ভিডিও EN
  1. Home/
  2. বিশেষ প্রতিবেদন

চালকদের কর্মঘণ্টা নির্ধারণে বাধা যেখানে

জসীম উদ্দীন | প্রকাশিত: ১০:৫২ এএম, ২৭ আগস্ট ২০১৮

* অনুমতিপ্রাপ্ত গাড়ি ৩৫ লাখ
* প্রশিক্ষিত চালক ১৯ লাখ
* ১৫ লাখ চালকের ঘাটতি
* কর্মঘণ্টা নির্ধারণে সমন্বয়হীনতা
* দক্ষ চালক তৈরির জন্য দক্ষ ট্রেইনার দরকার

রাজধানীর শহীদ রমিজ উদ্দিন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহতের পর নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে পরিবহনখাতের দুরবস্থার চিত্র আবারও উঠে আসে। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে নেয়া হয় বেশকিছু সিদ্ধান্ত। মন্ত্রিসভার বৈঠকে ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়। তবে ঝুলে গেছে চালকদের এক নাগাড়ে পাঁচ ঘণ্টার বেশি সময় যানবাহন না চালানোর বিষয়টি, যার নির্দেশনা ওই দুর্ঘটনা ঘটার এক সপ্তাহ আগেই দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কর্মকর্তারা বলছেন, সড়কে মৃত্যুর মিছিল বন্ধে চালকদের কর্মঘণ্টা নির্ধারণসহ প্রধানমন্ত্রীর মোট ছয়টি নির্দেশনা বাস্তবায়নে মালিক শ্রমিক ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। খুব শিগগির এ ব্যাপারে একটি কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া হবে।

নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) এবং যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলছে, সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামাতে যেসব বাধা, তা দূর করতে কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়নি সরকার। দরকার দক্ষ চালক তৈরির কোনো স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান। সেইসঙ্গে লাগবে পথে চালকদের বিশ্রামের জন্য রেস্ট হাউস। সরকার তা করেনি। এসব আগে দরকার।

bus-driver

কর্মঘণ্টা নির্ধারণ হলে চালক সংকট হবে কি?

প্রশ্ন উঠেছে কর্মঘণ্টা নির্ধারণ হলে চালক সংকট দেখা দেবে কি-না। পরিবহন মালিক-শ্রমিক নেতারা বলছেন, কর্মঘণ্টা নির্ধারণ হলে চালক সংকট দেখা দেবে। তাই আগে চালক সংকট দূর করতে হবে। যান চলাচলে উপযোগী সড়ক করতে হবে। এ ছাড়া সরকারি উদ্যোগে দক্ষ চালক তৈরির জন্য প্রতিষ্ঠান ও সড়কে চালকদের জন্য রেস্ট হাউস করতে হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত মে ও জুনে বেশ কয়েকটি দুর্ঘটনায় শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়। এতে গত ২৪ জুন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে একটি কমিটি করা হয়। পরদিন সচিবালয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, দূরপাল্লার রুটে একজন চালক টানা ৫ ঘণ্টার বেশি গাড়ি চালাতে পারবেন না। এসব রুটে বিকল্প আরেকজন চালক রাখারও নির্দেশ দেন তিনি। রাস্তার মাঝে চালকদের বিশ্রাম ও সহকারী চালকের আসনে না বসা, চালক ও তার সহকারীর (হেলপার) প্রশিক্ষণ, অনিয়মতান্ত্রিক রাস্তা পারাপার বন্ধ এবং সিট বেল্ট বাঁধার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী।

এর এক সপ্তাহ পর গত ২৯ জুলাই ঢাকায় শহীদ রমিজউদ্দিন কলেজের দুই শিক্ষার্থীর নিহত হয়। এতে নিরাপদ সড়কের দাবিতে টানা ১০ দিন আন্দোলন করে শিক্ষার্থীরা। এরপর গত ৬ আগস্ট মন্ত্রিসভার বৈঠকে ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ চূড়ান্ত অনুমোদন হয়। ওই বৈঠকের পর নড়েচড়ে বসেন পরিবহন মালিকরা।

মালিক সমিতি ও শ্রমিক ইউনিয়নগুলো সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে বেশকিছু সিদ্ধান্ত নেয়। চুক্তিভিত্তিক গাড়ি না চালানো, রুট পারমিট, ফিটনেস সনদ ও চালকের লাইসেন্স না থাকলে গাড়ি সড়কে না নামানো, প্রতিদিন টার্মিনাল থেকে পরিবহন বের হওয়ার সময় সংশ্লিষ্টদের কাগজপত্র চেক করা। পাশাপাশি আইন অমান্যকারী চালকের লাইসেন্স বাতিলের সুপারিশসহ সাংগঠনিক ব্যবস্থা, মাদকাসক্ত চালককে গাড়ি না দেয়া ও বাসের ভেতর টিকিট বিক্রি না করা। তবে চালকদের কর্মঘণ্টা নির্ধারণের বিষয়টি ঝুলে যায়। এ ব্যাপারে কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি মালিকপক্ষ।

চালকদের কর্মঘণ্টা নির্ধারণ করা জরুরি হলেও সমন্বয়হীনতা ও কিছু বাধা রয়েছে উল্লেখ করে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, সাধারণত ঢাকা থেকে সিলেট যেতে সাড়ে ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা লাগে। ঢাকা-চট্টগ্রাম যাওয়া-আসা করতে একই সময় এবং কখনও কখনও আরও বেশি সময় লাগে। এ ছাড়া ঢাকা থেকে রংপুর যেতে ৭ থেকে ৮ ঘণ্টার বেশি সময় লাগে। তাহলে কর্মঘণ্টা নির্ধারণ করবেন কী করে?

