কোটা আন্দোলন রাবিতে শুরু করেছিল ছাত্রশিবির
রাশেদ খান মেনন। সভাপতি, বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টি। মন্ত্রী, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নিয়ে সম্প্রতি মুখোমুখি হন জাগো নিউজ-এর। দীর্ঘ আলোচনায় কোটা সংস্কার আন্দোলন, সরকারের অবস্থান, নির্বাচনসহ দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে মতামত ব্যক্ত করেন তিনি।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলন অরাজনৈতিক হলেও বিশেষ মহল এই আন্দোলন থেকে সুবিধা নিতে চাইছে বলে অভিযোগ তোলেন। কোটা ব্যবস্থার পক্ষেও মত দেন তিনি। আগামী নির্বাচন সংবিধান অনুযায়ী হবে বলেও জানান বামপন্থী এই নেতা।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু। তিন পর্বের দ্বিতীয়টি থাকছে আজ।
জাগো নিউজ : আগের পর্বে কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে বলেছিলেন। দ্বিধায় আছেন আন্দোলনকারীরা। সরকার কোটা নিয়ে বক্তব্য পরিষ্কার করলেই পারে?
রাশেদ খান মেনন : কমিটি করে দেয়া হয়েছে। জটিল বিষয়। কাজ করছে। শিক্ষার্থীদের হুকুম মতই তো আর প্রজ্ঞাপন জারি করা যায় না।
জাগো নিউজ : তাহলে এই জটিলতার শেষ কোথায়?
রাশেদ খান মেনন : কোটা নিয়ে আন্দোলন আজকের নয়। চার বছর আগে এই আন্দোলন শুরু হয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। রাবিতে ইসলামী ছাত্রশিবির কোটা আন্দোলন শুরু করেছিল। এটি একেবারেই একটি নিরীহ আন্দোলন, তা মনে করার কোনো কারণ নেই। আন্দোলনের ধরন দেখেই বোঝা যাচ্ছে, এর পেছনে কারা কাজ করছে।
জাগো নিউজ : অরাজনৈতিক আন্দোলনের চাপে সরকার, অনেকেই মনে করছেন।
রাশেদ খান মেনন : ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছি। শিক্ষার্থীরা প্রথমে সে আন্দোলন অরাজনৈতিকভাবেই শুরু করেছিল। সে আন্দোলনের একটি কাঠামো ছিল। সেই সময়কার আন্দোলন আর এখনকার আন্দোলন এক বিষয় নয়। কোটাবিরোধী আন্দোলনের পেছনে আমাদের বামবন্ধুরা ঘুরছেন। কিশোর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনেও তাই করলেন। মাইকে ঘোষণা দিয়ে বলে দিলেন দাবি না মানলে সরকার পতনের ডাক দেয়া হবে।
জাগো নিউজ : নৈতিক আন্দোলনে সমর্থন দিতেই পারে?
রাশেদ খান মেনন : দায়িত্ব নিয়ে সমর্থন দিলে সমস্যা নেই। আন্দোলনের দায়িত্ব নিজের হাতে রাখুক। তা তো করছে না। অন্যের ঘাড়ে দিয়ে দিচ্ছে বাম ঘরানার কোনো কোনো নেতা। ছাত্র সংগঠনগুলো তো তাদের দায়িত্ব পালন করছে না।
জাগো নিউজ : অনাস্থা তো এই প্রশ্নেই আর সেটা আপনাদের বেলাতেও।
রাশেদ খান মেনন : ১১ দফা আন্দোলন ছাত্ররা করেছে। সেখানে রাজনৈতিক দলগুলো সমর্থন দিয়েছে। ১১ দফা নিয়ে মওলানা ভাসানীর কাছে যাওয়া হয়েছে। তিনি সমর্থন দিয়েছেন। তার মানে রাজনৈতিক সমর্থন দিলেই একেবারে কুক্ষিগত করতে চায়নি কেউ।
আর এখন রাজনৈতিক দলগুলোর দেউলিয়াপনার কারণেই এমনটি হচ্ছে। নগ্নভাবে হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা চলছে। বাড়িভাড়া, বাসের ভাড়া নিয়ে আমরাও আন্দোলন করেছি। কিন্তু যারা ক্ষমতার কাছাকাছি এবং ক্ষমতার বাইরে তারা সবাই অপ্রত্যাশিতভাবে নিজেদের দায়িত্ববোধ হারিয়ে ফেলেছি।
জাগো নিউজ : শিক্ষার্থীদের অহিংস আন্দোলনে সরকার পক্ষ, বিশেষ করে ছাত্রলীগ, যুবলীগ যে প্রতিক্রিয়া দেখালো, তা কিভাবে দেখছেন?
