ভিডিও EN
  1. Home/
  2. বিশেষ প্রতিবেদন

গর্ভবতী মায়েদের ভরসা আজিমপুর মাতৃসদন

মনিরুজ্জামান উজ্জ্বল | প্রকাশিত: ০৫:৪৮ পিএম, ১১ জুন ২০১৮

রাজধানীর আজিমপুরে মাতৃসদন ও শিশু স্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের ১৭৩ শয্যার বিশেষায়িত নারী ও শিশুবান্ধব হাসপাতালটি এখন সম্পূর্ণ দালালমুক্ত। এমন তথ্য শোনার পর অনেকেই ভ্রু কুঁচকে মন্তব্য করবেন, অসম্ভব, এ নিছক আষাঢ়ে গল্প ছাড়া আর কিছুই নয়।

কিন্তু বিভিন্ন কৌশলে হাসপাতাল যে দালালমুক্ত করা যায় তা বাস্তবে দেখিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির তত্ত্বাবধায়ক ডা. ইশরাত জাহান।

jagonews24

প্রতিষ্ঠানটি দালালমুক্ত করার গল্প তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘বছর খানেক আগেও হাসপাতালে দালালদের ব্যাপক উৎপাত ছিল। দলবেঁধে সারাক্ষণ প্রবেশ গেটের ভেতরে ও বাইরে অবস্থান করত। গর্ভবতী মহিলা, নবজাতক ও তাদের স্বজনদের কম খরচে প্যাথলজি পরীক্ষার নানা মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে যেত। তবে এখন সেসব অপতৎপরতা বন্ধ হয়েছে।

ডা. ইশরাত জাহান বলেন, সেবা নিতে আসা অধিকাংশ নারীই গর্ভধারণের পর নিয়মিত চেকআপের জন্য মাতৃসদনে আসেন। বিশেষ করে প্রসবের সময় ঘনিয়ে এলে রক্ত, আলট্রাসনোগ্রাফিসহ বিভিন্ন পরীক্ষা করাতে গাইনি চিকিৎসকের কাছে আসেন। এখানে শুধুমাত্র মহিলা চিকিৎসকরাই ডেলিভারি করান। এ কারণে রোগীরা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।

jagonews24

দালালচক্রের অপতৎপরতা বন্ধে তিনি হাসপাতালের নোটিশ বোর্ডে নোটিশ টানিয়ে দেন। নোটিশে উল্লেখ করা হয়, যে পরীক্ষা এ হাসপাতালে হয় সে পরীক্ষা বাইরের ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে করানো হলে তা গ্রহণ করা হবে না। নতুন করে টাকা জমা দিয়ে হাসপাতাল থেকে পুনরায় করতে হবে।

এ নোটিশের ফলে রোগীদের বাইরে থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানোর সংখ্যা কমতে শুরু করে। বাড়তে থাকে হাসপাতালের আয়।

উল্লেখ্য, এ মাতৃসদনে মাত্র ৫১০ টাকায় আলট্রাসনোগ্রাফি, ব্লাড গ্রুপ-ব্লাড সুগার, ভিডিআরএল, এইচভিএসএজি ও ইউআরই- এ পাঁচ ধরনের টেস্ট করা হয়।

তিনি জানান, দুই বছর আগে তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে যোগ দেয়ার বছরে প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষা বাবদ আয় ছিল মাত্র ৫০ লাখ টাকা। বিশেষ কৌশল অবলম্বনের ফলে এখন তা এক কোটি ২৩ লাখে উন্নীত হয়েছে।

jagonews24

হাসপাতালের প্রশাসনিক শাখা সূত্রে জানা গেছে, ১৭৩ শয্যার বিশেষায়িত এ হাসপাতালে ১১৬ গাইনি ও প্রসূতি এবং ৫৭টি শিশু বেড রয়েছে। মোট বেডের মধ্যে ১০৯টি নন –পেয়িং ও ৬৪টি পেয়িং বেড।

নন-পেয়িং বেডের মধ্যে ১২টি পোস্ট অপারেটিভ, ১৮টি লেবার ওয়ার্ড, ১৮টি গাইনি, ৩৯টি শিশু ওয়ার্ড ও ২২টি প্রসূতি বেড। অন্যদিকে মোট পেয়িং বেডের মধ্যে ১৮টি শিশু ওয়ার্ড, ছয়টি গাইনি, ২৪টি প্রসূতি ও ১৬টি কেবিন।