bus-driver

তিনি বলেন, ঢাকা থেকে রংপুরের সড়ক যদি যানজটমুক্ত থাকে তবে ৫ ঘণ্টাতেই পৌঁছা সম্ভব। সেই ব্যবস্থাটি তো আগে নিতে হবে।

‘আমাদের চালকদের কর্মঘণ্টা নির্ধারণ করা অবশ্যই দরকার। কিন্তু দেশে অনুমতিপ্রাপ্ত গাড়ি রয়েছে ৩৫ লাখ আর প্রশিক্ষিত চালক রয়েছে ১৯ লাখ। সংগত কারণে প্রত্যেক গাড়িতে একজন করে চালক দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থায় চালকদের কর্মঘণ্টা নির্ধারণের আগে দরকার দক্ষ চালক বাড়ানো, সড়কে চালকদের জন্য রেস্ট হাউস নির্মাণ, ট্রাক চালকদের জন্য সড়কের পাশে বিশ্রাম করার আলাদা ব্যবস্থা। এর সঙ্গে সঙ্গে সড়ক যানজটমুক্ত থাকাও জরুরি।’

নিরাপদ সড়কের দাবিতে সম্প্রতি শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মধ্যেই পরিবহন সেক্টরের শৃঙ্খলা রক্ষার্থে এবং এ ধরনের মর্মান্তিক ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধকল্পে রুটপারমিট ও ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলতে না দেয়া, উপযুক্ত ড্রাইভিং লাইসেন্স ব্যতীত গাড়ি না চালানো, যত্রতত্র যাত্রী উঠানামা না করা, বেপরোয়া ও প্রতিযোগিতামূলক গাড়ি না চালানো, ইত্যাদি বিষয়ে পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের আন্তরিক ও সক্রিয় সহযোগিতা চেয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। পরে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে পুলিশের পাশাপাশি বিআরটিএ অভিযানে নামে।

এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে বিআরটিএ পরিচালক (রোড সেফটি) শেখ মো. মাহাবুব-ই-রব্বানী জাগো নিউজকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী সুস্পষ্টভাবে ছয়টি নির্দেশনা দিয়েছেন। তা বাস্তবায়নে পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের সঙ্গে কয়েক দফায় বৈঠক হয়েছে।

চালকদের কর্মঘণ্টা নির্ধারণে বিআরটিএ সব ধরনের সহযোগিতা করবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই সিদ্ধান্ত আমরা চাপিয়ে দিতে পারি না। কিন্তু সহযোগিতা করতে পারি। চালকদের কর্মঘণ্টা নির্ধারণ পরিবহন মালিকদেরই করতে হবে।

bus-driver

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, আমরা বারবার যাত্রীদের নিরাপত্তা ও নিরাপদ সড়কের দাবি উত্থাপন করেছি। কিন্তু এ জন্য কার্যকরী কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। চালকদের দক্ষতা বাড়ানোর স্বীকৃত কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। বিআরটিসিকে (বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্পোরেশন) সম্প্রতি দক্ষ চালক তৈরির দায়িত্ব দেয়া হলেও তা দেশের জন্য না। বিদেশে জনবল হিসেবে পাঠানোর জন্য।

এ ব্যাপারে নিরাপদ সড়ক চাইয়ের (নিসচা) প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন ক্ষোভ প্রকাশ করে জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের সমস্যা হচ্ছে, আমরা কথা বেশি বলি, কাজের কাজটা কম করি। যখনই বড় বা চাঞ্চল্য ছড়ানোর মতো কোনো দুর্ঘটনা ঘটে তখনই শুধু নিরাপদ সড়কের দাবিটি উঠে। তখন স্লোগান ও গলাবাজিও বেড়ে যায়। সময় গড়ায় নতুন ইস্যুতে, ধামাচাপা পড়ে যায় নিরাপদ সড়কের দাবিটি। অথচ কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না।

‘গত ২৫ বছর ধরে নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করে যাচ্ছি। কিন্তু কে শোনে কার কথা। ২০১২ সালে অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় বললেন, নিরাপদ সড়কের দাবি পূরণে প্রকল্প হিসেবে আমাকে ২৫ কোটি টাকা দেয়া হয়েছে। কিন্তু সে টাকা আজও পাইনি,’- বলেন তিনি।

ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, ‘চালকদের কর্মঘণ্টা নির্ধারণের আগে দক্ষ চালকের সংখ্যা বাড়াতে হবে। কিন্তু আমাদের ১৫ লাখ চালকের ঘাটতি রয়েছে। এই ১৫ লাখ চালক তৈরির জন্য দেশে কোনো ইনস্টিটিউশন নেই। তা আগে তৈরি করতে হবে। বিআরটিসির কাছে মাত্র ২৫ জন ট্রেইনার রয়েছে। দক্ষ চালক তৈরির জন্য তো আগে দক্ষ ট্রেইনার দরকার।’

সড়কের পাশে চালকদের জন্য রেস্ট হাউস তৈরি, দূরপাল্লার সড়ক যানজটমুক্ত করতে আগে সফল উদ্যোগ নিতে হবে। তবেই চালকদের কর্মঘণ্টার বিষয়টি নির্ধারণ করা সম্ভব হবে বলে মনে করেন তিনি।

জেইউ/জেডএ/জেআইএম

আরও পড়ুন