বাম্পার ফলনেও কৃষকের নাভিশ্বাস
কৃষক। যারা দেশের মানুষের খাদ্যের যোগান দেয়। যারা খাদ্য সঙ্কট নিরসনে মূল প্রদায়কের ভূমিকা পালন করে। ধানের চারা রোপনের পর থেকে যারা ধানের কুশিতে কুশিতে স্বপ্ন বোনে। রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে যারা ধান চাষ করে। সেই কৃষকের আশায় গুড়ে বালি পড়ে ধান যখন ঘরে আসে। কৃষক ধানের দাম পায় না- একথা প্রত্যেক মৌসুমেই লেখা হয়। রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিরা সবাই বিষয়টি সম্পর্কে অবগত থাকেন কিন্তু সমস্যা সমস্যাই রয়ে যায়। সমাধান আর হয় না।
বিশ্লেষকদের মতে, বাস্তবমুখী চিন্তা-ভাবনা না থাকার কারণে একাধারে ঠকছেন কৃষক ও ভোক্তা। কৃষক যেমন পান না তার পণ্যের ন্যায্য মূল্য, তেমনি ভোক্তারাও নিষ্পেষিত হন মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যে। এসব বিষয় নিয়ে কৃষক, মধ্যস্বত্বভোগী, নীতিনির্ধারক ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে ধানচাষির সুখ-দুঃখ নিয়ে তিন পর্বের একটি ধারাবাহিক রিপোর্ট তুলে ধরা হলো। আজ এর প্রথম পর্ব প্রকাশ করা হলো-
বগুড়া জেলার ধুনট থানার চরপাড়া গ্রামের কৃষক আকিমুদ্দিন শেখ, গত বছর ধানের ভালো দাম পাওয়ায় এবারও ১২ বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছেন। কিন্তু বাজারে ধানের বর্তমানে যে দাম তাতে ধান বিক্রি করে তার খরচ উঠছে না।
আকিমুদ্দিন শেখ বলেন, গত এপ্রিল মাসে যে ধানের দাম ১০০০ টাকা থেকে ১২০০ টাকা মণ ছিল, সেই ধান এখন প্রকার ভেদে ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা। এই দামে ধান বিক্রি করলে আমরা নিঃশেষ হয়ে যাব। ধানের উপযুক্ত দাম না পাওয়ায় দেশের সব কৃষকের নাভিশ্বাস উঠেছে।
এমন অবস্থা শুধু বগুড়ার কৃষক আকিমুদ্দিনের নয়, সারাদেশের কৃষকের একই অবস্থা। গত বছর ধানের দাম পাওয়ায় এবার কৃষক বেশি বিনিয়োগ করেছে এ খাতে। ফলনও হয়েছে বাম্পার। কেউ কেউ বলছেন, রেকর্ড পরিমাণ ধান উৎপাদন হয়েছে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট এর হিসেবে এই সিজনে এক কোটি ৯৭ লাখ মেট্রিকটন ধান উৎপাদন হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিষয়ক সংস্থা ইউএসডিএর সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্বের ফসলের উৎপাদন বিষয়ক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে- বাংলাদেশে এবার আগের বছরের তুলনায় রেকর্ড পরিমাণে ৬ দশমিক ৩ শতাংশ বেশি ধান উৎপাদিত হয়েছে। গত বছরের তুলনায় এক লাখ হেক্টর বেশি জমিতে এবার ধানের চাষ হয়েছে, যা বিশ্বের মোট চালের উৎপাদনকে রেকর্ড পরিমাণে বাড়িয়ে দেবে।
ধানের দাম প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জাগো নিউজকে বলেন, কৃষকের পণ্যের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সরকারের আরও বেশি দায়িত্ব নেয়া উচিত। এজন্য সরকারের দৃষ্টি রয়েছে। সার, বীজ ও বিদ্যুতে সহায়তা দেয়া হচ্ছে।