রাশেদ খান মেনন : আপনি কিভাবে জানলেন যে, ছাত্রলীগ, যুবলীগ হামলা করেছে! আমি তো দেখলাম, শাহবাগে ছাত্রলীগের ছেলেরা আন্দোলনকারীদের চকলেট দিচ্ছে। আন্দোলনে সংহতি ঘোষণা করেছে। আপনি কিভাবে প্রমাণ করবেন যে, ছাত্রলীগ, যুবলীগ হামলা করেছে।
জাগো নিউজ : দিবালোকে হামলা?
রাশেদ খান মেনন : আমি জানি না কারা হামলা করেছে। কিন্তু আপনারা প্রমাণ ছাড়াই লিখেছেন। সাইন্সল্যাব থেকে মিছিল নিয়ে জিগাতলায় পরপর দু’দিন কেন গেল? সেখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল না। সেখানে বিজিবি সদরদফতর। কারা গেল, কেন গেল তা তো ভেবে দেখতে হবে। লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর কার্যালয়ে হামলা করা। তাই করেছে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা হয়তো প্রতিরোধ করেছে মাত্র। কিন্তু হামলার ঘটনা নিয়ে মিথ্যা প্রপাগান্ডা বা গুজব রটানো হলো কেন? অভিনেত্রী নওশাবা ফেসবুক লাইভে বলে দিলেন। ফটোগ্রাফার শহিদুল আলম একেবারে আল জাজিরা চ্যানেলে বলে দিলেন।
জাগো নিউজ : শহিদুল আলম গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনেও সমর্থন দিয়ে কাজ করেছেন।
রাশেদ খান মেনন : শহিদুল আলমের পেছনের কথা আমরা জানি। তিনি তিব্বত নিয়ে ফটো এক্সিবিশন করতে গিয়ে সরকারকে বিপদে ফেলতে চেয়েছিলেন। বাংলাদেশের মানুষ, বাংলাদেশ যখন চীনের সঙ্গে ভালো সম্পর্কে বিশ্বাসী তখন তিনি এমন একটি এক্সিবিশন করতে গিয়ে বিতর্ক তুললেন। চীন অ্যাম্বাসি যখন এই এক্সিবিশন নিয়ে প্রশ্ন তুললেন, তখন সরকারের হস্তক্ষেপে বন্ধ করে দিতে বাধ্য হলেন।
শহিদুল আলমের পক্ষে অনেকেই কথা বলছেন। আমরা চাই মানুষ মত প্রকাশ করুক। আল জাজিরা টেলিভিশন গোলাম আযমের ছেলের সাক্ষাৎকার প্রচার করেছিল, সেই আল জাজিরায় শহিদুল আলমও সাক্ষাৎকার দিলেন।
জাগো নিউজ : শহিদুল আলম একজন ফটোগ্রাফার। তিনি ছবি তোলেন। যে কোনো বিষয় নিয়ে সাক্ষাৎকার দিতেই পারেন। হামলার শিকার হলেন অন্য সাংবাদিকরাও।
রাশেদ খান মেনন : ইত্তেফাক সম্পাদক মানিক মিয়া জেলে যাননি? এনায়েত উল্লাহ খান জেলে যাননি। সাংবাদিকদের ওপর নিপীড়ন এর আগে হয়নি?
