ভিডিও EN
  1. Home/
  2. বিশেষ প্রতিবেদন

ভারতের সঙ্গে রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতা ‘সাময়িক’

সায়েম সাবু | প্রকাশিত: ১১:২৩ এএম, ১৮ জুলাই ২০১৮

আলতাফ পারভেজ। দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করেন। সমাজ, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির ওপর আঞ্চলিক রাজনীতির প্রভাব নিয়ে লেখালেখি করেন। ‘বাংলাদেশের রাজনীতি ভারতমুখী’- এমন বিষয়বস্তু নিয়ে সম্প্রতি মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের নিয়ন্ত্রণ দীর্ঘস্থায়ী হবে না। এ দেশের মানুষ রাজনৈতিক, সামাজিক ও ঐতিহাসিক কারণে ভারতের কর্তৃত্ব এড়িয়ে চলতে চান। ‘অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কাঠামো দুর্বল বলেই ভারতের দ্বারস্থ হতে হয় বাংলাদেশের বিভিন্ন দলকে।’

সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন সায়েম সাবুদুই পর্বের প্রথমটি থাকছে আজ।

জাগো নিউজ : জাতীয় নির্বাচন ঘিরে রাজনীতিতে ফের গুরুত্ব পাচ্ছে ভারত। বলা হচ্ছে, ‘বাংলাদেশের রাজনীতি এখন ভারতমুখী’। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আপনি গবেষণা করছেন। এর ব্যাখ্যায় কী বলবেন?

আলতাফ পারভেজ : দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাসের একজন পাঠক হিসেবে ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক দেখতে আমি সাধারণত অভ্যস্ত। এখন রাজনীতির অন্যতম আলোচনা হচ্ছে, বাংলাদেশ ভারত অভিমুখী হয়েছে কিনা? আলোচনা করতে গিয়ে আমাকে একজন বললেন, বাংলাদেশ ভারত অভিমুখে যাত্রা করেছে। আমি এ পর্যবেক্ষণ নিয়ে ভিন্নমত পোষণ করি। দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ভারত অভিমুখে যাত্রা করেছে, এটি ভুল ধারণা।

জাগো নিউজ : কেন ভুল মনে করছেন? বাংলাদেশের রাজনীতি তো এখন একমুখী…

আলতাফ পারভেজ : কয়েকটি কারণ দিয়ে আমি এর ব্যাখ্যা করতে চাই। দেখেন, একটি দেশ যদি আরেকটি দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে অথবা আরেকটি দেশের প্রতি নিবেদিত হয়, তাহলে তার একটি সাংস্কৃতিক প্রকাশ থাকে। সেটা নানা ফর্মেই হতে পারে।

খেলা একটি সাংস্কৃতিক মাধ্যম। আন্তর্জাতিক কোনো ইভেন্টে যদি ভারত খেলে দেখবেন, বাংলাদেশের মানুষ খুব একটা ভারতকে সমর্থন করছে না। অন্তত আমি তা দেখিনি। কিছু সমর্থক হয়তো আছে। কিন্তু ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক যেভাবে দেখা হয়, সেই সম্পর্কের অভিপ্রকাশ আমরা দেখতে পাই না।

এরপর ঐতিহাসিক কারণ দেখেন। গত ৫০ বছরে আমাদের দেশটা দু’বার স্বাধীন হয়েছে। ১৯৪৭ এবং ১৯৭১ সালে। ভারত ভেঙে পাকিস্তান সৃষ্টি হলো। ওই সময় বিশ্ব রাজনীতিতে এটি একটি বড় ঘটনা। ভারত ভেঙে নতুন রাষ্ট্র গড়ে ওঠার পেছনে পূর্ব বাংলার মানুষ এবং রাজনীতি সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকা রেখেছেন। নানা জায়গাতেই তখন আন্দোলন হয়েছে। কিন্তু পূর্ব বাংলায় যে আন্দোলনের প্রভাব, তা অন্য কোথাও দেখা যায়নি।

