কী হবে অক্টোবর-নভেম্বর-ডিসেম্বরে?
রাজনীতির পারদ এখন ঊর্ধ্বমুখী। নির্বাচন ঘিরে উত্তেজনা যেন বাঙালির নিয়তির লেখা। উদ্বেগ আর অনিশ্চয়তা রাজনৈতিক সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশও এখন। নির্বাচন প্রশ্নে প্রায় অর্ধশত (সাড়ে ৪৭ বছর) বছরের বাংলাদেশ নাজুক বলেই মনে করেন বিশ্লেষকরা।
অক্টোবরেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা। সব ঠিক থাকলে ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ নির্বাচন। দিন যতই ঘনিয়ে আসছে রাজনীতির বাতাস ততই গরম হচ্ছে।
কেমন হবে নির্বাচন? বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনেই নাকি অন্য কোনো সরকারব্যবস্থায়? ভাঙা-গড়ার রাজনীতিতে দল-জোটগুলোর ভূমিকা কী হবে? বিএনপি-জামায়াত কি আদৌ নির্বাচনে অংশ নেবে, নাকি কারাবন্দি খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবি তুলে আন্দোলন চাঙা করবে? জাতীয় ঐক্যের মেলবন্ধনে বিএনপি গাঁটছড়া থাকবে কিনা, নাকি জামায়াত আর আসন বণ্টন ইস্যুতে ফসকে যাবে? বিরোধীপক্ষের আন্দোলনে আদৌ কোনো ফল আসবে কিনা- এমন সব প্রশ্ন এখন জনমনে।
সংঘাত এড়াতে পুলিশ প্রশাসনের অ্যাকশন
রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং দায়িত্বশীল গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক সূত্র জানিয়েছে, অক্টোবরের মাঝামাঝি সরকারবিরোধী আন্দোলন চাঙা হতে পারে। তফসিল ঘোষণার আগেই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিরোধীপক্ষের তৎপরতা স্পষ্ট হবে। এরপর অপেক্ষা তফসিলের। তফসিল ঘোষণার পরই মাঠ দখলের চেষ্টা করবে বিএনপি-জামায়াত শক্তি।
বিএনপির একটি সূত্র জানিয়েছে, জাতীয় ঐক্য করতে গিয়ে নানা কৌশল নিতে হচ্ছে দলটিকে। কৌশলগত কারণেই জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিতে পারে দলটি।
সূত্রটি মনে করে, শেখ হাসিনার সরকার পতনের জন্য জাতীয় ঐক্যের সঙ্গে বিএনপির জোটবদ্ধ হওয়া যেমন জরুরি, তেমনি আন্দোলনের মাঠে জামায়াতের সমর্থন পাওয়াও জরুরি। আন্দোলন ছাড়া সরকারের পতন ঘটবে না, তা এখন অনেকটাই প্রমাণিত। এ কারণে নভেম্বরে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে।
আন্দোলনের বিষয়ে কথা হয় জামায়াতের ছাত্র সংগঠন শিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি এবং বর্তমান জামায়াত নেতা মুহাম্মদ দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর সঙ্গে। তিনি অবশ্য আন্দোলনের ব্যাপারে স্পষ্ট করে কিছু বলেননি।
জামায়াতের এই নেতা বলেন, ‘স্বৈরনীতির সব সীমা অতিক্রম করেছে সরকার। আমরা রাজনীতির গতিপথ পর্যবেক্ষণ করছি। জোটে থাকা না থাকা নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না। জালিম সরকারের পতন জরুরি। এ জন্য জামায়াত নিজস্ব শক্তি নিয়েই মাঠে নামবে।’
সাঈদী বলেন, ‘সরকার ফের গণগ্রেফতার শুরু করেছে। সামনের তিন মাসে গ্রেফতার, হামলা, গুমের ঘটনা বেড়ে যেতে পারে। তবে আমরা সংসদ ভেঙে দেয়ার অপেক্ষায় আছি।’
গোয়েন্দাদের একটি সূত্র জানায়, ‘নির্বাচনকালীন সরকারে যদি শেখ হাসিনাই প্রধান থাকেন এবং বিরোধীপক্ষ যদি নির্বাচনে অংশ নিতে চায় তাহলে পরিস্থিতি অন্যরকম হতে পারে। নির্বাচনকালীন সরকারকে বিতর্কমুক্ত রাখতে প্রশাসনকে নিরপেক্ষ রাখতে হবে। আর প্রশাসন নিরেপক্ষ থাকলে বিএনপি-জামায়াত পূর্ণশক্তি নিয়ে মাঠে নামতে চাইবে। তখন সরকারদলীয় সংগঠনের সঙ্গে তাদের সংঘাত বাড়তে পারে। যেটা নির্বাচনকালীন সরকার এবং নির্বাচনের ওপর প্রভাব ফেলবে। এই আন্দোলন অক্টোবরের শেষ দিকে শুরু হতে পারে, যা চূড়ান্ত রূপ নেবে নভেম্বর-ডিসেম্বরে।’
