খাদ্যে ভেজালের দায় ভোক্তাদেরও
অধ্যাপক আ ব ম ফারুক। পরিচালক, বায়োমেডিকেল রিসার্চ সেন্টার। অধ্যাপনা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগে। গবেষণা করছেন জনস্বাস্থ্য ও খাদ্যমানের নানা প্রসঙ্গ নিয়ে। বিভিন্ন জার্নালে ভেজালবিরোধী অবস্থান নিয়ে লিখছেন তিনি।
খাবারে ভেজাল, খাদ্যমান, ভেজালবিরোধী অভিযান এবং রাষ্ট্রের দায় নিয়ে সম্প্রতি মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু। তিন পর্বের শেষটি থাকছে আজ।
জাগো নিউজ : খাদ্যে ভেজাল নিয়ে নানা কথা। অভিযোগ অনেকের বিরুদ্ধে। এক্ষেত্রে ভোক্তাদের দায় নিয়ে কী বলবেন?
আ ব ম ফারুক : আমি ভোক্তাদের ওপরেও বিরক্ত। খাদ্যে ভেজালের দায় ভোক্তাদেরও। আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে যখন দেখি বৈশাখ মাসে হিমসাগর আম নিয়ে আসছেন, তখন হতাশ হই। বিরক্ত হই। ফজলি আম দেখলেই ব্যাগভর্তি করে কিনে ফেলছেন অনেকে। অসচেতনতার কারণেই এমন হচ্ছে।
আরও পড়ুন >> কার স্বার্থে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের বিরোধিতা?
প্রাকৃতিক পঞ্জিকা ভোক্তাকেই অনুসরণ করতে হবে। কোন আম কখন নামবে তা ভোক্তাকেও জানতে হবে। সময়ের আগে গাছ থেকে আম পাড়লেই ব্যবস্থা নিতে হবে।
মাথায় রাখতে হবে আমি যদি না কিনি তাহলে ব্যবসায়ীরা ফল অসময়ে বাজারে আনবে না। চাহিদা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। নইলে ফেনসিডিল, ইয়াবার মতো সরবরাহ হবেই। শুধু আইন করে সব বন্ধ করা যায় না। সরকার মাদকের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছে। তাতে মাদকের ব্যবহার কমতে পারে। কিন্তু একেবারে বন্ধ হবে না। বন্ধ হবে যদি মাদকাসক্তরা সেবন না করেন।
ঘ্রাণ, স্বাদ, রং দেখেই ফল কেনা যায়। ফলের দোকানে, মাছের দোকানে মাছি নেই। মাছি নেই বিষের কারণে। মাছি দেখে আমি ফল কিনি। ভোক্তারা একটি মাস আম কেনা বন্ধ করুক। দেখবেন, ভেজাল কমে যাবে।
জাগো নিউজ : সিন্ডিকেটের কাছে তো সবাই ধরা?
আ ব ম ফারুক : হ্যাঁ, অপধনবাদী নীতির কারণে ভেজালে ভরা। কৃষকের হাতে আর কিছুই নেই। সব মধ্যস্বত্বভোগীদের হাতে চলে গেছে। মুকুল আসার আগেই বাগান বিক্রি হয়ে যায়। বাগান বিক্রি করে দিয়েই কৃষক দিনমজুরের মতো শ্রম দিতে থাকেন। কৃষকের লাগানো গাছে ঢাকা থেকে ব্যবসায়ীরা গিয়ে কী স্প্রে করেন, তা হয়তো কৃষক নিজেও জানেন না। অথচ দেখবেন যে ব্যবসায়ীরা বাগান কিনছেন, তিনি নিজেও দু-একটি গাছ স্প্রে করা থেকে বিরত থাকছেন কারণ নিজ পরিবারকে খাওয়াবেন বলে। কিন্তু বাকি আম বাজারে আনছেন বিষ দিয়ে। আর নিজে খাচ্ছেন বিষ ছাড়া।
জাগো নিউজ : এ পরিস্থিতির মধ্যে জনস্বাস্থ্যের ভবিষ্যৎ কী?