ভারত ভেঙে যে জনপদের সৃষ্টি সেই জনপদের মানুষরা চট করে ফের ভারতের জন্য কাঁদবে, তা মনে করার কোনো কারণ নেই।

জাগো নিউজ : কিন্তু পাকিস্তান নিয়েও কিন্তু বাঙালির স্বস্তি ছিল না…

আলতাফ পারভেজ : বাংলাদেশের রাজনীতির প্রধান জনপ্রিয় পুরুষ কারা? বঙ্গবন্ধু, মাওলানা ভাসানী এবং জিয়াউর রহমানই রাজনীতির প্রধান পুরুষ বলে দলগুলো মনে করে। কিন্তু তাদের রাজনীতি কি ভারতমুখী ছিল? না।

খুব নির্মোহভাবে দেখলে বলবেন, বঙ্গবন্ধু, ভাসানী, জিয়াউর রহমান- তিনজনই ভারতের ব্যাপারে ক্রিটিক্যাল। তবে সে মাত্রা কমবেশি হতে পারে। এ বিশ্বাসেই তারা জনপ্রিয়। অর্থাৎ এ বিশ্বাস তারাও ধারণ করেন।

জাগো নিউজ : এ ব্যাখ্যায় আর কী মাপকাঠি যোগ করবেন?

আলতাফ পারভেজ : পুরো দক্ষিণ এশিয়া এখন চীনমুখী। নেপাল কিন্তু স্বাধীন দেশ নয়। ১৯৫০ সালের ভারত-নেপালের চুক্তির কারণে নেপালের এখনও সার্বভৌমত্ব নেই। সেই নেপাল কিন্তু ভারতের কর্তৃত্ব থেকে বেরিয়ে এলো। নেপালের প্রধানমন্ত্রী চীন গেলেন। ১০টার মতো চুক্তি করে এলেন। চীন নেপালে বিলিয়ন বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করছে। কাঠমান্ডুর সঙ্গে রেল যোগাযোগ করছে।

শ্রীলঙ্কা ভারতের ঘের থেকে বেরিয়ে এখন চীনের ঘেরে। চীন সেখানে পোর্ট (বন্দর) করে দিল। মালদ্বীপ তো এখন ভারতীয়দের ভিসা দিতেই অস্বীকার করছে। এই তিন দেশ কিন্তু বাংলাদেশের চেয়েও ভারতের কাছাকাছি ছিল।

তার মানে বাংলাদেশের জনগণ ও নীতিনির্ধারণকারীরা অবশ্যই এত বোকা নন যে, তারা আঞ্চলিক এ ভূ-রাজনীতি বুঝবেন না। অন্তত আমি তা বিশ্বাস করি না। যে দেশ ৫০ বছরে দু’বার স্বাধীন হয়েছে, তার রাজনীতি এত অপরিপক্ব হবে না যে, সে তার ভূ-রাজনীতি আমলে নেবে না। সবাই যাচ্ছে একদিকে, আর আপনি একাই অন্যদিকে যাবেন, তা তো হয় না।

জাগো নিউজ : বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বললেন। একই বিষয়ে ভারতকে কীভাবে দেখছেন?

আলতাফ পারভেজ : বাংলাদেশ একেবারে নিবেদিত, ভারতও সেটা বিশ্বাস করে না।

আপনি সীমান্ত পরিস্থিতি, পানি ইস্যু, আন্তঃবাণিজ্য দেখেন। দেখবেন, এ বিষয়গুলো দিয়ে প্রমাণের সুযোগ নেই যে, দুই দেশের মধ্যে প্রবল বন্ধুত্ব কাজ করছে।

যৌথ নদী কমিশনের ৩৭তম বৈঠকের পর আর কোনো বৈঠক হয়নি। অগ্রগতি তো দূরের কথা। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের অন্যতম বিষয় হচ্ছে পানি। অথচ সেই বিষয়েও ফারাক তীব্র।

জাগো নিউজ : কিন্তু উপরিতলের আলোচনায় তো ভারত গুরুত্ব পায়। বিশেষ করে গত নির্বাচনে আমরা তা-ই দেখেছি…

