ভিডিও EN
  1. Home/
  2. বিশেষ প্রতিবেদন

অবকাঠামো ছাড়াই ইফার হালাল সনদ! 

মাসুদ রানা | প্রকাশিত: ০৬:০০ পিএম, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮

আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ল্যাবরেটরি, দক্ষ জনবলসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো সুবিধা ছাড়া পণ্যের হালাল সনদ দিচ্ছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন। ইসলামী আদর্শ প্রচার সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত থাকা সংস্থাটির এই সনদ দিতে দীর্ঘদিনে কোনো আইনও হয়নি।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, হালাল পণ্যের বিশাল বাজার থাকলেও যেনতেনভাবে দেয়া এ সনদ সেভাবে গ্রহণযোগ্য পাচ্ছে না আন্তর্জাতিক বাজারে। তাই হালাল সনদ দিতে অন্যান্য দেশের মতো দক্ষ জনবল, আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য পরীক্ষাগারসহ একটি আলাদা বডি চান ব্যবসায়ীরা।

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তারা জানান, হালাল সনদ দিতে ফাউন্ডেশনের বোর্ড অব গভর্নরসের অনুমোদন দেয়া একটি নীতিমালা রয়েছে। ছয় বছর আগে এ বিষয়ে একটি আইন করার উদ্যোগ নেয়া হয় কিন্তু এখনও তা আলোর মুখ দেখেনি। সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, হালাল সনদ দেয়ার বিষয়টি ইসলামিক ফাউন্ডেশন আইন সংশোধন করে সেখানে যুক্ত করা হবে।

খাদ্যের উপাদানের ওপর হালাল-হারাম নির্ভর করে। তাই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিশ্চিত হয়ে এ বিষয়ে সনদ দেয়া উচিত। এজন্য ডিএনএ পরীক্ষারও প্রয়োজন রয়েছে। তাই উপযুক্ত পরীক্ষাগার ছাড়া এটি করা সম্ভব নয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত ৬৫টি প্রতিষ্ঠানের শতাধিক পণ্যের হালাল সনদ দেয়া হয়েছে। সনদ দেয়ার পর ওই পণ্য উৎপাদনের বিষয়টি মনিটরিংয়ের কথা থাকলেও লোকবল না থাকায় সেটা করতে পারছে না ফাউন্ডেশন।

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের হালাল সনদ বিভাগে স্থায়ী জনবল মাত্র তিনজন। একজন পরিচালক, একজন মুফাসসির (কোরআনের ব্যাখ্যাকারী) কাম উপ-পরিচালক এবং একজন সহকারী পরিচালক কাম ডেস্ক অফিসার।

নিয়ম অনুযায়ী, বর্তমানে হালাল সনদ দেয়া খাদ্য ও ভোগ্যপণ্যের ক্ষেত্রে কারখানার বিক্রয় মূল্যের শতকরা ৮ পয়সা হারে ইসলামিক ফাউন্ডেশনকে কোম্পানিগুলো দিচ্ছে বলে হালাল সনদ বিভাগ থেকে জানা গেছে।

দ্য ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই)-এর পরিচালক এস এম জাহাঙ্গীর হোসেন এ প্রসঙ্গে জাগো নিউজকে বলেন, ‘ইসলামিক ফাউন্ডেশন হালাল সনদ দেবে কেন? এই কাজের জন্য আলাদা একটা বডি হওয়া উচিত। প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ছাড়া সনদ দেয়া কতটুকু হালাল এটাও একটি প্রশ্ন?’

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) পরিচালক মোহাম্মদ বাসিরুজ্জামান বলেন, ‘আমরা ব্যবসায়ীরা মনে করি, হালাল সনদ দেয়ার ক্ষেত্রে আলাদা একটা বডি থাকা উচিত। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কোনো প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নেই; এক্সপার্টিজ দরকার, তাও নেই। বিদেশে এই সনদের খুব একটা গ্রহণযোগ্যতাও নেই।’

বর্তমানে মন্ত্রী-সচিবসহ ধর্ম মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা হজ কার্যক্রম তদারকির জন্য সৌদি আরবে আছেন। তাই এ বিষয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলা যায়নি।

