একত্রিত হলেই রাজনীতির মাঠে ঐক্য অটুট থাকে না
ড. আকবর আলি খান। অর্থনীতিবিদ। গবেষণা করছেন সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা নিয়ে। সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা। অধ্যাপনা করছেন বেসরকারি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে।
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র। আলোচনায় উঠে আসে রাজনীতির চলমান সংকট ও অন্যান্য প্রসঙ্গ। গণতন্ত্রের উন্নয়নে আনুপাতিক হারে নির্বাচনের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের হস্তক্ষেপ উভয় দেশের জন্য অশুভ বলেও মত দেন। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে শেষটি।
জাগো নিউজ : রাজনীতির বিভাজন সর্বত্রই। এই বিভাজনে সমাজের উপর কী প্রভাব পড়লো?
আকবর আলি খান : রাজনীতির বিভাজন সমাজের অপূরণীয় ক্ষতি করলো। এই রাজনীতি ভালো লোকের জায়গা সংকুচিত করে দিচ্ছে আর খারাপ লোকগুলোকে প্রতিষ্ঠিত করা হচ্ছে। মানুষ রাষ্ট্র ও সমাজের মূল দায়িত্ব থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। আর অযোগ্যরা ক্ষমতা দখল করছে।
আরও পড়ুন >> আলোচনায় বসলেই সমাধান কিন্তু তারা বসবেন না
এই পরিস্থিতির পরিবর্তনে রাজনীতির-ই পরিবর্তন জরুরি। পরিবর্তন অসম্ভব নয়। হানাহানি চলতে থাকলে দলগুলোর মধ্যেও চিন্তার পরিবর্তন আসতে পারে। সমস্যার সমাধান নিয়ে যখন তাদের মধ্যে প্রশ্ন দেখা দেবে তখনই আমরা মুক্তির পথ পাবো।
একে-অপরের প্রতি অসহনশীল হওয়ার প্রবণতা বড় দুই দলের মধ্যে আছে। আওয়ামী লীগ এখন যে ভাষায় কথা বলছে, বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে একই ভাষায় কথা বলেছে। সরকারি দলে থাকলে আচরণ ও ভাষা বদলে যায়। বিএনপির এখন যে নমনীয় চেহারা তা ক্ষমতায় গেলে থাকবে কিনা- তা নিয়ে সন্দেহ আছে। কারণ বিএনপির অতীতও এ দেশের মানুষ জানে।
জাগো নিউজ : সাধারণ মানুষের প্রতি ভরসা রাখছেন কতটুকু? মুক্তি পেতে সাধারণ মানুষ কি ঘুরে দাঁড়াতে পারে?
আকবর আলি খান : মানুষের ঘুরে দাঁড়ানো অসম্ভব নয়। আমরা ঘুরে দাঁড়াতে দেখেছি। তবে কবে, কীভাবে দাঁড়াবে- তা বলা যাচ্ছে না। অপেক্ষা করতে হবে।
তবে আমি মনে করি, যা-ই ঘটুক, তা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ঘটতে হবে। রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ছাড়া কারও পক্ষে পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। রাজনৈতিক কোনো শক্তিকে যদি বসানো যায়, তাহলে তার ভাবশিষ্যরা পরিবর্তনে সহায়তা করতে পারবে। কিন্তু অন্য কেউ আসলে আমলাতন্ত্রের সহায়তা নিতে হবে। আমলাতন্ত্র দিয়ে এই পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে না।
জাগো নিউজ : অন্য কোনো শক্তি বলতে কী বোঝাচ্ছেন?
আকবর আলি খান : অনেক কিছুই তো দেখলাম। শক্তির ব্যাপারে সবাই অবগত। আকস্মিকভাবে ক্ষমতায় এসে নানা খেল দেখাতেই পারে। কিন্তু তাতে লাভ হবে না। তারা স্থায়ী কোনো পরিবর্তন আনতে পারবে না। এই উপলব্ধি রাজনৈতিক দলগুলোরও জানা আছে। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, তারা ভুলে যায়।
জাগো নিউজ : জাতীয় ঐক্য গড়ার প্রত্যয়ে ড. কামাল হোসেনরা চেষ্টা চালাচ্ছেন, হয়তো আপনি অবগত আছেন। এই চেষ্টাকে কীভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন?