আলতাফ পারভেজ : নীতিনির্ধারকরা বলছেন, ভারত-বাংলাদেশের মধ্যকার সম্পর্ক ইতিহাসের সর্বোচ্চ মাত্রায় এখন। গণমাধ্যমে হয়তো তাই দেখছি।

আবার গণমাধ্যমেই আমরা সীমান্তের বিষয়ে কী দেখছি! বিনিয়োগ বিষয়ে, বাণিজ্যিক ভারসাম্যের বিষয়ে আমরা কী দেখছি! অসামঞ্জস্যপূর্ণ বাণিজ্যিক ভারসাম্য আগেও ছিল। এখন আরও বাড়ছে। সীমান্তে হত্যাকাণ্ড এখনও হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে, ত্রিপুরায়, আসামে বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা ছিল। এখন প্রবল হয়েছে। অবৈধ বাংলাদেশি বলে এখনও প্রচারণা আছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে কূটনৈতিক বিষয় দেখেন, সর্বোচ্চ খারাপ পর্যায়ে। তার মানে, ভালো বন্ধুত্বের সঙ্গে এ নিয়ামকগুলো যায় না। বাস্তবতার বাইরে গিয়ে গবেষণা হতে পারে না।

জাগো নিউজ : কিন্তু এসবের পরও তো ঘনিষ্ঠতার প্রকাশ ঘটছে?

আলতাফ পারভেজ : হ্যাঁ, কোনো রাজনৈতিক দল বা কোনো কোনো ব্যক্তিকে নিয়ে আপনি এমন ভাব প্রকাশ করতেই পারেন। ঐতিহ্যগতভাবে কয়েকটি রাজনৈতিক দল ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বা ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করছে। এ ধারায় এখন আরও দল যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করছে। বিএনপির কথা এখন বলতেই পারেন। তার মানে যারা ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ নয়, তারাও এখন চেষ্টা করছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, এখানেই। বাংলাদেশ এবং রাজনৈতিক দলকে একেবারে পৃথক করেই এর মূল্যায়ন করতে হবে। ভারতের সঙ্গে রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতা সাময়িক। একে টেকসই প্রবণতা বলা যায় না। এর কারণ হিসেবে আমি সামাজিক, রাজনৈতিক বাস্তবতার কথা উল্লেখ করেছি।

আওয়ামী লীগের আস্থার নেতা বঙ্গবন্ধু, জিয়াউর রহমানের প্রতি আস্থা বিএনপির। এ দুই নেতার আদর্শই কর্মীরা অনুসরণ করেন। কিন্তু এ দুই নেতার রাজনৈতিক প্রোফাইল দেখেন, ভারতের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠতা তীব্র নয়।

জাগো নিউজ : সময়ের সঙ্গে ইতিহাস বদলায়। আর বাস্তবতায় ভর করেই ইতিহাসের বিনির্মাণ…

আলতাফ পারভেজ : ইতিহাস বদলাতেই পারে। মালদ্বীপের সঙ্গে তো চীনের গভীর সম্পর্ক ঘটল। কিন্তু আমাদের এখানে পরিবর্তনের সূচকগুলো তো অনুপস্থিত।

পানি নিয়ে আলোচনা থমকে আছে। ভারতের পেটের মধ্যে বাংলাদেশ। বাংলাদেশে ভারতের বিনিয়োগই বেশি হওয়ার কথা। কিন্তু হয়নি। আগে কাঁটাতার ছিল না। এখন হচ্ছে। ইতিহাস বদলাচ্ছে বটে, তবে সেটা নেতিবাচকভাবে। তার মানে সম্পর্কের নতুন মাত্রা, এটি প্রমাণ করা তো কঠিন।

জাগো নিউজ : ‘ভারত অভিমুখে বাংলাদেশের যাত্রা’- এ আলোচনা কি শুধুমাত্র থিউরিটিক্যাল ব্যাখ্যা দিয়েই উড়িয়ে দেবেন?