মন্ত্রী বলেন, ফসলের প্রাথমিক মূল্য ও ভোক্তা পর্যায়ের মূল্যের মধ্যবর্তী ব্যবধান অনেক বেশি। ব্যবসায়ীদের অনেকে অতি মুনাফা করছেন। এটা অনুচিত। কৃষক ও ব্যবসায়ী দুই পক্ষের জন্য উইন-উইন পরিস্থিতি তৈরিতে সরকারের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন বলেও মনে করেন তিনি।
তবে ধানের দাম নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ। ধানের দাম প্রসঙ্গে মোবাইল ফোনে প্রশ্ন করা হলে তিনি জাগো নিউজের এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমি ছাড়া দুনিয়ায় আর কেউ নেই? আপনারা সরাসরি সচিবকে নক করেন কেন? এ বিষয়ে আমি কিছু বলবো না’।
এর আগে সচিব মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ ধানের দাম এবং চাল আমদানির ব্যপারে অন্য এক পত্রিকার সাংবাদিককে বলেন, ‘বোরো ধান ওঠার এই সময়ে চাল আমদানির ওপর নিয়ন্ত্রণ আনলে ভালো হতো।’ তিনি বলেন, ‘চালের আমদানি শুল্ক নির্ধারণের ব্যাপারে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও খাদ্য মন্ত্রণালয় দায়িত্বপ্রাপ্ত। আমাদের কাছে এ ব্যাপারে মতামত চাইলে অবশ্যই আমরা তিন-চার মাসের জন্য আমদানি শুল্ক আরোপ করার পক্ষে মত দেব।’
শেরপুর জেলা সদরের আরেক কৃষক আরিফ বলেন, শেরপুরে ধানের দাম এখন চলছে ৬০০ থেকে ৬২০ টাকা মণ। শুকনো ধানের দাম প্রতি মণ ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা। এবার ধান কাটার সময় শ্রমিকের যে মজুরি দেয়া হয়েছে তা প্রায় এক মণ ধানের সমান। একে তো শ্রমিকের মজুরি বেশি, আবার সার-কীটনাশকেরও দাম বেশি, তার ওপর ধানের দাম কম। সব কিছুতেই কৃষকের লস। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে এবং সরকার ধানের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ না নিলে কৃষক চাষাবাদ ছেড়ে দেবে বলে অনেক কৃষক মন্তব্য করেছেন।
সিরাজগঞ্জের হাঁটে ধান কিনছেন আবু মিয়া। তিনি জাগো নিউজকে জানালেন, সিরাজগঞ্জসহ আশে পাশের হাঁটগুলোতে নতুন ধান ৬শ ৫০ থেকে ৭শ টাকায় কেনাবেচা হচ্ছে। চিকন ধান শুকনা ৮০০ থেকে ৯০০ টাকায় ক্রয় করছি। ধান থেকে চাল করে বিক্রি করি। ছোট ব্যবসায়ী হওয়ায় মিল মালিকদের সঙ্গে টিকতে পারি না। বেঁচে থাকার জন্য ব্যবসা করি। কখনও লাভ হয় আবার কখনও লোকসান যায় এভাবে কোনো রকম বেঁচে আছি।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. মির্জা এ বি আজিজুল ইসলাম এক প্রশ্নের জবাবে জাগো নিউজকে বলেন, কৃষক ধানের দাম না পাওয়াটা অত্যন্ত দুঃখজনক। যতদিন কৃষকের হাতে ধান থাকে ততোদিন ধানের দাম বাড়ে না। ধান মিল মালিক বা মধ্যস্বত্বভোগীদের হাতে চলে গেলেই ধানের দাম বাড়ে। তিনি বলেন, এ বিষযে সরকারের নজর দেয়া উচিৎ।