আকবর আলি খান : আমাদের রাজনীতি দুষ্ট হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে, অধিক মাত্রায় বিভাজন। বিভাজনই রাজনীতির বেশি ক্ষতি করেছে। বিশেষ করে বামপন্থী নেতারা চরম আস্থার সংকটে ভোগেন। তাদের অনেকেই লেনিন বা মাও সেতুং হতে চান এবং ক্ষুদ্র বিষয় নিয়ে বিভক্তি সৃষ্টি করেন। দল ছেড়ে এসে প্রত্যেকে আবার নতুন দল খুলছেন। বাংলাদেশের ইতিহাস তা-ই বলে। যারা ঐক্যের কথা বলছেন, তারাই রাজনীতিকে বেশি বিভাজিত করেছেন।
এই পরিস্থিতির মধ্যে ঐক্যের প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানাই। বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতারা বুঝতে পারেন যে, সবার পক্ষে লেনিন বা মাও সেতুং হওয়া সম্ভব নয়। পরিবর্তনের জন্য তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি কাঠামো দাঁড় করায়, তাহলে সেটা ভালো কিছু হবে বলে মনে করি। কিন্তু ঐক্য হলেই যে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
আরও পড়ুন >> সাধারণরা এগোতে চায়, রাজনীতিকরা পিছিয়ে দেয়
জাগো নিউজ : তবুও এই ঐক্য প্রচেষ্টাকে ইতিবাচকভাবে দেখা যায় কিনা?
আকবর আলি খান : আমি তো এই চেষ্টাকে সাধুবাদ জানালাম। বিভক্তির ধারা যত কমবে, সমাজে ও রাজনীতিতে তত শান্তি প্রতিষ্ঠা পাবে। যারা ঐক্যের কথা বলছেন, তারা বিভিন্ন দল থেকে বেরিয়ে আসা। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তারাও নানাভাবে হতাশার জন্ম দিয়েছেন। বিভক্তির রাজনীতি থেকে বেরিয়ে এসে তারা কতটুকু ঐক্য তৈরি করতে পারবেন, তা নিয়ে জনমনে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। একত্রিত হলেই রাজনীতির মাঠে ঐক্য অটুট থাকে না।
জাগো নিউজ : ভারত প্রসঙ্গে আসি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘ভারত ফ্যাক্টর’ আবশ্যক হয়ে উঠছে। বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের রাজনীতি ভারতমুখী। আপনার বিশ্লেষণ কী?
আকবর আলি খান : ভারত আমাদের অনেক বড় প্রতিবেশী রাষ্ট্র। বাংলাদেশের তিন দিকেই ভারতের সীমানা। ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক অচ্ছেদ্য।
আবার সংখ্যালঘু রাজনীতিও ভারত-বাংলাদেশের জন্য একটি ফ্যাক্টর। বাংলাদেশে যেসব সংখ্যালঘু রয়ে গেছেন, তারাও ভারতের রাজনীতিতে কিছুটা হিসাব-নিকাশের মাত্রা যোগ করেন। এসব কারণে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের প্রভাব।
জাগো নিউজ : কিন্তু ভারতের প্রভাব বিস্তারের মাত্রা বাড়লো কিনা?
আকবর আলি খান : বাংলাদেশে ভারতের প্রভাব আসলে কতটুকু কার্যকর হবে তা সময়ই বলে দেবে।
বাংলাদেশের বিষয়ে ভারত আগে এতো মাথা ঘামায়নি। ইতিহাস তা-ই বলে। কিন্তু ভারত বাংলাদেশের সব বিষয়েই নজর দিচ্ছে। এর কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশে ভারতের বাণিজ্য, অর্থনীতি এবং তাদের জাতীয় নিরাপত্তা- অনেক কিছুই নির্ভর করে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, বাংলাদেশের রাজনীতি ভারতের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, এমনটি মেনে নেয়ার মতো নয়।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরও ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের রাজনীতিতে কোনো হস্তক্ষেপ করেননি। যদিও অনেকে হস্তক্ষেপ প্রত্যাশা করেছিলেন। আমি নিজেও ইন্দিরা গান্ধীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছিলাম ওই সময়ে। কিন্তু হস্তক্ষেপ করেননি। এটা ছিল ইন্দিরা গান্ধীর দূরদর্শী সিদ্ধান্ত। বাংলাদেশের রাজনীতিতে নগ্ন হস্তক্ষেপ না করেও নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে।
জাগো নিউজ : এখন কী বলবেন?
আকবর আলি খান : ভারত আগের নীতি থেকে সরে এসেছে বলে মনে করি। তারা বাংলাদেশের বিষয়ে সরাসরি হস্তক্ষেপের নীতি অবলম্বন করছে।
আরও পড়ুন >> সুষ্ঠু নির্বাচন না দিলে সরকারের পতন অনিবার্য
জাগো নিউজ : এই হস্তক্ষেপের ফল কী হতে পারে?
