কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বর্ণের নিলাম বন্ধ ১০ বছর
* রাজস্ববঞ্চিত হচ্ছে রাষ্ট্র
* ভল্টে ৯৬৩ কেজি স্বর্ণ
* নিলাম বন্ধের নেপথ্যে সিন্ডিকেট
প্রায় এক দশক ধরে বাংলাদেশ ব্যাংকে রক্ষিত স্বর্ণের নিলাম দেয়া হচ্ছে না। এই সময়ে ক্রমেই বেড়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রক্ষিত স্বর্ণের পরিমাণ। বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে ৯৬৩ কেজি স্বর্ণ জমা আছে। নিয়ম অনুসারে, মামলা নিষ্পত্তির পর রক্ষিত স্বর্ণ নিলামে তোলার কথা। কিন্তু ২০০৮ সালের ২৩ জুলাইয়ের পর নিলামে আর স্বর্ণ বিক্রি করেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে একদিকে যেমন এসব স্বর্ণ অব্যবহৃত রয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে রাষ্ট্র রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে। কেননা এই পরিমাণ স্বর্ণ নিলামে তুললে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে হাজার কোটি টাকা জমা হতো। এ ছাড়া নিরাপত্তা নিয়েও করতে হতো না বাড়তি চিন্তা।
সম্প্রতি শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের এক প্রতিবেদনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টে সঠিকভাবে স্বর্ণ সংরক্ষণ করা হচ্ছে না বলে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে উঠে আসে, বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা রাখা হয়েছিল ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম ওজনের স্বর্ণের চাকতি ও আংটি, তা হয়ে গেছে মিশ্র বা সংকর ধাতু। ছিল ২২ ক্যারেট স্বর্ণ হয়ে গেছে ১৮ ক্যারেট। দৈবচয়নভিত্তিতে নির্বাচন করা বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে রক্ষিত ৯৬৩ কেজি স্বর্ণ পরীক্ষা করে বেশিরভাগের ক্ষেত্রে এ অনিয়ম ধরা পড়েছে বলেও প্রতিবেদনে দাবি করা হয়।
যদিও এই প্রতিবেদন সঠিক নয় বলে দাবি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু এত কিছুর পর সহসায় প্রশ্ন উঠেছে এসব স্বর্ণ ভল্টে রেখে না দিয়ে নিলাম করা হচ্ছে না কেন? তাহলে এটা নিয়ে অনিয়মের কোনো প্রশ্ন উঠতো না। নিরাপত্তা নিয়েও ভাবতে হতো না।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়ম অনুসারে নিলাম করে আসছিল। কিন্তু পরে দেখা গেল, স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা নিজেদের মধ্যে সিন্ডিকেট করে বাজারদরের চেয়ে অনেক কমমূল্যে স্বর্ণ কিনে নিতো। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যেখানে কিছুই করার থাকতো না। ফলে বাধ্য হয়েই নিলাম বন্ধ করে দেয়া হয়।
বিষয়টি নিয়ে একই ধরনের কথা বলেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক মাহফুজুর রহমান। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, এ জন্য দায়ী স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা। তারা নিজেদের মধ্যে এমন একটা সিন্ডিকেট তৈরি করেছে, যাতে পানির দরে স্বর্ণ কিনে নিতে পারে। এটা হতে পারে নাকি। বাজারদর বলতে একটা বিষয় আছে না।
বৃহস্পতিবারের হিসাব অনুসারে ভালোমানের (২২ ক্যারেট) স্বর্ণের দাম প্রতিভরি ৪৯ হাজার ৮০৫ টাকা। ২১ ক্যারেট স্বর্ণের বাজার চলছে ৪৭ হাজার ৫৩০ টাকা, আর ৪২ হাজার ৪৫৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে ১৮ ক্যারেট স্বর্ণের দাম।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় স্বর্ণের এই দাম কমানোর ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস)। নতুন দাম শুক্রবার থেকে সারা দেশে কার্যকর হবে । নতুন দাম অনুযায়ী ২২, ২১ ও ১৮ ক্যারেটের স্বর্ণ প্রতিভরিতে কমেছে এক হাজার ১৬৬ টাকা। তবে অপরিবর্তিত রয়েছে সনাতন পদ্ধতির দাম।
ব্যাংকের রক্ষিত স্বর্ণের নিলামে সিন্ডিকেটের বিষয়টি নিয়ে কথা বললে বাজুস সভাপতি গঙ্গাচরণ মালাকার তা অস্বীকার করেন। তার দাবি, এমন কোনো বিষয়ই নেই। বাজারদর অনুসারেই নিলামে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে স্বর্ণ কিনে নেন ব্যবসায়ীরা।
তিনি আরও বলেন, দেশের বাজারে স্বর্ণের চাহিদা রয়েছে। বাংলাশে ব্যাংক এখনো নিলামের আয়োজন করলে যথেষ্ট সারা পাবে।
উল্লেখ, শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের ওই প্রতিবেদন প্রকাশের পর ভল্টে রাখা স্বর্ণে কোনো প্রকার হেরফের হয়নি বলে দাবি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। মঙ্গলবার এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি করে প্রতিষ্ঠানটি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়, ভল্টে স্বর্ণ যেভাবে রাখা হয়েছিল সেভাবেই আছে। কোনো প্রকার হেরফের হয়নি। একটি ক্ল্যারিক্যাল মিসটেকের (করণিক ভুল) কারণে স্বর্ণের মানের পার্থক্য দেখা দিয়েছে। এ বিষয়ে এনবিআর ও শুল্ক গোয়েন্দাকে চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে।
করণিক ভুলের ব্যাখ্যা দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, একটি রিং মানের বিষয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব স্বর্ণকার যখন এটি পরিমাণ করেন তখন বলেছিলেন, সেই রিংয়ে ৪০ শতাংশ স্বর্ণ আছে। কিন্তু পরে প্রতিবেদন করার সময় ভুলে ৪০ কে ৮০ (ইরেজিতে শব্দ মনে করে) লিখা হয়। পরে শুল্ক গোয়েন্দা ভল্ট পরিদর্শন শেষে এ বিষয়ে প্রশ্ন তুললে তাদের ব্যাখ্যা দেয়া হয়।
২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্ট পরিদর্শন কার্যক্রম পরিচালনা করে শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতর। গত জানুয়ারিতে শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতরের মহাপরিচালক বরাবর প্রতিবেদন জমা দেয় পরিদর্শক দল। গত ২৫ জানুয়ারি প্রতিবেদনটি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান বরাবর পাঠানো হয়। পরিদর্শন দল ভল্টে রাখা সোনার যাচাই-বাছাই শেষে বেশকিছু পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে।
এমএ/এসআই/জেডএ/বিএ