কঠোর বার্তা দেয়া হয়েছিল যে, কারও বিরুদ্ধে হলুদ খাম (ঘুষ) নেয়ার অভিযোগ পেলে সাদা খাম (শাস্তিমূলক ব্যবস্থা) ধরিয়ে দেয়া হবে।’
‘কোনোভাবেই ক্ষমা করা হবে না। তিনটি গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমেও পরিদর্শন তদারকি করা হয়েছে। অধ্যক্ষদের ডেকে বলা হয়েছিল, পরিদর্শন কর্মকর্তাদের শুধু সাদামাটা আপ্যায়নের ব্যবস্থা করবেন। এর বাইরে কোনো ধরনের সুবিধা দেয়ার অভিযোগ পেলে আপনাদের (অধ্যক্ষ) বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে। মন্ত্রণালয়ের কঠোর অবস্থানের কারণে কোনো ধরনের অভিযোগ ছাড়াই সরকারিকরণের কর্মযজ্ঞটি শেষ হয়েছে।’
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে কলেজগুলো পরিদর্শন কার্যক্রম শুরু করলে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির নেতারা জাতীয়করণ করা কলেজ শিক্ষকদের ‘নন-ক্যাডার’ ঘোষণার দাবিতে ক্লাস বর্জনসহ নানা কর্মসূচি পালন করেন। অপরদিকে, সরকারিকরণ করা কলেজ শিক্ষক সমিতির নেতারা দাবি করেন, ১৯৭৮ সাল থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ হয়ে আসছে।
এছাড়া ১৯৮১, ১৯৯৮ ও ২০০০ সালের বিধিমালা অনুযায়ী আত্তীকৃত শিক্ষকরা ক্যাডার মর্যাদা পেয়ে আসছেন। আত্তীকৃত শিক্ষকদের আরও সুযোগ-সুবিধা দেয়ার দাবিতে তারাও নানা কর্মসূচি পালন করেন। দুই পক্ষের অনড় অবস্থানের কারণে সারাদেশের কলেজগুলো উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। শিক্ষার্থীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হন।
আরও পড়ুন >> বদলে যাচ্ছে প্রাথমিকের পাঠদান
উভয় পক্ষকে খুশি রেখে শিক্ষা মন্ত্রণালয় গত ৩১ জুলাই ‘সরকারি কলেজ শিক্ষক ও কর্মচারী আত্তীকরণ বিধিমালা-২০১৮’ জারি করে। নতুন বিধিমালা অনুযায়ী, গত ১২ আগস্ট থেকে কয়েক ধাপে ২৯৬টি কলেজ সরকারি করা হয়েছে। নতুন বিধিমালা অনুযায়ী এসব কলেজের শিক্ষকরা ‘নন ক্যাডার’ মর্যাদা পাবেন। অন্য কলেজে বদলি হতে পারবেন না। তবে সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) মাধ্যমে পরীক্ষা দিয়ে পাস করলে ক্যাডার মর্যাদা পাবেন।
এ ব্যাপারে অতিরিক্ত সচিব (কলেজ) ড. মোল্লা জালাল উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, জাতীয়করণ করা কলেজের শিক্ষকদের ক্যাডারভুক্তির বিষয়ে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির আপত্তি ছিল। ওইসব কলেজের শিক্ষকদেরও ক্যাডারভুক্তির দাবি ছিল। আবার অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষদের দাবি ছিল স্বপদে বহাল থাকার। এজন্য আমরা ‘উইন উইন সিচুয়েশনে’ অর্থাৎ উভয় পক্ষকে সন্তুষ্ট করে এই সমস্যার সমাধান করছি। এখন সব কলেজে এক সঙ্গে দ্রুত পদ সৃজনের কাজ শুরু হয়েছে।
হাইস্কুলে সরকারিকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে মাউশির কর্মকর্তারা। জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক (মাধ্যমিক) প্রফেসর ড. সরকার আবদুল মান্নান জাগো নিউজকে বলেন, ‘একটি স্কুল যখন সরকারি হয়, তখন সবচেয়ে বেশি উপকৃত হন শিক্ষার্থীরা। সরকারি স্কুলে অনেক সুবিধা বেড়ে যায়। শিক্ষার্থীরা কম খরচে পড়তে পারেন। শিক্ষকদের মান অনেক ভালো হয়। তাদের জীবনের মানও বেড়ে যায়।’