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের হালাল সনদ বিভাগের মুফাসসির ও উপ-পরিচালক মো. আবু ছালেহ পাটোয়ারী জাগো নিউজকে বলেন, ‘হালাল সনদ দিতে আমাদের নীতিমালা রয়েছে। ফাউন্ডেশনের বোর্ড অব গভর্নরসের অনুমোদনে এটি ২০১৫ সালে করা হয়।’

তিনি বলেন, ‘এ সংক্রান্ত একটি আইন করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। আইনের খসড়া নিয়ে আমরা আইন কমিশনসহ বিভিন্ন দফতরের দ্বারস্থ হয়েছি। আমরা এটি মন্ত্রণালয়েও দিয়েছিলাম। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, ১৯৭৫ সালের ইসলামিক ফাউন্ডেশন অ্যাক্টের মধ্যে হালাল সনদের খসড়ার বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করলে বিষয়টি সহজ হবে।’

‘এজন্য ইসলামিক ফাউন্ডেশন অ্যাক্ট সংশোধন করে হালাল সনদ দেয়ার বিষয়টি অন্তর্ভুক্তের প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। আন্তঃমন্ত্রণালয় মিটিং থেকে কিছু পর্যবেক্ষণ এসেছে। সেগুলো নিয়ে কাজ করে খসড়াটি দ্রুত আমরা দিয়ে দেব। এরপর মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পর এটি পার্লামেন্টে যাবে।’

উপ-পরিচালক বলেন, ‘আমরা যত্নের সঙ্গে সনদ দেয়ার চেষ্টা করি। তবে যারা রফতানি করে তাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সনদ দেই। রিকয়ারমেন্ট ফুলফিল না হলেও আমরা শর্ত-সাপেক্ষে সনদ দিয়ে তাদের সহযোগিতা করছি।’

পরীক্ষাগারের বিষয়ে আবু ছালেহ পাটোয়ারী বলেন, ‘গত বছর ওআইসির মহাসচিবকে দিয়ে আগারগাঁওয়ে ফাউন্ডেশনের হেড অফিসের ১০ তলায় একটি ল্যাবরেটরি উদ্বোধন করা হয়েছে। সেখানে ১৫ থেকে ১৬ লাখ টাকার মতো যন্ত্রপাতি রয়েছে। তবে এখনও এই লাইব্রেরি যথাযথ মানে উন্নীত করা যায়নি। আমরা এর উন্নয়নের চেষ্টা করছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের সনদ নিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিদেশে পণ্য রফতানি করছে। তবে অনেকে একবার সনদ নিয়ে আর আসতে চায় না। প্রতি বছর এটির নবায়নের নিয়ম রয়েছে।’

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের একজন কর্মকর্তা জানান, ২০১২ সালে ‘হালাল খাদ্য ভোগ্যপণ্য, প্রসাধন সামগ্রী ও ফার্মাসিউটিক্যালসের সার্টিফিকেট নীতিমালা’ এবং খসড়া ‘হালাল খাদ্য ভোগ্যপণ্য, প্রসাধন সামগ্রী ও ফার্মাসিউটিক্যালসের সার্টিফিকেট আইন’ এর খসড়া করা হয়। আইন ও নীতিমালার খসড়া ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। কয়েক দফা আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা হয়। সংশ্লিষ্টদের মতামত নেয়া হয়। এভাবে চলে যায় কয়েক বছর। একপর্যায়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বোর্ড অব গভর্নরস নীতিমালাটি অনুমোদন দেয়। কয়েকটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায়ও সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, ইসলামিক ফাউন্ডেশন হালাল সনদ দেবে।

২০০৭ সালে পাবনার বেঙ্গল মিটকে প্রথম হালাল সনদ দেয়া হয় বলেও জানান ওই কর্মকর্তা।

সনদ দেয়ার প্রক্রিয়ার বিষয়ে ওই কর্মকর্তা বলেন, আবেদনের সময় ট্রেড লাইসেন্স, টিআইএন সনদ, ভ্যাট বা ট্যাক্সের সনদ দিতে বলা হয়। বিএসটিআই সনদ, কারখানার পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র, ফুড অ্যান্ড নিউট্রিশনের কাগজপত্রও নেয়া হয়।

আলেম-ওলামা, টেকনিক্যাল লোকসহ ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালকের নেতৃ্ত্বে একটি কমিটি আবেদন যাচাই-বাছাই করে। কোনো শর্তের ঘাটতি থাকলে সেটা পূরণ করতে বলা হয়। শর্তপূরণে সময়ও দেয়া হয়।

