যেসব কারণে ওভারব্রিজে অনীহা
জীবনের ঝুঁকি নিয়েই রাজধানীর রাস্তা পার হচ্ছেন পথচারীরা। অথচ পাশেই ফুটওভার ব্রিজ। যা গুটিকয়েকজন ব্যবহার করছেন। নারী, শিশু, শিক্ষার্থী, রোগীরাও যত্রতত্র রাস্তা পার হচ্ছেন। প্রতিদিন এ রকম চিত্র দেখা যায় শাহবাগ, ফার্মগেট, বনানী, ধানমন্ডি, মিরপুর, উত্তরাসহ ঢাকার বিভিন্ন স্থানে।
অন্যদিকে, শহরের বিভিন্ন স্থানে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার না করায় পথচারীদের আর্থিক জরিমানা করা হচ্ছে। তবুও মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ছে না। তারা ঝুঁকি নিয়ে রাস্তার আইল্যান্ড টপকে, সুযোগ বুঝে দ্রুতগতির যানবাহনের সামনে দিয়েই দৌড়ে পার হচ্ছেন।
ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন সূত্র জানা গেছে, বর্তমানে রাজধানীতে ৮৭টি ফুটওভার ব্রিজ রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের আওতায় ৩২টি ও ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের আওতায় ৪৯টি ফুটওভার ব্রিজ রয়েছে। রোড অ্যান্ড হাইওয়ের ৫টি এবং রাজউকের একটি ফুটওভার ব্রিজ রয়েছে। এর বেশিরভাগই ব্যবহার করেন না পথচারীরা। ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারে বেশিরভাগ পথচারীরই চরম অনীহা রয়েছে।
কেন তারা এভাবে রাস্তা পার হচ্ছেন?
ঢাকার একাধিক ব্যস্ততম রাস্তার পথচারীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রায় দেড়তলা পর্যন্ত সিঁড়ি বেয়ে উঠতে ও নামতে কষ্ট হওয়ার কারণে তারা ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার এড়িয়ে চলেন। কিছু কিছু ওভারব্রিজের নড়বড়ে অবস্থা। অনেক ওভারব্রিজের লোহার পাটাতনে বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়া সেখানে যৌনকর্মী, হিজড়া, ছিনতাইকারী ও ভিক্ষুকসহ হকারদের ভিড় থাকে। ফলে পথ ছোট হয়ে যাওয়ায় গায়ে গায়ে ধাক্কা লাগায় অধিকাংশ নারী ওভারব্রিজে উঠতে চান না। অনিরাপত্তাও ওভারব্রিজ ব্যবহার না করার একটি কারণ।
রোববার বাসাবো-মুগদা অঞ্চল থেকে কমলাপুর রেল স্টেশন পর্যন্ত অবস্থিত ওভারব্রিজে দেখা যায়, প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ এই ফুটওভার ব্রিজটি ব্যবহার করলেও দীর্ঘদিন ধরেই এটি ব্যবসায়ীদের দখলে। এর কোনো স্থানে মাছ ব্যবসায়ী, কিছু স্থানে সবজি ব্যবসায়ীরা বসেন, বাদ যাননি পোশাক ও জুতার ব্যবসায়ীরাও। কেউ জমা, টি-শার্ট, আবার কেউ পায়ের জুতা বিক্রি করছেন। সেইসঙ্গে ওভারব্রিজটির অনেক অংশে লোহার পাটাতনে বত গর্তের সৃষ্টি হয়েছে।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মো. শহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, কিছুদিন আগে অফিস শেষে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে
এই ওভারব্রিজ দিয়ে বাসায় ফিরছিলাম। ফুটওভার ব্রিজের ওপর উঠেই দেখি প্রচণ্ড ভিড়। একজনের সঙ্গে অন্যজনের গা ঘেঁষে যাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। এভাবে কষ্ট করে ওভারব্রিজ পার হয়ে নিচে মেনে একটি রিকশা নিয়ে বাসায় ফিরি। কিন্তু রিকশা ভাড়া দেয়ার সময় দেখি, পকেটে মানিব্যাগ নেই।