আলতাফ পারভেজ : থিউরিটিক্যাল আলোচনা হলেও বাস্তবতার বাইরে তো নয়।

জাগো নিউজ : সম্পর্কের চলমান রূপায়নও তো বাস্তবতার নিরিখেই মূল্যায়ন করতে হয়…

আলতাফ পারভেজ : আপনি হয়তো বলতে চাইছেন, বাংলাদেশের রাজনীতির পরিমণ্ডল ভারত দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে। আংশিক সত্য বটে। তবে সেটা ঘটছে আমাদের এখানে কিছু কিছু রাজনৈতিক দলের প্রতিষ্ঠানগত কাঠামোয় ভর না করার কারণে। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ গড়ে না ওঠার সংকট থেকেই ভারত গুরুত্ব পাচ্ছে।

জাগো নিউজ : যদি বিশ্লেষণ করতেন…

আলতাফ পারভেজ : বাংলাদেশে এমন কোনো পরিবার পাবেন না যেখানে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সমর্থক নেই। তার মানে, দল দুটি প্রতিটি পরিবারে চলে গেছে। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গর্ব করার মতো দল। কিন্তু আসলে দলগুলো প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে ওঠেনি।

দ্বিতীয়ত, সাংবিধানিক এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোও দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে। এ কারণেই সাময়িকভাবে কিছু কিছু দেশ বা শক্তি এসে আমাদের এখানে প্রভাব বিস্তারের সুযোগ পাচ্ছে। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতার কারণে এমন হচ্ছে, এটি আসলে জাতিগত নয়।

জাগো নিউজ : আপনি সাময়িক বলছেন কেন? আশির দশক থেকেই তো ভারত একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টায় আছে…

আলতাফ পারভেজ : আশির দশক থেকেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সংকট তীব্র হয়। রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতা, সামরিক সরকারের প্রভাবের কারণেই এ দুর্বলতা। রাজনৈতিক দলগুলোর চূড়ান্ত ক্ষয় হয়তো দেখছেন। এরপরও আমি বলব, এটি সাময়িক।

জাগো নিউজ : স্বাধীনতার অর্ধশত বছরে বাংলাদেশ। এরপরও সাময়িক বলছেন কেন?

আলতাফ পারভেজ : আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যে সমর্থকগোষ্ঠীর ওপর দাঁড়িয়ে, সেই গোষ্ঠী অর্ধশত বছরে দুবার স্বাধীনতা লাভ করেছে।

তার মানে, জনগণের মাঝে প্রচণ্ড রকমের সার্বভৌমত্বের চেতনাবোধ রয়েছে। এমন সমর্থকদের কোনো রাজনৈতিক দল যদি ভারতকে অযৌক্তিক কোনো সুবিধা দিতে চায়, তাহলে সমর্থকরা মেনে নেবে না। রাজনৈতিক নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে সমর্থকদের দূরত্ব বাড়বে। এটা হতে বাধ্য।

জাগো নিউজ : সময় তো তা বলে না। ভারতের হস্তক্ষেপ তো মেনেই নিচ্ছে জনগণ। দলগুলো ভারতপ্রীতি দেখালেও সমর্থকরা তো ঘুরে দাঁড়াচ্ছে না?

আলতাফ পারভেজ : সংকট তৈরি হচ্ছে এবং এটি আমার-আপনার বিবেচনায় অনেক বড়কিছু বলে মনে হচ্ছে হয়তো। অনেকেই এ বাস্তবতা থেকে মূল্যায়ন করছেন। কিন্তু একটি জাতির মতামত পুনর্গঠনের জন্য বেশ সময় লাগে। আমি এ কারণেই ‘সাময়িক’ শব্দটি বারবার বলছি। সময় নিয়ে পুনর্গঠন ঘটবেই। ভারত ও বাংলাদেশ- উভয়ই একসময় বুঝতে পারবে যে, আসলে কী ভুলগুলো হয়েছে…

এএসএস/এমএআর/আরএস/আরআইপি

আরও পড়ুন