‘ভুতুড়ে’ গ্রামে এখন শহুরে আলোর মেলা
‘সন্ধ্যার পর ভুতুড়ে রূপ নামতো এ পাড়ায়। নদীপাড় ঝোপ-জঙ্গলে ভরা ছিল। যে জায়গায় বসে চা খাচ্ছেন, সেখানে রাত হলেই শিয়ালের আনাগোনা থাকতো। ১০ বছর আগের কথা বলছি। এখন এখানে বাজার বসছে। ঘরে ঘরে আলো। সড়কেও আলো। সবই প্রাণ-আরএফএল ফ্যাক্টরির কল্যাণে। একটি কারখানা এলাকার কী পরিবর্তন আনতে পারে, তা নিজের চোখেই দেখলাম।’
আরও পড়ুন >> প্রাণ এ্যাগ্রোতে ৫ টাকায় দুপুরের খাবার
কথাগুলো বলছিলেন গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার মূলগাঁও গ্রামের দোকানদার তাজউদ্দীন। মূলগাঁওয়ে আরএফএল ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের পাশেই ৭০ বছর বয়সী তাজউদ্দীনের দোকান। প্রাণ-আরএফএল ফ্যাক্টরি প্রতিষ্ঠার পর নিজের জীবনের পরিবর্তনের পাশাপাশি গ্রামের উন্নয়নের কথাও শোনান এ বৃদ্ধ। দোকানের বেঞ্চে বসা রতন মিয়াও গ্রামের নানা উন্নয়নের কথা তুলে ধরলেন হাতের ইশারায়।
‘ওই যে দেখছেন তিনতলা স্কুল, পুরো ভবনটিই প্রাণ-আরএফএল কোম্পানি করে দিয়েছে। স্কুলের শিক্ষকদের বেতনের বড় একটি অংশ এই কোম্পানি দিয়ে থাকে। ফ্যাক্টরির পাশে মসজিদ। গ্রামের মুসল্লিরা এখানে নামাজ আদায় করেন। মসজিদটির দোতলার কাজ সম্পন্ন হয়েছে। তৃতীয় তলার কাজ চলছে। ফ্যাক্টরি-সংলগ্ন হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য একটি আধুনিকমানের শ্মশানও তৈরি করে দিয়েছে প্রাণ-আরএফএল। মরদেহ পোড়াতে এখন আর কষ্ট করতে হয় না হিন্দুদের। এমন হাজারও উন্নয়নের কারিগর হিসেবে কাজ করছে প্রাণ-আরএফএল কর্তৃপক্ষ। এই কোম্পানি আমাদের জন্য আশীর্বাদ’- হাত উঁচিয়ে উঁচিয়ে দেখিয়ে কথাগুলো বলেন রতন।
তাজউদ্দিন বা রতনের মতো মূলগাঁও গ্রামের বাসিন্দারা প্রাণ-আরএফএল ফ্যাক্টরিকে সত্যিই এখন আশীর্বাদ জানে। এই কারখানা তাদের নিজেদেরই প্রতিষ্ঠান বলে মনে করেন। গ্রামের মানুষের সুখ-দুঃখে যেমন আরএফএল, তেমনি গ্রামবাসীও কারখানার ভালো-মন্দের ভাগীদার।
২০০৯ সালে মূলগাঁওয়ে শীতলক্ষ্যার শীতল তীরে প্রাণ-আরএফএল ফ্যাক্টরির যাত্রা শুরু। ১০ বছরে কারখানার পরিধি বেড়েছে কয়েকগুণ। ২৫ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত কারখানায় বর্তমানে নয় হাজার শ্রমিক কাজ করছেন। ৯০ ভাগ শ্রমিকই নারী। এর মধ্যে ৮০ ভাগ শ্রমিক মূলগাঁও এবং এর আশপাশের গ্রামের। যাদের অধিকাংশই অষ্টম শ্রেণির সনদ দিয়ে চাকরি পেয়েছেন।
অল্পশিক্ষিত বেকার তরুণ-তরুণীরা এখানে কাজ পাওয়ায় গ্রামের পুরোচিত্র পাল্টে গেছে। বেকারত্বের অভিশাপ নিয়ে তরুণরা এখন নেশায় ডুবে থাকছে না। অসামাজিক কার্যকলাপও কমে গেছে। শিক্ষার হারও বাড়ছে। একই পরিবারের একাধিক ব্যক্তি চাকরি করছেন প্রাণ-আরএফএল ফ্যাক্টরিতে। আয় বাড়ছে সংসারে। অভাবের তাড়নায় স্কুলপড়ুয়ারা আর ঝরেও পড়ছে না।
আরও পড়ুন >> অজপাড়া গাঁয়ের নারী শ্রমিকরাও টাকা তোলেন বুথ থেকে
