এক অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে এত অভিযোগ!
রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় অবস্থিত শহীদ জিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজ। কলেজটির অধ্যক্ষ ফাতেমা রশিদের বিরুদ্ধে স্কুল পরিচালনায় অনিয়ম, শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি, শিক্ষক বহিষ্কার, আর্থিক অনিয়মসহ নানা ধরনের অভিযোগ উঠেছে।
যদিও অধ্যক্ষ ফাতেমা রশিদ তার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগগুলো অস্বীকার করেছেন। অভিযোগের ভিত্তিতে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) নির্দেশে তদন্তকাজ শুরু হয়েছে। ঢাকা জেলা শিক্ষা অফিসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বিষয়টি তদন্ত করে দেখছেন।
অধ্যক্ষ ফাতেমা রশিদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় উত্থাপিত অভিযোগে বলা হয়েছে, ফাতেমা রশিদ ১৯৯৩ সালের ১ নভেম্বর স্কুল শাখায় ধর্মবিষয়ক শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। এক বছরের মাথায় তিনি ইসলাম শিক্ষা বিভাগের প্রভাষক পদে নিয়োগ পান। কিন্তু তার ওই পদোন্নতিতে সঠিক নিয়ম মানা হয়নি। বিধি অনুযায়ী পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। কিন্তু তা না করে তাকে প্রভাষক পদে নিয়োগ দেয়া হয়।
অভিযোগে আরও উল্লেখ করা হয়, ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ থাকা অবস্থায় ফাতেমা রশিদ ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর অধ্যক্ষ পদের জন্য পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেন। ওই বছরের ২৪ নভেম্বর তিনি ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের পদ থেকে অব্যাহতি নিয়ে ২৫ নভেম্বর অধ্যক্ষ পদে যোগ দেন। অর্থাৎ নিজের নিয়োগ প্রক্রিয়া তিনি নিজেই এককভাবে সম্পন্ন করেন!’
‘এরপর নিজের অধ্যক্ষ পদের এমপিও আবেদনের কাগজপত্রের সঙ্গে কলেজেরই এক সহকারী অধ্যাপক বুলবুল মির্জাকে অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ দেখান। অথচ বুলবুল মির্জার ভাগ্যে একদিনের জন্যও দায়িত্ব মেলেনি।’
এ অভিযোগের প্রমাণস্বরূপ ওই সময় কলেজের প্রশাসনিক কার্যক্রমের সব ফাইলে অধ্যক্ষের স্বাক্ষরের স্থানে ফাতেমা রশিদের স্বাক্ষর থাকা ডকুমেন্ট অভিযোগপত্রের সঙ্গে সংযুক্তি দেখানো হয়েছে।
এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির একাধিক শিক্ষক নাম প্রকাশ না করে জানান, অধ্যক্ষ ফাতেমা রশিদ মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে একজন শিক্ষককে সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেন। এছাড়া ২০১৬ সালের নভেম্বরের বেতনের সঙ্গে ওই শিক্ষকের বকেয়া বেতন হিসাবে এক লাখ ৬২ হাজার ৫৮৬ টাকা পাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন।
তারা জানান, তুচ্ছ কারণে তিনি (অধ্যক্ষ ফাতেমা রশিদ) শিক্ষকদের চাকরিচ্যুতের হুমকি দেন। চারজন শিক্ষককে এমন হুমকি এবং তাদের অকথ্য ভাষায় গালাগালি করেন। তার এমন অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় বিভিন্ন সময়ে চার শিক্ষককে চাকরিচ্যুত করা হয়। এ বিষয়ে রিট করে তারা স্বপদে বহাল রাখার আদালতের রায় পেলেও সেই নির্দেশনা অমান্য করা হচ্ছে।
ভুক্তভোগী শিক্ষকরা আরও জানান, ফাতেমা রশিদ অধ্যক্ষ হওয়ার পর থেকে ইসলাম শিক্ষা বিষয়ে কোনো ক্লাস নেননি। অথচ প্রতি মাসে ইসলাম শিক্ষার প্রভাষক হিসেবে কলেজ থেকে টাকা উত্তোলন করেছেন। তার (অধ্যক্ষ ফাতেমা রশিদ) বদলে ইসলাম শিক্ষা বিষয়ে ক্লাস নেয়ার জন্য এক শিক্ষককে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ওই শিক্ষককে এজন্য প্রতি মাসে আট হাজার টাকা বেতন দেয়া হয়।
শহীদ জিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজের অভিযোগকারী শিক্ষকরা জানান, এসব অনিয়ম বন্ধে বিভিন্ন সময় প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষকরা ঢাকা শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট দফতরে অভিযোগ করেন। কিন্তু ক্ষমতাসীন হওয়ায় তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না বলেও অভিযোগ তাদের।
তারা জানান, অধ্যক্ষ ফাতেমা রশিদের কাছে শিক্ষকরা নানভাবে লাঞ্ছিত ও অপদস্ত হয়ে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর (মাউশি), পরিচালক পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদফতর, ঢাকা জেলা প্রশাসক, জেলা শিক্ষা অফিস, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ দাখিল করেছেন।