জাগো নিউজ : রাষ্ট্রের এই নিপীড়নের বিরুদ্ধে আপনারও এক সময় কথা বলছেন।
রাশেদ খান মেনন : হ্যাঁ, আমরা প্রতিবাদ করেছি। কিন্তু এই ঘটনায় রং দিয়ে যেভাবে অন্যায় করা হচ্ছে, বিষয়টি কিন্তু তেমন না। বিশাল ঘটনা হয়েছে এমন না। সব দেশেই এমন ঘটনা ঘটে।
ভারতে কী হচ্ছে? ভারতে কি আন্দোলন বা আটকের ঘটনা ঘটছে না। বাংলাদেশের গণমাধ্যম তো স্বাধীনভাবে কাজ করছে। এখন আপনারা যদি মাহমুদুর রহমানকে সাংবাদিক বলেন এবং আমাকে তা শুনতে হবে, তা তো হতে পারে না। গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন নিয়ে মাহমুদুর রহমান কী করলেন! মিথ্যা, গুজব দিয়ে তো সাংবাদিকতা হয় না।
জাগো নিউজ : গুজব রটে, সেই গুজবের রেশ ধরে নিপীড়ন চলে। এই পরিস্থিতির শেষ কোথায়?
রাশেদ খান মেনন : হেফাজতের আন্দোলনের ছবি তুলে শহিদুল আলম প্রচার করলেন হাজার হাজার মানুষ মারা গেছে। অধিকার নামের একটি মানবাধিকার সংস্থা ৩০৬৪ লিস্ট প্রকাশ করলেন, এরা মারা গেছে। পরে দেখা গেলে সবাই বেঁচে আছেন। ৬৪ জন লোক মারা গিয়েছিল তখন। অথচ ভিডিও করে নানা মিথ্যা প্রচার করা হলো।
২০০৪ সালে পুলিশি নির্যাতনের ছবি দিয়ে বলা হচ্ছে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ছবি। গোটা পৃথিবী অস্থির। প্রযুক্তি, সামাজিক মাধ্যমে ভর করে এই অস্থিরতা। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিজে বলেছেন, সামাজিক মাধ্যমে তরুণদের কীভাবে প্রভাবিত করা হয়েছিল নির্বাচনে। ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা জুকারবার্গ নিজে বলেছেন, ফেসবুকের কারণে তরুণ, কিশোরদের মেধার দশ ভাগ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এই কারণে চায়না ফেসবুক বন্ধ করে দিয়েছে।
জাগো নিউজ : কিন্তু প্রযুক্তির আশীর্বাদ তো আপনি অস্বীকার করতে পারেন না। ডিজিটাল বাংলাদেশের স্লোগান আপনারাই দিয়েছেন।
রাশেদ খান মেনন : অস্বীকার করা যাচ্ছে না। কিন্তু ফেসবুক, অনলাইনে এক নারীর ছবি যখন নগ্নভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে, সেই অপরাধের কথাও তো অস্বীকার করা যাবে না। হাজার হাজার নারীর সম্মান নষ্ট করা হচ্ছে। সামাজিক অস্থিরতা বেড়েছে।
জাগো নিউজ : তার মানে প্রযুক্তির নেতিবাচক ধাক্কা মোকাবেলা করার জন্য সরকার প্রস্তুত ছিল না?
রাশেদ খান মেনন : আমরা কিছুটা অপ্রস্তুত ছিলামই বটে। ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপ দিচ্ছি। কিন্তু কিছুটা ঘাটতি আছে সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে। এ কারণেই হৈচৈ পড়েছে। পাশের দেশ ভারতও এ নিয়ে সমস্যায় আছে। সাইবার অপরাধ মোকাবেলায় আরও সক্রিয় হওয়া দরকার বলে আমি মনে করি।
জাগো নিউজ : মোকাবেলার নামে সাইবার আইনে হয়রানির অভিযোগও উঠছে?
রাশেদ খান মেনন : তথ্যপ্রযুক্তির আইনের ৫৭ ধারা থাকছে না। হয়রানি করার সুযোগ থাকবে না। আমলাতন্ত্রের একটি ছক আছে। কোনো আইন তৈরি করতে গেলে সেই ছকেই ফেলতে হয়। কিন্তু মন্ত্রিসভা, সংসদ তো ফিল্টারিং করেই সেই আইন পাস করে। ভয়ের কোনো কারণ নেই। সংসদের স্থায়ী কমিটি আছে। তাদের দায়িত্ব আইনগুলো পর্যবেক্ষণ করা।
এএসএস/এমআরএম/এমএস