ধরা পড়েছিল ‘ইয়াবাসম্রাট’ ইশতিয়াক?
সাভারের হেমায়েতপুরে ডুপ্লেক্স বাড়ি, আশুলিয়ায় গাজীর চট ও বেড়িবাঁধের পাশে নির্মাণাধীন দুটি বাড়ি, উত্তরাতেও রয়েছে একাধিক বাড়ি। সাভারে রয়েছে শত শত বিঘা জমি, রয়েছে বেশ কয়েকটি প্লটও।
আনুমানিক ২৭-৩০ বছরের এ যুবক কখনও মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে, কখনও সাভারের হেমায়েতপুরে থাকেন। জন্মের পর থেকে সংসারে অভাব-অনটন লেগে থাকতো। সংসার চালাতে একেক সময় একেক কাজ করতে হতো। ২০০৭ সালে রাস্তা থেকে পরিত্যক্ত বোতল কুড়িয়ে এবং তা বিক্রি করে সংসার চালাতে হয় তাকে।
এর ঠিক ১০ বছর পর সার্বিক চিত্র পুরোটাই পাল্টে যায়। তিনি এখন শত কোটি টাকার মালিক। ঢাকায় ইয়াবা সরবরাহকারীদের তালিকায় শীর্ষে তার নাম। তিনি আর কেউ নন ‘ইয়াবাসম্রাট’ ইশতিয়াক।
আরও পড়ুন >> টোকাই থেকে শত কোটি টাকার মালিক
মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে জন্ম ইশতিয়াক সম্পর্কে গোয়েন্দা তথ্যে বলা হয়েছে, মাদক বিক্রির টাকা দিয়েই বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন ইশতিয়াক। জেনেভা ক্যাম্পের মাদকের মূল নিয়ন্ত্রক এবং ঢাকা শহরের প্রধান ইয়াবা সরবরাহকারী তিনি। কক্সবাজার থেকে সরাসরি ইয়াবার চালান নিয়ে আসেন। তার বিরুদ্ধে মাদক ও হত্যাসহ ১৫টি মামলা রয়েছে শুধুমাত্র মোহাম্মদপুর থানায়। এর মধ্যে চারটি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের দায়ের করা। তিনটি মামলার অভিযোগপত্র দেয়া হয়েছে। মাদক ব্যবসায় তার প্রধান দুই সহযোগী হলেন- নাদিম হোসেন ওরফে পঁচিশ ও সেলিম ওরফে চুয়া ওরফে চোরা সেলিম।
গোয়েন্দা তথ্যে আরও উল্লেখ রয়েছে, মিয়ানমার থেকে কক্সবাজার সীমান্ত দিয়ে বড় বড় ইয়াবার চালান ঢাকায় আনেন তিনি। প্রতি মাসে একাধিকবার বিমানে কক্সবাজার যান ইশতিয়াক। থাকেন পাঁচ তারকা হোটেলে। সমুদ্রে গোসল করেন। এর ফাঁকে মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করে চালান ঢাকায় পাঠান। বিভিন্ন সময় বিদেশ ভ্রমণও করেছেন তিনি। আবার ফিরে আসেন। কিন্তু কোনোভাবেই গোয়েন্দা জালে ধরা পড়েননি এই মাদকসম্রাট।
মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জামালউদ্দিন মীর বলেন, ‘ইশতিয়াক এলাকার গ্রেট মাদক ব্যবসায়ী। তাকে কয়েকবার ধরার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু প্রতিবারই সে পালিয়ে যায়। তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।’
সম্প্রতি পিবিআইয়ের (পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন) বিরুদ্ধে শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী ইশতিয়াককে ছেড়ে দেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। যদিও পিবিআইয়ের পক্ষ থেকে বিষয়টি অস্বীকার করা হয়েছে।
মাদক নিয়ন্ত্রণে কাজ করে এমন একটি রাষ্ট্রীয় সংস্থা জাগো নিউজকে জানায়, গেল এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় রাজধানীর মতিঝিল এলাকা দিয়ে জিপ গাড়ি নিয়ে যাচ্ছিলেন ঢাকার মাদকসম্রাট ইশতিয়াক। সামনে আরেকটি গাড়িতে ছিল তার দুই সহযোগী। তাদের একজন আরশাদ অপরজন বাবা। পুলিশের ভয়ে ইশতিয়াক যখন গা ঢাকা দেয়, তখন তার মাদক ব্যবসা সামাল দেয় আরশাদ ও বাবা।
মতিঝিলে ওই তিনজনকে বহনকারী দুটি গাড়িই থামান পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) সদস্যরা। আরশাদ ও ইশতিয়াকের অপর এক সহযোগীকে আটক করা হয়। কিন্তু নির্বিঘ্নে যেতে দেয়া হয় পেছনে থাকা ইশতিয়াকের গাড়িটিকে।
সূত্র জানায়, ইশতিয়াককে ‘না ধরার জন্য’কোটি টাকার ‘পুরস্কার’ পেয়েছেন পিবিআই’র দুই কর্মকর্তা। তবে বিষয়টি এখনও প্রমাণিত হয়নি।
এ বিষয়ে পিবিআই, ঢাকা মেট্রোর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মিনা মাহমুদা জাগো নিউজকে বলেন, ‘এ ধরনের কোনো খবর আমাদের জানা নেই। আর কাউকে আটক করা হলে বিষয়টি অবশ্যই ঢাকা মেট্রো অফিস অবগত থাকতো। পুলিশের অন্য কোনো ইউনিট গ্রেফতার করলেও করতে পারে।’
আরও পড়ুন >> অভিযানে হদিস মেলেনি ‘ইয়াবা সম্রাট’ ইশতিয়াকের
গোয়েন্দা সূত্রে আরও জানা যায়, ঢাকায় এসে অধিকাংশ সময় হেমায়েতপুরের বাড়িতে ওঠেন ইশতিয়াক। প্রতিটি বাড়ির নিচতলা ও বাইরের অংশে লাগানো রয়েছে উচ্চ-ক্ষমতাসম্পন্ন সিসিটিভি ক্যামেরা। পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে বসে একটি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে তার কোন বাড়িতে কী হচ্ছে তা প্রত্যক্ষ করতে পারেন তিনি।