‘এছাড়া টিচিং লার্নিংসহ শিক্ষার সরকারি সব সুবিধা পায় স্কুলটি। সবকিছু মিলিয়ে যেখানে স্কুল সরকারি হয়, সেখানে শিক্ষার বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে।’ তিনি আরও বলেন, ‘অনেক ভালো একটি উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সরকার যে খাতগুলোতে ইনভেস্ট করে তার মধ্যে শিক্ষা হচ্ছে অন্যতম। শিক্ষা হচ্ছে সবচেয়ে মানসম্মত টাকার বিনিয়োগ। যতগুলো স্কুল সরকারি হবে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা তত বেশি উপকৃত হবেন। আমাদের শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত হবে।’
প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারিকরণ : স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একসঙ্গে ৩৬ হাজার ১৬৫টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করেছিলেন। তখন এক লাখ ৫৫ হাজার ২৩ জন শিক্ষক সরকারি হন। ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পরে জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা তার পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে ২৬,৩৭০টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারি করেন।
আরও পড়ুন >> ‘কোটি টাকা দিয়েও প্রাথমিকের শিক্ষক হওয়া যাবে না’
২০১৩ সালের ৯ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাজধানীর জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে শিক্ষকদের বিশাল সমাবেশে বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারি করার ঐতিহাসিক ঘোষণা দেন।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী কয়েক দফায় ২৬,৩৭০টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারি করা হয়েছে। সরকারি করার আগে নিবন্ধিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রশিক্ষণবিহীন প্রধান শিক্ষকদের মাসিক বেতন ছিল পাঁচ হাজার ৫০০ টাকা ও প্রশিক্ষণবিহীনদের পাঁচ হাজার ২০০ টাকা। আর প্রশিক্ষণ করা সহকারী শিক্ষকদের মূল বেতন চার হাজার ৯০০ টাকা এবং প্রশিক্ষণবিহীনদের চার হাজার ৭০০ টাকা। এর বাইরে বেসরকারি শিক্ষকরা বাড়িভাড়া মাসে সর্বসাকুল্যে ২০০ ও চিকিৎসা ভাতা ২০০ টাকা করে পেতেন।
এছাড়া বছরে একটি উৎসব ভাতা দু'বারে ভাগ করে দেয়া হতো। সরকারি করার ফলে এক লক্ষাধিক শিক্ষক এখন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মতো সকল ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার বাইরে ‘বিদ্যালয়বিহীন ১৫০০ গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন’ প্রকল্পের মাধ্যমে ১,৪৯৫টি স্কুল নির্মাণ কাজ শেষ করে চালু হয়েছে। এর সুফল পাচ্ছে পিছিয়ে পড়া দুর্গম এলাকার শিক্ষার্থীরা।
সম্প্রতি প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী অ্যাডভোকেট মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় ২৬ হাজারের বেশি প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারিকরণ হয়েছে। সব মিলিয়ে সারাদেশে ৬৫ হাজারের বেশি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এমন কোনো স্থান নেই যেখানে দুই কিলোমিটারের মধ্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও কলেজ সরকারি করেই থেমে থাকেননি। উচ্চ শিক্ষা জেলা পর্যায় ছড়িয়ে দিতে নতুন ১০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও ৪৯টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেছে সরকার। এর মধ্যে অনেকগুলো বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে বলে মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
এমএইচএম/এমআরএম/এমএআর/জেআইএম