শিক্ষকরা তাদের অভিযোগে আরও উল্লেখ করেন, অধ্যক্ষ ফাতেমা রশিদ পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে কলেজের নামে একটি মাইক্রোবাস কেনেন। অথচ তিনি ওই গাড়ির দাম ১৬ লাখ টাকা দেখিয়ে প্রতিষ্ঠান থেকে উত্তোলন করেন। গাড়ি কেনার কোনো ভাইচার বা ক্যাশমেমো তিনি কলেজে জমা দেননি।
এছাড়া অধ্যক্ষ হওয়ার পর কলেজের ছাত্রীদের কাছ থেকে একদিনের গড়হাজির বাবদ ২০ থেকে ৫০ টাকা করে জরিমানা আদায় করেন। এভাবে জরিমানা আদায়ের প্রায় আট লাখ টাকা তিনি আত্মসাৎ করেন। একই সঙ্গে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্রীদের কাছ থেকে নেয়া বেতন ও সেশন ফি’র টাকা ফান্ডে জমা না দিয়ে ২০০৯ সালের পর থেকে আরও আট লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।
স্কুলে নাছিমা নামে কোনো শিক্ষককে নিয়োগ না দিয়েও মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে মাউশিতে ওই অস্তিত্বহীন শিক্ষকের এমপিওভুক্ত করিয়েছেন অধ্যক্ষ ফাতেমা রশিদ। স্কুল ভবন সংলগ্ন চারটি দোকান নির্মাণ বাবদ ১৫ লাখ টাকা কলেজ তহবিল থেকে উত্তোলন করলেও এর বিপরীতে কোনো ভাউচার তিনি জমা দেননি।
ফাতেমা রশিদ ১৯৯৩ সালে স্কুলের ধর্মবিষয়ক শিক্ষক, ১৯৯৪ সালে ইসলাম শিক্ষা পদে প্রভাষক এবং ২০০৬ সাল থেকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ পদে চাকরি করে তিনি পূর্ব ধলপুরে আলিসান বাড়ি নির্মাণ করেছেন, দয়াগঞ্জ ও বেইলি রোডে ফ্ল্যাট কিনেছেন, ট্রান্স সিলভা পরিবহনে তার শেয়ার রয়েছে, গুলিস্তানের আন্ডার গ্রাউন্ডে কয়েকটি দোকান নিয়েছেন, ২৫ লাখ টাকা মূল্যের ব্যক্তিগত গাড়ি এবং নামে-বেনামে ব্যাংকে মোটা অঙ্কের অর্থ রয়েছে বলেও অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, অধ্যক্ষ ফাতেমা রশিদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের ভিত্তিতে মাউশির নির্দেশে তদন্তকাজ শুরু হয়েছে। ঢাকা জেলা শিক্ষা অফিসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এটি তদন্ত করে দেখছেন।
ঢাকা জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা গৌর চন্দ্র মন্ডল এ বিষয়ে জাগো নিউজকে বলেন, ইতোমধ্যে দু’দফায় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে সরেজমিন গিয়ে অভিযোগ খতিয়ে দেখেছেন তারা। তদন্তকাজ শেষ, এখন প্রতিবেদন তৈরি হচ্ছে। আশা করছি আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন মাউশিতে জমা দিতে পারব।
অন্যদিকে, মাউশির অধীনস্থ পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদফত থেকেও এ বিষয়ে তদন্তকাজ শুরু করা হবে বলে জানা গেছে। অধিদফতরের পরিচালক অধ্যাপক মো. সাজ্জাত রশীদ বলেন, শহীদ জিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে তিনটি আভিযোগ জমা পড়েছে। জনবল সংকটের কারণে এখনও তদন্তকাজ শুরু করতে পারিনি। তবে বিষয়টি আমাদের বিবেচনায় আছে।
তিনি আরও বলেন, অভিযোগপত্রে প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে বেশকিছু অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। বিষয়গুলো খতিয়ে দেখতে দ্রুত আমরা তদন্তকাজ শুরু করব। অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে বিধিমোতাবেক ব্যবস্থা নিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করা হবে।
তবে অধ্যক্ষ ফাতেমা রশিদের বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ মিথ্যা বলে দাবি করেছেন স্কুলটির ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি নজরুল ইসলাম। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে সব অভিযোগ ষড়যন্ত্রমূলক। এসব অভিযোগের কোনো সত্যতা নেই। জেলা শিক্ষা অফিসারের অধীনে বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।’
‘উত্থাপিত অভিযোগের কোনো সত্যতা আছে কি না- তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ হলেই জানা যাবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি পরিচালনায় আইনবহির্ভূত কোনো কাজে অধ্যক্ষ যুক্ত নন’ বলেও দাবি করেন তিনি।
অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে জানতে চাইলে কলেজটির অধ্যক্ষ ফাতেমা রশিদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার নিয়োগ ও পদোন্নতিতে যদি অনিয়ম হয়ে থাকে তাহলে সেটা স্কুলটির ম্যানেজিং কমিটিই ভালো বলতে পারবে। এছাড়া আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তোলা হয়েছে তা তদন্ত করে যদি সত্যতার প্রমাণ মেলে, তাহলে যে শান্তি দেয়া হবে আমি তা মাথা পেতে নেব।’
এমএইচএম/এমএআর/এমএস