শাহবাগে দেখা গেল, একের পর এক পথচারী রাস্তা পার হচ্ছেন, মাত্র কয়েক গজ দূরেই অবস্থিত দুটি ফুটওভার ব্রিজ, যেগুলোর সেদিকে তাকিয়েও দেখছেন না তারা। হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া সবাই ঝুঁকি নিয়ে নিচ দিয়েই ব্যস্ততম এ রাস্তা পার হচ্ছেন। অনেকে আবার হাতের ইশারায় চলমান গাড়ি থামিয়ে তারপর রাস্তা পার হচ্ছেন।
হাতের ইশারায় গাড়ি থামিয়ে বৃদ্ধা মাকে নিয়ে রাস্তা পার হন দুই যুবক। তাদের একজন রিপন সাহা জানালেন, মাকে নিয়ে তারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে গিয়েছিলেন। ওভারব্রিজ দিয়ে গেলে মায়ের কষ্ট হবে। তাই ঝুঁকি নিয়ে নিচ দিয়ে এসেছেন।
বাংলামোটর মোড়ে দেখা গেল, অফিস টাইম হওয়ায় সবাই খুবই ব্যস্ত। এরই মধ্যে চলন্ত গাড়ি থামিয়ে দলবেঁধে নিচ দিয়ে রাস্তা পার হচ্ছেন পথচারীরা। অথচ ঠিক মোড়েই রয়েছে ফুটওভার ব্রিজ। এর নিচ দিয়ে যত পথচারী রাস্তা পার হন তার পাঁচ ভাগের এক ভাগও ওভারব্রিজ দিয়ে পার হতে দেখা যায়নি।
পথচারী ইব্রাহিম মিয়ার সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তিনি একটি কোম্পানিতে চাকরি করেন। ওভারব্রিজ ব্যবহার না করে কেন নিচ দিয়ে রাস্তা পার হচ্ছেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘উঁচা ব্রিজ দিয়া উঠতে মন চায় না। নিচ দিয়াই ভালো। এক মিনিটেই পার হওয়া যায়।’
বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী হাতের ইশারায় চলন্ত গাড়ি থামিয়ে রাস্তা পার হলেন। ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার না করার কারণ জানতে চাইলে একজন বললেন, ‘নিজের কাজ করেন। সময়ের অনেক মূল্য। আপনি আপনার পথে যান, আমরা আমাদের পথে যাচ্ছি।’
নর্দা ওভারব্রিজের নিচ দিয়ে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে পার হন ব্যাংকার মিজানুর রহমান। কেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিচ দিয়ে পার হচ্ছেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, এত উঁচু ব্রিজে উঠতে চাচ্ছে না স্ত্রী ও সন্তান। তাই নিচ দিয়েই পার হচ্ছি। আর ফুটওভার ব্রিজের অবস্থাও ভালো নয়। সেখানে মানুষের মল-মূত্র থেকে শুরু করে মাদকের গন্ধও পাওয়া যায়। এ ছাড়া হিজড়া, যৌনকর্মীদের আনাগোনা তো আছেই।
পথচারীরা কেন আইন মানছে না? কেনই বা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পারাপার হচ্ছে? এ বিষয়ে ডিএমপির পশ্চিম বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) লিটন কুমার সাহা জাগো নিউজকে বলেন, দেশের মানুষের আইন না মানার প্রবণতা আগে থেকেই ছিল। মানুষের এটা জন্মগত স্বভাব হয়ে গেছে। সে কারণে চাইলেও রাতারাতি এ দৃশ্য বদলানো যাবে না।
তিনি আরও বলেন, ট্রাফিক সচেতনতা মাস পালিত হচ্ছে। তার মধ্যে ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারে ট্রাফিক পুলিশের পক্ষ থেকে নানামুখী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। ফুটওভার ব্রিজের নিচে সব আইল্যান্ড বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। নতুন করে শহরের সব ব্যস্ততম সড়কে জেব্রাক্রসিং তৈরি করা হচ্ছে। ফলে মানুষ বাধ্য হয়েই ওভারব্রিজ ব্যবহার করতে উৎসাহী হবেন। তবে সবকিছুর মূলে মানুষের সচেতনা বেশি জরুরি। তবেই পুলিশের প্রচেষ্টা সার্থক হবে।
এমএইচএম/জেডএ/পিআর