সংসদে পাত্তা পাচ্ছে না এমপিদের আনা আইন!
সংসদে তাদের মূল কাজ আইন প্রণয়ন করা। কিন্তু জাতীয় সংসদে সরাসরি উপস্থাপিত সংসদ সদস্যদের (এমপি) আইন বা বিলগুলো পাস হচ্ছে না। বর্তমান সংসদে তাদের আনা একটি আইনও পাস হয়নি। এমনকি সংসদ নির্বাচনে একাধিক আসন থেকে নির্বাচন সংক্রান্ত সংবিধান ও গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশের আলাদা আলাদা ধারা পরিবর্তনের জন্য আনা বিলও গুরুত্ব পাচ্ছে না।
অন্যদিকে আইন মন্ত্রণালয়ের খসড়া বিলের পর সংসদে উত্থাপিত আইনগুলো পাস হয়ে যাচ্ছে। এ জন্য আইন প্রণয়নে এমপিরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। গত চার অধিবেশনে কোনো বেসরকারি বিলই উত্থাপন হয়নি।
প্রসঙ্গত, সংসদের কার্যপ্রণালীবিধি অনুযায়ী, মন্ত্রী ছাড়াও অন্য এমপিরা বিল আনতে পারেন। এ জন্য ১৫ দিন আগে সংসদ সচিবের কাছে নোটিশ পাঠাতে হবে। সঙ্গে দিতে হবে বিলের তিনটি অনুলিপি। সংসদে উত্থাপনের পর তা অধিকতর পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য বেসরকারি সদস্যদের বিল এবং বেসরকারি সদস্যদের সিদ্ধান্ত প্রস্তাব সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়। কমিটি মনে করলে বিলটি পাসের সুপারিশ করে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত বছর এ কমিটি একটিও বৈঠক করেনি। তখন ওই কমিটির সভাপতি ছিলেন আওয়ামী লীগের সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু। বর্ষীয়ান সংসদ সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত মারা যাওয়ার পর আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সভাপতি হন তিনি। ওই কমিটির সভাপতি করা হয় জিল্লুল হাকিমকে (রাজবাড়ী-২)।
ওই সময়ের সভাপতি আবদুল মতিন খসরু জাগো নিউজকে বলেন, ‘সরকারি বিলগুলোও কিন্তু এমপিদের মাধ্যমেই পাস হয়। আইন মন্ত্রণালয় বিলগুলোর খসড়া করলেও সংসদে উত্থাপনের পর তা পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার করেন সংশ্লিষ্ট সংসদীয় কমিটির সদস্যরা। তবে বেসরকারি বিলগুলো বেশি করে পাস হওয়া উচিত। পাস হয় না বলেই কমিটি বৈঠকও করে না।’
স্বাধীনতার পর ২৭৩ বিল উত্থাপন, পাস মাত্র ৯টি
সূত্র জানায়, বর্তমান সংসদে এমপিরা সরাসরি ১৫টি বিল (১৯ মার্চ পর্যন্ত) আনলেও পাস হয়নি একটিও। শুধু চলতি সংসদ নয়, বিগত ৯টি সংসদের এমপিদের বিলগুলো পাসের নজির খুবই কম। দশটি সংসদে এখন পর্যন্ত ২৭৩টি বিল আসলেও পাস হয়েছে মাত্র ৯টি। প্রথম সংসদে এ ধরনের কোনো বিল পাওয়া যায়নি। তবে পঞ্চম জাতীয় সংসদে সবচেয়ে বেশি বিল আনা হয়েছিল। এ সংসদে ৭৪টি বিল আনা হলেও পাস হয় মাত্র একটি। বিগত নবম সংসদে সবচেয়ে বেশি বিল পাস হয়। ওই সংসদে ২১টি বিল আনা হলেও পাস হয় মাত্র তিনটি।
এছাড়া দ্বিতীয় জাতীয় সংসদে ৪৭টি বিলের মধ্যে পাস হয় মাত্র দুটি। তৃতীয় সংসদে পাঁচটি বিলের মধ্যে পাস হয় একটি। চতুর্থ জাতীয় সংসদে ছয়টি বিল আনা হয়, পাস হয়নি একটিও। ষষ্ঠ জাতীয় সংসদে বেসরকারি কোনো বিলই পাওয়া যায়নি। সপ্তম জাতীয় সংসদে ৫১টি বিল আনা হলেও পাস হয় মাত্র একটি। অষ্টম সংসদে ৫৪টি বিলের মধ্যে একটি পাস হয়। নবম সংসদে ২১টি বিলের মধ্যে পাস হয় তিনটি আর চলতি দশম সংসদে ১৫টি বিল আনা হয়। আলোর মুখ দেখেনি একটিও। তবে স্বতন্ত্র সদস্য মো. রুস্তম আলী ফরাজীর (পিরোজপুর-৩) আনা সংবিধান (সপ্তদশ সংশোধন) বিল, ২০১৭ এর আইডিয়া নিয়ে আরেকটি নতুন বিল আনে সরকার।
