প্রযুক্তিতে মাদকের বেচাবিক্রি, পিছিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের অন্যতম মাদক স্পট জেনেভা ক্যাম্পে র্যাব ও পুলিশের দু’দফা অভিযান পরিচালিত হয়। সেখান থেকে দুই শতাধিক মাদক ব্যবসায়ী ও সেবনকারীকে গ্রেফতারও করা হয়। সরেজমিন জেনেভা ক্যাম্প পরিদর্শনে আগের মতো প্রকাশ্যে মাদক বিক্রির কোনো চিত্র দেখা যায়নি।
ক্যাম্পে খুচরা মাদক ব্যবসায়ীদের বিচরণ লক্ষ্য করা গেলেও অপরিচিত কারও কাছে তারা মাদক বিক্রি করছেন না। ক্যাম্পের এক মাদকাসক্ত যুবক জাগো নিউজকে জানান, ক্যাম্পে এখনও মাদক বিক্রি হয়। শুধু পরিচিতদের কাছে তা বিক্রি করা হয়। সামাজিক যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ইমোর মাধ্যমে মেসেজ দিলে ব্যবসায়ীরা অন্যত্র মাদক (গাঁজা) পৌঁছে দেন। ক্যাম্পের ভেতর ইয়াবা কিংবা অন্য কোনো মাদক বিক্রি হয় না।
আরও পড়ুন >> রাঘব বোয়ালরা থাকছে ধরাছোঁয়ার বাইরে
সেখানকার কয়েকজন মাদক সেবনকারীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে অনলাইনে বিশেষ করে ফেসবুক পেজের মাধ্যমে বিক্রি হচ্ছে ইয়াবা, গাঁজার মতো মাদক। আগে বিয়ার ও মদের জন্য অনলাইন মাধ্যম খুব জনপ্রিয় হলেও বর্তমানে সব মাদকই মিলছে অনলাইনে। সম্প্রতি এ ধরনের পাঁচটি পেজ শনাক্ত করেছে পুলিশের সাইবার ক্রাইম কন্ট্রোল ইউনিট। তদন্তের মাধ্যমে তারা জানতে পেরেছেন, পালিয়ে বেড়ানো রাঘববোয়ালরাই এসব অনলাইন পেজ পরিচালনা করছেন এবং এসব পেজের মাধ্যমে মাদক কেনাবেচা হচ্ছে।
এ বিষয়ে পুলিশের সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম (সোশ্যাল মিডিয়া মনিটরিং) বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) নাজমুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘এ ধরনের ৪-৫টি পেজ শনাক্ত করা হয়েছে। অনলাইনে পুলিশের নজরদারি টের পেয়ে ইতোমধ্যে কয়েকটি পেজ তাদের মাদক বিক্রির কনটেন্টগুলো সরিয়ে ফেলেছে। তবুও যেটুকু (কনটেন্ট) পেয়েছি সেগুলো অভিযানের স্বার্থে প্রকাশ করা হচ্ছে না।’
‘আমরা অভিযানের জন্য ইন্টেলিজেন্স ও ইনফরমেশন গ্যাদার করছি। অফলাইন ও অনলাইনের মাদক বিক্রেতাদের গডফাদাররা একই’- বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘ইন্টারনেট ছাড়া ডার্ক ওয়েবের মাধ্যমেও মাদকের কেনাবেচা হচ্ছে। ডার্ক ওয়েবে মাদক বিক্রি খুবই অ্যালার্মিং একটি বিষয়। এখানে হেরোইন, কোকেন ও আফিমের মতো মাদক বিক্রি হয়।’
আরও পড়ুন >> ধরা পড়েছিল ‘ইয়াবাসম্রাট’ ইশতিয়াক?
