ভিডিও EN
  1. Home/
  2. বিশেষ প্রতিবেদন

আলোচনায় বসলেই সমাধান কিন্তু তারা বসবেন না

সায়েম সাবু | প্রকাশিত: ০৮:৪৩ পিএম, ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৮

ড. আকবর আলি খান। অর্থনীতিবিদ। গবেষণা করছেন সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা নিয়ে। সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা। অধ্যাপনা করছেন বেসরকারি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে।

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র। আলোচনায় উঠে আসে রাজনীতির চলমান সংকট ও অন্যান্য প্রসঙ্গ। গণতন্ত্রের উন্নয়নে আনুপাতিক হারে নির্বাচনের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের হস্তক্ষেপ উভয় দেশের জন্য অশুভ বলেও মত দেন। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে প্রথমটি।

জাগো নিউজ : ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর রাজনৈতিক সংকট নিয়ে এক সাক্ষাৎকারে হতাশা প্রকাশ করেছিলেন। পাঁচ বছর পর ফের নির্বাচন আসছে। এখন কী বলবেন?

আকবর আলি খান : ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ঘিরে রাজনীতিতে যে সংকট তৈরি হয়েছিল, তা কেটে যায়নি বরং ওই নির্বাচন ঘিরে সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে।

জাগো নিউজ : এই ধারণা কি গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি নিয়ে?

আকবর আলি খান : বাংলাদেশে গণতন্ত্রের দরকার আছে। গণতান্ত্রিক আদর্শের ভিত্তিতে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা।

কিন্তু গণতন্ত্র তো হোঁচট খেলো। যে রাষ্ট্রে কার্যকর কোনো বিরোধী দল নেই, সেই রাষ্ট্রে গণতন্ত্র বিধান হতে পারে মাত্র, কিন্তু এর কোনো রূপায়ণ নেই। সুতরাং যে পরিস্থিতির মধ্যে আছি, সেটাকে ঠিক গণতান্ত্রিক পরিবেশ বলা চলে না।

আমরা সবাই চাই, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ধারা প্রতিষ্ঠা পাক, কিন্তু সেটা হবে কি না- তা নিশ্চিত করে বলা যাবে না।

জাগো নিউজ : একবারেই অনিশ্চিত বলছেন? নিশ্চয়তার কোনো আশা থাকতে পারে না?

আকবর আলি খান : যদি রাজনৈতিক দলগুলো একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সহযোগিতা করে, তাহলে অনেক পরিবর্তনই আসতে পারে। কিন্তু এই ধরনের সহযোগিতার কোনো আভাস আমরা দেখতে পাচ্ছি না। সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি নেই। তবে একবারেই নেই, তা বলছি না।

জাগো নিউজ : আমরা উন্নয়নের কথা বলছি, এগিয়ে যাওয়ার কথা বলছি। তবুও স্বাধীনতার অর্ধশত বছরে আমাদের শাসন ব্যবস্থা নিয়ে অনিশ্চয়তার কথা শুনতে হচ্ছে…

আকবর আলি খান : এই বাস্তবতা অস্বীকার করার তো জো নেই। গণতন্ত্র থেকে আমরা অনেক দূরে সরে এসেছি, এটি দিবালোকের মতো সত্য। বাংলাদেশে চলমান পরিস্থিতির পরিবর্তন চাইছে মানুষ। তার মানে দেশে আদর্শিক গণতন্ত্র নেই।

জাগো নিউজ : আজ যে পরিস্থিতি, এর জন্য কোন কারণকে সামনে আনবেন?

আকবর আলি খান : গণতন্ত্রহীন এই পরিস্থিতির জন্য অনেক কারণই আছে। ঐতিহাসিক, ক্ষমতার কেন্দ্রে পরিবার, বংশগত রাজনীতি, ক্ষমতায় এসে আইনের শাসন প্রতিপালন না করার মতো বহু কারণ আছে।

বাংলাদেশে আজকের পরিস্থিতির জন্য কোন কোন বিষয় দায়ী, তার ওপরে আমি বই লিখেছি।

জাগো নিউজ : তার মানে বাঙালি এখনও বাঙালিকে শাসন করতে শিখলো না?