ইশতিয়াককে ধরতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থার সদস্যরা একাধিকবার অভিযান চালালেও প্রতিবারই ব্যর্থ হন। সর্বশেষ গত ২১ নভেম্বর ইশতিয়াককে ধরতে হেমায়েতপুরের বাসায় হানা দেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের একটি অভিযানিক দল। সেই বাড়ি থেকে তার ট্রাকড্রাইভারকে আটক করা হয়। তার দেয়া তথ্য মতে, সেদিন আশুলিয়ার সাততলা বাড়িতে সপরিবারে অবস্থান করছিলেন ইশতিয়াক। তবে মাদক নিয়ন্ত্রণের দল পৌঁছানোর ৩০ মিনিট আগেই সেখান থেকে সটকে পড়েন তিনি।
পরে ওই বাসার দারোয়ানসহ কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে অভিযানিক দলের সদস্যরা। তারা জানান, হেমায়েতপুরের বাড়িতে রেইড দেয়ার ঘটনাটি সিসিটিভি ফুটেজে দেখে ফেলেন ইশতিয়াক। সঙ্গে সঙ্গে নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করে চলে যান।
গোয়েন্দারা জানায়, মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে প্রায় ১০টি গ্রুপ মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে। এসব গ্রুপের সদস্যদের বিভিন্ন সময় বিচ্ছিন্নভাবে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ঢাকার ইয়াবার মূল নিয়ন্ত্রক ইশতিয়াক। তার সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হিসেবে কাজ করে নাদিম হোসেন ওরফে পঁচিশ ও সেলিম ওরফে চুয়া ওরফে চোরা সেলিম।
এখন কোথায় ইশতিয়াক
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েকটি সংস্থা জাগো নিউজকে জানায়, ইশতিয়াক মাদকবিরোধী অভিযান চলাকালীন দেশত্যাগ করেছেন। তবে তার অবস্থানের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই কোনো সংস্থার কাছে।
ইশতিয়াককে গ্রেফতারের বিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক খুরশিদ আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘তাকে ধরতে জেনেভা ক্যাম্প ও হেমায়েতপুরে একাধিকবার অভিযান চালানো হয়েছে। অন্যান্য বাহিনীর সঙ্গে যৌথ অভিযানও চালানো হয়েছে। কিন্তু হেমায়েতপুরে ইশতিয়াকের বাসাসহ আশেপাশে একাধিক ক্যামেরা বসানো আছে। ক্যামেরায় অভিযানের বিষয়টি টের পাওয়ার পর সঙ্গে সঙ্গে সে পালিয়ে যায়। দেখা গেছে, আমাদের পৌঁছানোর ৩০ মিনিট আগেই সে সটকে পড়েছে।
‘বর্তমানে সে আত্মগোপনে আছে। তাকে ধরতে গোয়েন্দা নজরদারি চলছে’ বলেও জানান তিনি।
কোথায় আছে নাদিম ওরফে পঁচিশ
ইশতিয়াকের পর গোয়েন্দাদের তালিকায় দ্বিতীয় শীর্ষ ব্যবসায়ী নাদিম হোসেন ওরফে পঁচিশ। মাদকবিরোধী অভিযানে দু’দফা জেনেভা ক্যাম্পে অভিযান চালিয়েও গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি পঁচিশকে। দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, ঈদুল ফিতরের আগের দিন তাকে মোহাম্মদপুরের সূচনা কমিউনিটির পাশে দ্বিতীয় স্ত্রীর বাড়ি থেকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয় দিয়ে একটি দল তুলে নিয়ে যায়। তবে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য কোনো বাহিনীর পক্ষ থেকে দেয়া হয়নি।
আরও পড়ুন >> রাঘব বোয়ালরা থাকছে ধরাছোঁয়ার বাইরে
গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, গত বছরের ৩ নভেম্বর মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্প থেকে পঁচিশকে প্রথমবারের মতো গ্রেফতার করা হয়। সেদিনের আলোচিত ওই অভিযানে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সঙ্গে ছিল র্যাব, পুলিশ, বিজিবি, কোস্টগার্ড, এপিবিএন ও এনএসআইয়ের ২০০ সদস্য। তবে গ্রেফতারের ১২ দিন পর ১৫ নভেম্বর নিম্ন আদালত থেকে চারটি মামলায় জামিন নিয়ে ছাড়া পান তিনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, পঁচিশ একজন চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী। জেনেভা ক্যাম্পে এমন কেউ নেই যে তার মাদক ব্যবসার বিষয়টি জানেন না। ওই গ্রেফতার অভিযানটি আলোচিত এবং অধিদফতরের ইতিহাসে অন্যতম গৌরবের।
‘আদালতের প্রতি যথেষ্ট সম্মান রেখে বলছি, তার জামিনের ফলে অভিযানে অংশ নেয়া অফিসার ও কর্মকর্তারা পরবর্তীতে এ ধরনের অভিযানে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন।’
এআর/এমএআর/আরআইপি