পরে প্রয়োজন অনুযায়ী বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর), বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই), ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর, মৎস্য অধিদফতর, প্রাণিসম্পদ অধিদফতর, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর, আইসিডিডিআর’বি, ফুড অ্যান্ড নিউট্রিশন ডিপার্টমেন্টসহ বিভিন্ন সংস্থার সহযোগিতা নিয়ে সনদ দিয়ে থাকে ইসলামিক ফাউন্ডেশন।

পণ্যের মানের বিষয়গুলো ফাউন্ডেশন দেখে না, শুধু হালাল ও হারামের বিষয়টি দেখে- জানিয়ে ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘হালাল সনদ দেয়ার ক্ষেত্রে ওআইসির যে মান রয়েছে সেটা অনুসরণ করবে ফাউন্ডেশন। সেজন্য কাজ হচ্ছে। আমাদের জনবল কম, আমরা আস্তে আস্তে এগোচ্ছি।’

তিনি বলেন, ‘হালাল-হারামের জন্য জরুরি বিষয় ডিএনএ টেস্ট। সেটা পরীক্ষার যন্ত্রপাতি নেই ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কাছে। সায়েন্স ল্যাব থেকে পরীক্ষাটি করানো হয়। আমরা তুরস্কের সঙ্গে একটি চুক্তির মাধ্যমে এই কার্যক্রম শক্তিশালী করার চেষ্টা করছি।’

গত ৯ আগস্ট ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত ‘হালাল সনদের মানদণ্ড এবং প্রতিবন্ধকতা : বাংলাদেশের সম্ভাবনা’ শীর্ষক সেমিনারে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান কাজী এম আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘হালাল পণ্য উৎপাদন ও রফতানির ক্ষেত্রে আমাদের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। হালাল খাদ্য মানুষের জীবন ধারণের জন্য অত্যন্ত নিরাপদ, যা কিনা মুসলমানদের পাশাপাশি অমুসলিমরাও গ্রহণ করে থাকে। এ কারণে এ ধরনের পণ্যের সম্ভাবনা পৃথিবীর সব দেশেই রয়েছে।’

তিনি হালাল পণ্য রফতানি বৃদ্ধির জন্য অবকাঠামো উন্নয়ন, এর সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠানের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রযুক্তিগত সহযোগিতা দেয়া এবং জনবলের দক্ষতা বাড়ানোর ওপর জোর দেন। হালাল পণ্য উৎপাদন বাড়ানোর জন্য একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল বরাদ্দ দেয়া যেতে পারে বলেও মত দেন তিনি।

ওই সেমিনারে ডিসিসিআই’র সভাপতি আবুল কাসেম খান বলেন, ‘বর্তমানে বৈশ্বিক ইসলামিক বাজার মূল্য প্রায় দুই ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা পৃথিবীর মোট খরচের প্রায় ১১ দশমিক ৯ শতাংশ এবং এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, সারা বিশ্বে হালাল পণ্যের বেশ চাহিদা রয়েছে এবং প্রতিনিয়ত তা বাড়ছে।’

পৃথিবীজুড়ে হালাল পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও থাইল্যান্ড এগিয়ে রয়েছে জানিয়ে আবুল কাসেম খান বলেন, ‘কিন্তু মুসলিমপ্রধান দেশ হিসাবেও আমরা ভালো অবস্থানে যেতে পারিনি।’

বাংলাদেশে হালাল পণ্য উৎপাদন আরও জনপ্রিয় এবং এ খাতের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় নীতিমালা প্রণয়ন ও সহযোগিতা দেয়া, দক্ষ জনবল তৈরি, প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা উন্নয়ন এবং অবকাঠামো উন্নয়নে স্বল্প সুদে আর্থিক প্রণোদনা দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান ডিসিসিআই সভাপতি।

সেমিনারে বাংলাদেশে নিযুক্ত সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাষ্ট্রদূত সাইদ মোহাম্মদ সাইদ বলেন, ‘বাংলাদেশের হালাল পণ্য বিশ্ববাজারে রফতানি বাড়াতে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো উন্নয়ন, হালাল সনদ প্রদানের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সনদ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান স্থাপন এবং প্রয়োজনীয় নীতিমালা প্রণয়নের কোনো বিকল্প নেই।’

আরএমএম/এমএআর/আরআইপি

আরও পড়ুন