আকবর আলি খান : আমি ঠিক এভাবে মনে করি না। বাঙালি বাঙালিকে শাসন করতে পেরেছে। ইতিহাসে আছে, কঠিন সময়ে বাঙালি বজ্রকঠিন ঐক্য করেছে। তবে তা হয়তো দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। দীর্ঘস্থায়ী ঐক্যের মাধ্যমে দেশ শাসন করতে হলে আমাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে। তবে তা কতদিন, তা সময় ধরে বলা যাবে না।

জাগো নিউজ : এমন অপেক্ষার মধ্যেও কি সমাধানের পথ নিয়ে কথা বলা যেতে পারে? নাকি রক্তপাত...

আকবর আলি খান : রক্তপাতের ঘটনাও ঘটতে পারে। আবার অন্যভাবেও সমাধান আসতে পারে। রক্তের দাগ তো আমরা রাজনীতিতে দেখেছি।

এ নিয়ে আমার দুই ধরনের মত আছে। বর্তমান সংবিধানের আলোকে সমাধান অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়বে। যদি সাংবিধানিক কাঠামোতে পরিবর্তন আনা হয়, তাহলে সমাধান তাড়াতাড়ি হতে পারে।

জাগো নিউজ : সাংবিধানিক কাঠামোর পরিবর্তনটা কী হতে পারে?

আকবর আলি খান : নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে ক্ষমতার বণ্টন। এ জন্য সংবিধানের পরিবর্তন জরুরি। রেফারেন্ডাম (গণভোট) ব্যবস্থা প্রবর্তনের প্রয়োজন রয়েছে এখানে। দ্বিতীয়ত, নির্বাচন কমিশনে অনেক সংস্কারের দরকার আছে বলে আমি মনে করি।

জাগো নিউজ : বারবার ঠেকতে হচ্ছে। ঠেকেও কেন আমরা সমাধানের পথে হাঁটতে পারছি না?

আকবর আলি খান : সমাধানের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর আগ্রহ নেই। হতাশার কথা মূলত এখানেই। রাজনৈতিক দলগুলো যদি সাংবিধানিক কাঠামো পরিবর্তনের কথা বলতো তাহলে হতাশা কেটে যেতো। কিন্তু এ নিয়ে তাদের কোনো উৎসাহ নেই।

আনুপাতিক হারে যদি নির্বাচন হয় তাহলে দেখা যাবে, কোনো রাজনৈতিক দলই নিরঙ্কুশ বিজয় পাবে না। আনুপাতিক হারে নির্বাচন হলে সমঝোতা হবে, স্বেচ্ছাচারিতা কমে আসবে। রাজনৈতিক দলগুলো যদি অনুধাবন করতে পারে যে, পরস্পর পরস্পরকে সহযোগিতা করতে না পারলে ক্ষমতায় আসা যাবে না, তাহলে হিংসা-বিদ্বেষ অনেক কমে আসবে।

আনুপাতিক হারে নির্বাচন হলে রাজনীতিতে যে সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি, তারও বড় একটি পরিবর্তন ঘটবে।

জাগো নিউজ : তার মানে নিরঙ্কুশ বিজয়ই আজকের সংকটের জন্য অন্যতম কারণ?