আ ব ম ফারুক : দায় রাষ্ট্রের। মাদকে আমরা তাই দেখলাম। মাদকবিরোধী অভিযানে অবশ্যই ভালো ফল আসবে। কিন্তু গডফাদাররা অধরা থাকলে কিছুই হবে না এসব অভিযানে। মূলে যেতে হবে।
একই অবস্থা ভেজালেও। ভেজাল সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি খোদ সরকারও। ভেজালকারীরা মানবতাবিরোধী অপরাধে লিপ্ত- এটি রাষ্ট্রকে বুঝতে হবে। একজন ভেজালকারী হাজার হাজার মানুষের জীবন ঝুঁকির মধ্যে ফেলছেন। কোনো কোনো জায়গায় রাষ্ট্রকে শক্ত অবস্থান নিতে হয়, সেটি এখন সময়ের দাবি।
জাগো নিউজ : এ দাবি তো সবার। কিন্তু রাষ্ট্র ব্যর্থ। আইনে কোনো সমস্যা…
আ ব ম ফারুক : না, আমি তা মনে করি না। উপমহাদেশের মধ্যে বাংলাদেশের আইন সবচেয়ে কড়া বলে মনে করি। পাকিস্তানের আইনে কিছুই নেই বলা যায়। অথচ আমাদের এখানে নাম ধরে ধরে আইন করা হয়েছে। ফরমালিনে কী ক্ষতি এবং এর সাজা কী তার স্পষ্ট ব্যাখ্যা মেলে আমাদের আইনে। একই রকম শক্ত আইন মালয়েশিয়াতে। দেশটিতে আইনের প্রয়োগ আছে। আমাদের এখানে প্রয়োগ নেই। সমস্যা ঠিক এখানেই।
জাগো নিউজ : এ জন্য কোন বিষয়ে গুরুত্ব দেবেন?
আ ব ম ফারুক : আমাদের এখানে সমস্যা হচ্ছে আমলারাই সব করতে চান। গবেষণাও তারা করতে চান। আইনও তারা বানান। আবার প্রয়োগও তারা করতে চান। এ কারণেই লেজেগোবরে অবস্থা দাঁড়ায়।
টেকনিক্যাল বিষয়ে যিনি এক্সপার্ট তাকে রাষ্ট্র মূল্যায়ন করছে না। একজন আমলা পাট মন্ত্রণালয় থেকে চর উন্নয়ন প্রকল্পে যাচ্ছেন। সেখান থেকে ধর্ম মন্ত্রণালয়ে। আবার তাকে দেয়া হচ্ছে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষে। সকল কাজের কাজি ব্রিটিশদের তৈরি।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার পর যে নীতি রেখে গেছে, সেই নীতি আজও আছে। অথচ ব্রিটিশরা এর মধ্যে তিনবার নীতির সংস্কার করেছে। এ দেশে বিমানের এক্সপার্ট দিয়ে জনস্বাস্থ্য খাত চালানো হচ্ছে। আবার স্বাস্থ্যের লোক দিয়ে চালানো হচ্ছে বিমান। এভাবে একটি রাষ্ট্র চলতে পারে না। স্বাধীনতার পর ২৮ জন জনস্বাস্থ্য সচিব নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র দুজন ডাক্তার ছিলেন। তার মানে বাংলাদেশে জনস্বাস্থ্য খাতের আর কোনো বিশেষজ্ঞ নেই। এটি একটি রাষ্ট্রের করুণ দশা বলেই মনে করি।
পেশাদারিত্বের কদর করতে না পারলে টেকসই উন্নয়ন আসে না। এশিয়ার যে দেশগুলো গত কয়েক দশকে উন্নয়ন করেছে, তারা টেকনোক্র্যাটদের দিয়েই করেছে। জাপানের দিকে তাকালেই সব বোঝা যায়। আমলারা প্রশাসন চালাবে। কিন্তু সব জায়গায় খবরদারি চালাতে পারেন না। সঠিক ব্যক্তিকে সঠিক জায়গায় বসাতে পারলেই সমাধান আসবে। আমি গাড়ি চালাতে পারি বলেই বিমান চালানোর সাহস দেখাতে পারি না। এই বাধা দূর করা খুবই জরুরি। বিশেষায়িত জ্ঞানের প্রজেক্ট করেছে সরকার। দেখেন, সবকটিতে আমলাদের নিয়ে বসানো হয়েছে। অথচ এসব বিষয়ে আমাদের বিশেষজ্ঞের অভাব নেই।
আরও পড়ুন >> খাবারে বিষ থাকলে মানুষের আয়ু বাড়ত না
যানজটে আটকে গেছে রাজধানী। বুয়েটের পরিবহন বিশেষজ্ঞদের মতামত নেয়া হয় না। আমলারা যে সিদ্ধান্ত দেন তাই বাস্তবায়ন হয়। ফলে সঠিক সমাধান আসে না। যার যে কাজ তা করার সুযোগ তৈরি করে দেয়ার দায়িত্ব তো রাষ্ট্রের।
এএসএস/এমআরএম/এমএআর/এমএস