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসেবে এ বছর ১ কোটি ৯০ লাখ টন ধান উৎপাদিত হবে। এরই মধ্যে ৭০ শতাংশ ধান কাটা হয়ে গেছে। উপকরণ খরচ বেড়ে যাওয়ায় এ বছর প্রতি কেজি ধানে ২ টাকা ও চালে ৫ টাকা বাড়তি খরচ হয়েছে কৃষকের। গত বছর ফসল মার খাওয়ার পর এ বছর তারা ধানের পেছনে বাড়তি বিনিয়োগ করেছেন। তারা আশায় ছিলেন ভালো ফলন ও দাম পাবেন। কিন্তু গোলার ধান হাটে বিক্রি করা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন প্রায় এক কোটি বোরো চাষি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ মহসিন এক প্রশ্নের জবাবে জাগো নিউজকে বলেন, সরকার আমাদের বলে ফলন বাড়াতে, আমরা ফলন বাড়াই। দেশের জনসংখ্যা বাড়ছে এ কারণে প্রতি বছর খাদ্য উৎপাদনও বাড়ছে। ধানের ফলন বাড়ানোর জন্যও আমাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সে হিসেবে আমরা ধানের ফলন বাড়াতে মাঠ পর্যায়ে কাজ করেছি। এখন ধানের মূল্যে কীভাবে দেবে এটা নির্ধারণ করবে সরকার। সরকারের নিশ্চয়ই একটা পলিসি আছে। এছাড়া কৃষি বিপণন অধিদফতর এ বিষয়ে ভালো বলতে পারবে।
উৎপাদন খরচের তুলনায় ধানের দাম কম একথা স্বীকার করে কৃষি বিপণন অধিদফতরের উপ-পরিচালক আব্দুর রশিদ জাগো নিউজকে বলেন, কৃষক ধান বিক্রি করে এখন উৎপাদন খরচেয়ের কিছু বেশি দাম পাচ্ছে। তবে ধানের আদ্রতা (ভেজা) কেটে গেলে এবং একটু পরে বিক্রি করলে কৃষক পুষিয়ে নিতে পারবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা ভালো না। চুরি-চামারি করে অতিরিক্ত চাল আমদানির কারণে অনেক চাতাল ব্যবসায়ী চাল বিক্রি করতে পারছে না। ফলে চাতাল মালিকদের ধান ক্রয়ও থমকে আছে। এ কারণে ধানের প্রকৃত দাম পাচ্ছে না কৃষক।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট এর মহাপরিচালক (চলতি দায়িত্ব) কৃষিবিদ ড. মো. শাহজাহান কবীর ধানের বর্তমান দাম প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে জাগো নিউজকে বলেন, বর্তমানে কৃষক যে দামে ধান বিক্রি করছে তাতে কৃষক লাভ পাচ্ছে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামীতে কৃষক অটোমেটিক ধান উৎপাদন বন্ধ করে দেবে। সরকার সরাসরি ধান না কেনার কারণে কৃষক ধানের দাম পাচ্ছে না। সরকার চাল কেনে। এই চাল সরবরাহ করে মিলাররা। এখানে মিলারদের কারসাজির কারণে কৃষক ধানের দাম পায় না।
এ ব্যাপারে দেশের চালকল মালিকদের কেন্দ্রীয় সংগঠন বাংলাদেশ অটো, মেজর ও হাসকিং চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এ কে এম লায়েক আলী জাগো নিউজকে বলেন, ধানের দাম কম বা বেশি এর জবাব আমরা নই। এর জবাব দেবে সরকার। সরকার কৃষককে কীভাবে সুবিধা দেবে সে সিদ্ধান্ত নেবে সরকার। আমরা কম দামে ধান কিনলে কম দামে চাল বিক্রি করি। আমরা ধান কিনে চাল করে বসে আছি কিন্তু চাল বিক্রি হচ্ছে না। অনেকের গুদামে চাল পড়ে আছে।
তিনি বলেন, অনেকের গুদামে বিপুল পরিমাণ আমদানি হওয়া চাল রয়ে গেছে। এগুলোর প্রভাবে মিল মালিকদের চাল বিক্রি কমে গেছে। তবে সরকারি গুদামে চাল সরবরাহের যে লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয়েছে, তা চালকল মালিকেরা পূরণ করবেন বলে তিনি মন্তব্য করেন।
এফএইচএস/এমবিআর/আরআইপি