আকবর আলি খান : যারা ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসছে, তারা কেউই ৫১ শতাংশের বেশি ভোট পায় না। ৪০ বা ৪২ শতাংশ ভোট পেয়েই ক্ষমতায় আসছে। ভারতেও তাই। মোদি সরকার ৩৩ শতাংশ ভোট নিয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে। এ কারণেই আমি মনে করি, ভোটের আনুপাতিক হার নিয়ে পর্যালোচনার প্রয়োজন রয়েছে।

মাত্র একটি ভোটের ব্যবধানে জিতলেই সংসদে আসা যায়- এমন ধারণা থেকেই জালিয়াতি বেশি হয়। আনুপাতিক হারে নির্বাচন হলে পরস্পরের প্রতি হিংস্রতা কমে যাবে এবং জাল-জালিয়াতি কম হবে।

জাগো নিউজ : ‘আনুপাতিক হারে’ নির্বাচনের বিষয়টি যদি ব্যাখ্যা করতেন…

আকবর আলি খান : নির্বাচনে যারা যত শতাংশ ভোট পাবে তারা সেই অনুপাতে সংসদে আসবে। অনেক দেশে আবার মিশ্র ব্যবস্থাও আছে। কিছু আসনে আনুপাতিক হারে আবার কিছু আসনে সরাসরি ভোটে নির্বাচন হয়। এর মাধ্যমেও ব্যালেন্স (ভারসাম্য) আসে ক্ষমতায়। বাংলাদেশেও আপাতত এমন মিশ্র ব্যবস্থা আসতে পারে। তবে তাৎক্ষণিক সুফল পেতে হলে অর্থাৎ গণতান্ত্রিক ধারা প্রতিষ্ঠা করতে হলে পূর্ণ আনুপাতিক হারে নির্বাচন দিতে হবে।

কিন্তু বাংলাদেশে এই ধারা প্রতিষ্ঠা পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। কারণ রাজনৈতিক দলগুলো কোনোভাবেই চাইবে না দেশে আনুপাতিক হারে নির্বাচন হোক। তারা চায় যে কোনো উপায়ে জিততে পারলেই পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখা যাবে।
আমি বলে আসছি, বাংলাদেশের ভোটাররা একদিনের বাদশা। ভোটের দিন প্রতিনিধিরা গিয়ে ভোটারদের তোষামোদ করেন। ভোট হয়ে গেলে ভোটারদের আর দাম থাকে না।

জাগো নিউজ : রাষ্ট্র, সমাজের পরিবর্তন তো হলো। কিন্তু ভোট ও গণতন্ত্রের নামে শোষণের হাত শক্তিশালীই থেকে গেলো…

আকবর আলি খান : পৃথিবীতে সবচেয়ে ভালো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ছিল এথেন্সে। এথেন্সের গণতন্ত্রেরও অনেক দোষ ছিল। সব নাগরিক ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারতেন না। অল্প সংখ্যক নাগরিক ভোট দিতেন। তবুও সেটা ছিল সরাসরি গণতন্ত্র। ভোটারদের সিদ্ধান্তই বাস্তবায়ন হতো।

ভোটার সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণে পরোক্ষ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেয়েছে পৃথিবীতে। এ কারণেই ভোটারদের অধিকার সংরক্ষণে আনুপাতিক হারে নির্বাচন হয়ে আসছে অনেক দেশে। ইউরোপের অনেক দেশেই একাধিকবার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের জন্য।

জাগো নিউজ : চলমান সংকট উত্তরণে আপনার মত কী?

আকবর আলি খান : সমাধান রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে। জনগণ কী চায়, তাও জানেন রাজনৈতিক নেতারা। তারা আলোচনায় বসলেই সমাধানের পথ বেরিয়ে আসবে। মুশকিল হচ্ছে তারা বসবেন না। আলোচনায় না বসে একে-অপরকে দোষ দিতে অভ্যস্ত আমাদের নেতারা।

দলের শীর্ষ নেতৃত্বও একে-অপরকে গালিগালাজ করে আসছেন। আমি বহুবার বলেছি, লিখেছি; গালিগালাজ বন্ধ করে ভদ্র ভাষায় অন্তত একে-অপরের সমালোচনা করেন, তাহলেও কিছুটা হিংসা দূর হতো। নেতারা অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন বলেই কর্মীদের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করে।

এএসএস/এমএআর/এমএস

আরও পড়ুন