‘এখানকার বিক্রেতাদের শনাক্ত করা একটু জটিল। কারণ ডার্ক ওয়েবের কনটেন্ট ট্র্যাক করে মাদক বিক্রেতা পর্যন্ত পৌঁছানো খুবই কষ্টসাধ্য। টেকনোলজির দিক দিয়ে এ বিষয়ে আমরা একটু পিছিয়ে আছি। তবে শিগগিরই আমরা ডার্ক ওয়েব কন্ট্রোল করতে পারব বলে আশা করছি। যদি এটি আমাদের কন্ট্রোলে আসে, তাহলে মাদকের বড় চালানের তথ্য বের করে গডফাদারদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে।’
কেন মাদকমুক্ত হচ্ছে না জেনেভা ক্যাম্প
ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও অঞ্চলের উপকমিশনার (ডিসি) বিপ্লব কুমার সরকার জাগো নিউজকে বলেন, ‘যদি মাদকের প্রবেশ ও সাপ্লাই লাইন কাট করা না যায় তাহলে কোথাও না কোথাও মাদক থাকবেই। সেটা জেনেভা ক্যাম্পে কেন ওয়ারী, ধানমন্ডি, মিরপুর- কোনো স্পটই মাদকমুক্ত করা যাবে না। মাদক সেখানে প্রবেশ করবেই।’
‘জেনেভা ক্যাম্পের বিষয়টি একটু ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখতে হবে’ উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘একটা সম্প্রদায়ের ৪০ থেকে ৫০ হাজার লোক একসঙ্গে সেখানে বসবাস করে। তাদের বিনোদনের কোনো ব্যবস্থা নেই। পড়াশোনা, কাজকর্ম, খেলাধুলারও কোনো সুযোগ নেই। রয়েছে অভাব-অনটন। একটা মানুষকে তো ভালোভাবে বাঁচার সুযোগ দিতে হবে। সমাজ বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে দেখলে, জেনেভা ক্যাম্পে তো কিছুই নেই। এ কারণে এখানকার লোকজন মাদক সেবনই বিনোদন হিসেবে বেছে নিয়েছেন। তাদের পুনর্বাসনে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেয়া প্রয়োজন।’
মোহাম্মদপুর থানার ওসি জামালউদ্দিন মীর এ প্রসঙ্গে জাগো নিউজকে বলেন, ‘জেনেভা ক্যাম্পের মাদক ব্যবসা এখন পাঁচ ভাগে নেমে এসেছে। এখানে অনেকে আছেন যাদের কোনো শিক্ষা নেই, কোনো কাজ নেই। তারা মাদকের ভয়াবহতা সম্পর্কে জানেন না, তাই মাদকের ব্যবসা করেন।’
আরও পড়ুন >> ধরা হয় কিন্তু সাজা হয় না
‘তাদের জন্য একটু উন্নতমানের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা, সর্বোপরি একটু ভালোভাবে বেঁচে থাকার পরিবেশ তৈরি করা না গেলে কোনোভাবেই এখানকার মাদক ব্যবসা শূন্যের কোটায় নামানো সম্ভব হবে না’- যোগ করেন তিনি।
বাংলাদেশে আটকে পড়া পাকিস্তানিদের ফিরিয়ে নিতে কাজ করা সংগঠন দ্য স্ট্রান্ডেড পাকিস্তানিজ জেনারেল রিপ্যাট্রিয়েশন কমিটির (এসপিজিআরসি) সভাপতি আব্দুল জব্বার খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘এখন জেনেভা ক্যাম্পে মাদক নেই বললেই চলে। জেনেভা ক্যাম্প মাদকশূন্য করতে পুলিশের পাশাপাশি আমরা নিজেরাও কাজ করছি। প্রতিটি গলিতে ৩-৪ জন করে স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। তারা মাদকের বিরুদ্ধে লড়বেন।’
‘আমাদের কথা হচ্ছে জেনেভা ক্যাম্পে মাদক প্রবেশ করে কীভাবে? টেকনাফ থেকে মাদকের সাপ্লাই চেইন বন্ধ করতে পারলে জেনেভা ক্যাম্পে তো মাদক প্রবেশ করতে পারবে না। আর প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে মাদকের বিক্রি হলে তো আমাদের করার কিছুই নেই।’
অনলাইনে মাদক ব্যবসা ও মনিটরিংয়ের বিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মুকুল জ্যোতি চাকমা জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা এ ধরনের অনেক কেস পেয়েছি, তবে এ ধরনের অপরাধীদের ধরতে যে ধরনের প্রযুক্তি দরকার আমাদের তেমন সুযোগ নেই। এ সংক্রান্ত আসামি ধরার ক্ষেত্রে আমরা পুলিশের সহযোগিতা নেই।’
আরও পড়ুন >> মাদক নিয়ন্ত্রণে আইন সংশোধন হচ্ছে : প্রধানমন্ত্রী
জেনেভা ক্যাম্পের বাসিন্দাদের মানবেতর জীবনযাপনের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ও সাবেক তথ্য কমিশনার অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম জাগো নিউজকে বলেন, ‘কাজের সুযোগ কম থাকায় রোহিঙ্গাদের দিয়ে যেমন মাদকের ব্যবসা করতে বাধ্য করা হয়, তেমনি জেনেভা ক্যাম্পের লোকদের দিয়ে একই ধরনের কাজ করানো হয়।’
‘জেনেভা ক্যাম্পের মানুষদের দৈনন্দিন জীবনযাপনের মানোন্নয়ন এবং তাদের বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে স্থানীয় সংসদ সদস্য, ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও জনপ্রতিনিধিদের এগিয়ে আসতে হবে। তাদের জন্য নিয়মিত বিনোদনের ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া রাষ্ট্র ও বেসরকারি সংগঠনগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে।’
জেনেভা ক্যাম্পে নিয়মিত নজরদারির বিষয়ে র্যাবের লিগ্যাল ও মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান বলেন, ‘জেনেভা ক্যাম্পে মাদকবিরোধী অভিযান চালানো হয়েছে। অভিযানের সময় অনেকে আগে থেকেই আত্মগোপনে চলে গেছে। সেখানে নিয়মিত নজরদারিরও ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। আমরা চাই জেনেভা ক্যাম্প পুরোপুরি মাদকমুক্ত হোক।’
এআর/এমএআর/পিআর