আকবর আলি খান : বাংলাদেশের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে ভারত বড় ভুল করছে। যে আশায় ভারত এমন আচরণ করছে তা পুরোপুরি পূরণ নাও হতে পারে। কারণ সাধারণ মানুষের আস্থা নষ্ট করছে তারা।
তবে বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারত আসলে কী করতে চাইছে, তা বোঝা মুশকিল। ভারত একটি দেশ। তাদের রাজনীতির সংজ্ঞা ব্যাপক। তাদের রাজনীতি আসলে কোন দিকে সেটাও দেখার বিষয়।
জাগো নিউজ : আপনি হয়তো দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির পরিবর্তন লক্ষ্য করছেন। ভারতের আনুগত্য থেকে অন্য রাষ্ট্রগুলো বেরিয়ে আসছে। বাংলাদেশ পারছে না কেন?
আকবর আলি খান : বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির দৈন্যতা এর একটি কারণ। আবার বাস্তব পরিস্থিতিও দেখতে হবে। ভারতের রাজনীতি পৃথিবীর মধ্যে বিশেষ জায়গা করে নিচ্ছে। ভারতের সামরিক শক্তিকেও এখানে হিসাবে নিতে হচ্ছে।
তবে আমাদের এমন নীতি হওয়া উচিত যে, আমরা ভারতের সঙ্গে খারাপ কোনো সম্পর্কে জড়াবো না, আবার একেবারে আনুগত্যে নতিস্বীকার করবো না। কিন্তু রাজনীতি এমন দ্বান্দ্বিক অবস্থায় গেছে যে, অন্যের প্রতি আনুগত্য চরমে, অথচ নিজের দেশের প্রতি আনুগত্য নেই।
জাগো নিউজ : চীন কীভাবে নজর রাখছে বাংলাদেশে?
আকবর আলি খান : চীন ভিন্ন কৌশলে নজর রাখছে বাংলাদেশে। ভারত আর চীনের নীতি আলাদা। চীন দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আসছে। বাংলাদেশে বিনিয়োগ করছে। কিন্তু চীনের বিনিয়োগ নীতি পুরোপুরি সফল হবে কিনা- তা নিয়ে সন্দেহ আছে এবং এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নীতিতে চীনের পরিবর্তনও আসতে পারে।
জাগো নিউজ : এক বছর পার হলো রোহিঙ্গা সংকট। রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে চুক্তিও হলো। কিন্তু কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই…
আকবর আলি খান : রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে মিয়ানমারের কাছে এখনও বাংলাদেশ স্পষ্ট করে কিছু তুলে ধরতে পারেনি।
আরও পড়ুন >> আওয়ামী লীগ ভারতের কথায় চলে না
বিমসটেক সম্মেলনে বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যে অনেক কথা হয়েছে। কিন্তু রোহিঙ্গা নিয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে বলে আমরা জানতে পারিনি। বাংলাদেশ এখন এই সংকটের সমাধান চায় কিনা- তা নিয়ে মিয়ানমার এখন সন্দিহান।
জাগো নিউজ : কী করা উচিত বাংলাদেশের?
আকবর আলি খান : রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশ তৈরি করেনি। মিয়ানমার করেছে। সুতরাং এ নিয়ে মিয়ানমারের বিপক্ষে যা করার তাই করা উচিত ছিল। যেমন- বিমসটেক সম্মেলনে বাংলাদেশ জোরালো অবস্থান নিয়ে কথা বলতে পারতো। আন্তর্জাতিক আদালতে বাংলাদেশের অবস্থান স্পষ্ট করা দরকার ছিল।
মিয়ানমার যদি মনে করে যে, বাংলাদেশের অবস্থানে অস্পষ্টতা আছে, তাহলে সমস্যার সমাধান হবে বলে মনে করি না।
জাগো নিউজ : রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আলোচনা উঠলে ভারত-চীনের প্রসঙ্গও আসে। বাংলাদেশ তো এ দুটি দেশকে বাগে আনতে ব্যর্থ হয়েছে…
আকবর আলি খান : কিন্তু আলোচনার তো বিকল্প নেই। ভারত, চীন, রাশিয়ার ভূমিকা নিয়েও আলোচনা হতে পারে। মিয়ানমারে এই দেশগুলোর অনেক বেশি স্বার্থ আছে। অস্ত্র বিক্রি, সে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ, বিনিয়োগ নিয়ে ভারত, চীন, রাশিয়ার অন্য হিসাব থাকতেই পারে। তাই বলে বাংলাদেশ তো বলি হতে পারে না। বিশ্বকে এটি বোঝানোর ব্যাপার আছে।
জাগো নিউজ : আসামের বাঙালি সংকট আরেক রোহিঙ্গা সংকট বলে মনে করা হচ্ছে। আপনি কী দেখছেন?
আকবর আলি খান : আসামের বিষয়টি এখনও স্পষ্ট নয়। আসামের বাঙালি সমস্যা ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কারণে। এ নিয়ে সে দেশেই বিতর্ক আছে। পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উদ্যোগ নিয়ে কথা বলছেন। সময় বলে দেবে, আসলে সেখানে কী হচ্ছে?
এএসএস/এমএআর/এমএস