আওয়ামী লীগের একটি সূত্রও এমন আন্দোলনের কথা উল্লেখ করেছে। সূত্রটি মনে করছে, এবার বিএনপি-জামায়াত ভিন্ন কৌশলে মাঠে নামবে। তারা গতবারের আন্দোলনে জনধিকৃত হয়। আর এবার আন্দোলনের ক্ষেত্র তৈরি করে দিতেই ড. কামাল হোসেনরা জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছেন। তাদের এই ঐক্যই রাজনীতিতে সন্দেহ তৈরি করেছে।
২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে বিরোধীপক্ষের ভাঙচুর অগ্নিসংযোগ
তবে আওয়ামী লীগ সব ধরনের আন্দোলন মোকাবেলায় প্রস্তুত এবং বিকল্প নানা পন্থাও সামনে রয়েছে বলে জানায় সূত্রটি।
নির্বাচন ও রাজনীতির প্রসঙ্গ নিয়ে কথা হয় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক শ ম রেজাউল করিমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে অনানুষ্ঠানিক ম্যাসেজ আছে। তারা চাচ্ছে যে কোনো মূল্যে সরকারের পতন ঘটাতে। ড. কামালরা বলছেন, ক্ষমতায় গেলে তারা নাকি প্রথম দুই বছরেই সব ঠিক করে ফেলবেন। আমাদের ধারণা, বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের মূল টার্গেট শেখ হাসিনা। গণতন্ত্রের কথা তারা মুখে বলছেন। কিন্তু তাদের কর্মকাণ্ড থেকে ভিন্ন অর্থ মিলছে।’
তিনি বলেন, ‘সমস্ত ষড়যন্ত্রের মা হচ্ছে গোপনীয়তা। প্রযুক্তির যুগ। কী কথা হচ্ছে, কাদের সঙ্গে কথা হচ্ছে, তা আমরাও জানতে পারছি। তবে সামনের তিন মাসে সব ধরনের ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় প্রস্তুত আছে আওয়ামী লীগ।’
রাজনীতি ও আন্দোলন প্রসঙ্গে কথা হয় জাতীয় ঐক্যের আহ্বায়ক ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘১ অক্টোবর সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছি। আমরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমে এই সরকারের পতন চাই। দলীয় সরকারের অধীনে কোনোভাবেই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। সরকারের সিদ্ধান্তের ওপরই নির্ভর করবে আমাদের আন্দোলনের রূপরেখা।’
তবে রাজনীতির বাইরেও সামনের তিন মাসে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হতে পারে বলে গোয়েন্দারা মনে করছেন। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন, নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন, সরকারি কর্মচারীদের বিভিন্ন দাবি, শিক্ষক আন্দোলন, জঙ্গি তৎপরতা, পুলিশে সুপারনিউমারারি (আবশ্যিক সংখ্যার অতিরিক্ত) পদ সৃষ্টি নিয়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে পারে। নির্বাচন ঘিরে বিদেশিসহ অন্য শক্তিও তৎপর হতে পারে।
অন্যদিকে সরকারের সুরক্ষায় পুলিশ প্রশাসনও শক্ত অবস্থান নেবে বলে মনে করছে সংশ্লিষ্ট মহল। পুলিশ সদর দফতর বলছে, নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপিসহ কোনোপক্ষকেই আন্দোলনে নামার সুযোগ দেয়া হবে না। এ নিয়ে নানাভাবে নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়েছে। আগের মামলায় চিহ্নিতদের গ্রেফতারের নির্দেশনাও রয়েছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ ড. আকবর আলি খান এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘দুই রাজনৈতিক জোটের যে অবস্থান তাতে সংকটের সমাধান হবে বলে মনে হয় না। তারা যদি সংকটের সমাধান না করে তাহলে পরিণাম ভয়াবহ হবে।’
তিনি বলেন, দেশের সংকট সমাধানে সিভিল সমাজের কিছু করার আছে। কিন্তু তারা কিছু করছে না। এখন তারা না করলেও আমাদের কিছু একটা করতে হবে। আমি আশাবাদী, যে জাতি মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বিজয় অর্জনে সক্ষম, তারা পথ হারাবে না।
সুশাসনের জন্য নাগরিক’র (সুজন) সাধারণ সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘এখন সংকট আরও ঘনীভূত হচ্ছে। রাত যত গভীর হয়, ভোর তত ঘনিয়ে আসে। আমরা চরম সংকটের মুখোমুখি। তাই আশা করি যে, আমাদের রাজনীতিবিদরা আরও দায়িত্বশীল হবেন এবং একটি রাজনৈতিক ঐকমত্য গড়ে তুলবেন।’
এএসএস/জেডএ/এমএআর/আরআইপি