ফ্যাক্টরি কর্তৃপক্ষ জানায়, এ বছর মূলগাঁও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের (সম্প্রতি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়েছে) একটি ভবন নির্মাণে তারা ৬৫ লাখ টাকা ব্যয় করেছে। স্কুলের শিক্ষকদের বেতন বাবদ দেয়া হয়েছে ১২ লাখ ৬০ হাজার টাকা। গ্রামের একটি মসজিদ নির্মাণে দেয়া হয়েছে ১৬ লাখ টাকা। ফ্যাক্টরির পাশে নদীর তীরে দুই লাখ টাকা ব্যয়ে শ্মশান ঘাট পাকা করে দেয়া হয়েছে, যার উদ্বোধন করেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি। শ্মশানে একটি পাকা ছাদের ঘরও করে দেয়া হয়েছে।
রোদ বা বৃষ্টিতে মরদেহ পোড়াতে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের এখন আর কষ্ট করতে হয় না। গ্রামের পয়ঃনিষ্কাশনের জন্য ২৩ লাখ টাকা ব্যয়ে ড্রেনেজ ব্যবস্থা এবং প্রধান সড়কে ৬০ হাজার টাকা ব্যয়ে বৈদ্যুতিক বাতি সংযুক্ত করেছে আরএফএল।
কোম্পানির বদৌলতে নদীর পাড়ে অবস্থিত এ গ্রামে এখন শহুরে আলোর মেলা। গ্রামের প্রায় প্রতি বাড়ি থেকে কেউ না কেউ চাকরি করছেন এ কারখানায়। মেস বা বাড়ি ভাড়া দিয়েও অনেকের দিন ফিরেছে। আবার ব্যবসার পথও সুগম হয়েছে অনেকের। সর্বোপরি গ্রামের মানুষের আত্মনির্ভরশীলতায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে আরএফএল কোম্পানি।
রতন চন্দ্র দাস নামের এক যুবক এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমাদের সম্প্রদায়ের কেউ মারা গেলে কষ্টের সীমা থাকতো না। শ্মশানটি পাকা করতে দ্বারে দ্বারে ঘুরেছি। কেউ সাড়া দেয়নি। প্রাণ-আরএফএল কোম্পানি এখানে আসার পর তারা শ্মশান ঘাটটি পাকা করে দেয়। ছাদ করা ঘরও করে দেয়। এখন ঘাট পর্যন্ত পাকা রাস্তা। আমরা যেখানে চেয়েছি, সেখানেই শ্মশান ঘাটটি নির্মাণ করে দিয়েছে।’
মূলগাঁও পৌর ওয়ার্ড কমিশনার আলহাজ আমির হোসেন বলেন, ‘প্রাণ-আরএফএল ফ্যাক্টরিকে আমরা নিজেদের মনে করি। গ্রামবাসী জমি দিয়েছে। এখন আমরা ফলাফল ভোগ করছি। হাজার হাজার তরুণের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়েছে। অনেকেই ব্যবসা করার সুযোগ পেয়েছেন ফ্যাক্টরি ঘিরে। এই ফ্যাক্টরির উন্নয়ন মানেই গ্রামের সার্বিক উন্নয়ন।’
আরও পড়ুন >> হাজার কৃষকের সফল গল্পের কারিগর প্রাণ এ্যাগ্রো
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের জ্যেষ্ঠ মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) সামসুল আলম মিয়ার সঙ্গে কথা হয় এ প্রসঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ব্যবসার সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই আমরা এলাকার উন্নয়নে অংশ নিচ্ছি। গ্রামের মানুষরাও আমাদের পাশে রয়েছেন। উন্নয়নের পাশাপাশি যে কোনো অনুষ্ঠান বা উৎসবে আমাদের সর্বোচ্চ অংশীদারিত্ব থাকে বলে মনে করি।’
এএসএস/এসআর/আরএস/আরআইপি