আর কত ঝুলে থাকবে আইনগুলো
গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ (আরপিও) অনুযায়ী, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এক প্রার্থী সর্বোচ্চ তিন আসন থেকে নির্বাচন করতে পারবেন। কিন্তু সংবিধান অনুযায়ী, এক ব্যক্তি দুই বা ততোধিক নির্বাচনী এলাকা থেকে প্রার্থী হতে পারবেন। অর্থাৎ একই ব্যক্তি একই সময়ে ১০০ বা ২০০ যে কয়টি আসন থেকে ইচ্ছা নির্বাচন করতে পারবেন। এই বৈপরীত্য দূর করার জন্য পিরোজপুর-৩ আসনের স্বতন্ত্র এমপি মো. রুস্তম আলী ফরাজী বিগত বছরের ফেব্রুয়ারিতে সংবিধান (সপ্তদশ সংশোধন) বিল, ২০১৭ (সংবিধানের ৭১ অনুচ্ছেদ সংশোধন) নামে একটি বিল আনেন। কিন্তু আজও তা পাস হয়নি। তবে গত মাসে বিলটি সংসদে উপস্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয় সংসদীয় কমিটি।
এমপিদের উত্থাপিত বিলগুলো পাস হওয়া উচিত কিনা- এ প্রশ্নের জবাবে রুস্তম আলী ফরাজী বলেন, ‘অনেক বিল আছে যা পাস করলে রাষ্ট্র অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। সেগুলো পাস করা যেতে পারে।’
সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী নিয়ে বৈপরীত্য সম্পর্কে তিনি বলেন, “সংবিধানে এত বড় একটি ব্যত্যয় থাকতে পারে না। এটা নিয়ে সংসদে আমি ছাড়া আর কেউ মুখ খোলে না। এটা সংবিধানে কোনোভাবেই থাকতে পারে না। এটা আইনের চরম ব্যত্যয়। পৃথিবীর কোনো দেশের সংবিধানে এ ধরনের ‘ভুল’ নাই। এটা একটি মারাত্মক ব্যত্যয়।”
‘সংবিধানের আদি প্রণেতারা এটা হয়তো তখন বুঝতে পারেননি। কিন্তু এখন এটা আমি সংশোধনের জন্য প্রস্তাব দিয়েছি। কিন্তু এটা পাস করলে তাদের (সরকার) কী অসুবিধা হয় তা বুঝি না!’
‘এমপিদের উপস্থাপিত বিলগুলো পাস করলে সংসদ অর্থবহ, প্রাণবন্ত ও ফলপ্রসূ হবে; এই পার্লামেন্টকে মানুষ মূল্যায়ন করবে’- যোগ করেন তিনি।
বেসরকারি বিল যারা এনেছেন
দশম জাতীয় সংসদ অধিবেশনে উত্থাপিত ১৫টি বিলের মধ্যে পাঁচটি এনেছেন মো. রুস্তম আলী ফরাজী (পিরোজপুর-৩)। তিনি জেলা জজ আদালত মৌলিক অধিকার বলবৎকরণ (এখতিয়ার) বিল, ২০১৫; সংবিধান (সপ্তদশ সংশোধন) বিল, ২০১৪ (সংবিধানের ৬৫ অনুচ্ছেদের সংশোধন); ন্যায়পাল (সংশোধন) বিল, ২০১৭; সংবিধান (সপ্তদশ সংশোধন) বিল, ২০১৭; (সংবিধানের ৭১ অনুচ্ছেদের সংশোধন) এবং নামাজ কায়েম বিল, ২০১৭ আনেন সংসদে।
এছাড়া মো. ইসরাফিল আলম (নওগাঁ-৬) ‘অসংগঠিত শ্রমিক কল্যাণ ও সামাজিক নিরাপত্তা (অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত) বিল; সাবের হোসেন চৌধুরী (ঢাকা-৯) ‘বাংলাদেশ পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত অঞ্চল প্রতিষ্ঠাকরণ বিল, ২০১৬’; এ কে এম ফজলুল হক (শেরপুর-৩) ‘বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তাসমূহের অধিকার বিল, ২০১৬’ এবং ফজলে হোসেন বাদশা (রাজশাহী-২) ‘বাংলাদেশ আদিবাসী অধিকার বিল, ২০১৬’ সংসদে আনেন।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও সংসদ বিষয়ক গবেষক নিজাম উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘এখন সংসদে বিল নিয়ে কথা হয় না। কথা হয় অন্যকে হেয় করার জন্য। আর সংসদে বেশির ভাগ সময় স্তুতি হয়। তাই সরকারি বিলগুলো খুব কম সময়ে পাস হয়। বেসরকারি বিলগুলো তো পাত্তাই পায় না।’
এইচএস/এমএআর/আরএস/জেআইএম