হাসপাতালের আউটডোর ও ইনডোরে টিকিট মূল্য পাঁচ টাকা ও ১০ টাকা। সাধারণ পেয়িং বেডের দৈনিক ভাড়া ১০০০ টাকা এবং কেবিন ২০০০ টাকা। আর নন পেয়িং সাধারণ বেড ১০০ ও কেবিন ২০০ টাকা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাসপাতালের আউটডোরে প্রতিদিন গড়ে ৬০০- ৭০০ রোগী আসে। ইনডোরে প্রতি মাসে গড়ে ৩০০-৩৫০ সন্তানসম্ভবা নারীর ডেলিভারি হয়।

হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. ইশরাত জাহান জানান, গত মে মাসে এ প্রতিষ্ঠানে চার হাজার ৩০৮ রোগী প্রসবপূর্ব পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং ৯২০ জন প্রসবপরবর্তী ফলোআপ চিকিৎসা নিয়েছেন। এ সময়ে ৩৩৪ শিশু ভূমিষ্ঠ হয়েছে। তাদের মধ্যে মাত্র ৬৮টি নরমাল ও ২৬৬টি অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে হয়েছে। এছাড়া আরটিআইটি সাতজন, সাধারণ রোগী এক হাজার ১৮৭ জন, শূন্য থেকে এক বছর বয়সী এক হাজার ১৮৮ জন, এক থেকে আট বছর বয়সী এক হাজার ২৭৫ জন এবং এক হাজার ৫৮৩ জন টিকা নিয়েছে।

২৯০ পুরুষ স্থায়ী বন্ধ্যাত্বকরণ এবং ১২ নারী লাইগেশন করিয়েছেন। এছাড়া জন্ম নিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন অস্থায়ী পদ্ধতি– ৫৭ জন ইমপ্ল্যান্ট, ৬৫ জন আইইউডি, ৪২ জন ইনজেকশন, ১৮৫ জন ওরাল পিল ও ১৯২ জন কনডম পদ্ধতি গ্রহণ করেছেন।

গত ৭ জুন সরেজমিন আজিমপুর মাতৃসদন ও শিশু স্বাস্থ্য প্রশিক্ষণের আউটডোর ঘুরে দেখা যায়, সেখানে প্রসবপূর্ব, প্রসবকালীন ও প্রসবপরবর্তী চেকআপের জন্য নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর কেন্দ্রটিতে আসা, জম্ম নিয়ন্ত্রণের স্থায়ী ও অস্থায়ী বিভিন্ন পদ্ধতি সম্পর্কে অবহিতকরণ, গ্রহণ ও জন্মনিয়ন্ত্রণের সামগ্রী বিতরণ, মা ও শিশুদের ভিটামিন ও আয়রন ট্যাবলেট বিতরণ ও টিকা দেয়া হচ্ছে। চিকিৎসক ছাড়াও পুষ্টিবিদ ও কাউন্সিলার মায়েদের সব বিষয়ে পরামর্শ দিচ্ছেন।

jagonews24

লালবাগের শহীদ নগরের বাসিন্দা গৃহবধূ শাহিদা জানান, তার জন্মও এই মাতৃসদনে হয়েছে। পাঁচ বছর আগে তার একটি ছেলে সন্তানের জন্মও এখানে হয়। এখন দ্বিতীয় বাচ্চা নেয়ার জন্য নিয়মিত চেকআপে আসছেন।

তিনি জানান, গর্ভকালীন সময়ে কী ধরনের পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে, কত সময় বিশ্রাম নিতে হবে, কী ওষুধ খেতে হবে- তা ডাক্তার, নিউট্রিশনিস্ট ও কাউন্সিলার বুঝিয়ে দেন। আগে দালালদের খুব উৎপাত থাকলেও এখন দালাল নেই বলে জানান শাহিদা।

সরেজমিন পরিদর্শনকালে এ প্রতিবেদকের চোখে দালালদের উৎপাত চোখে পড়েনি। তবে নিজস্ব অনুসন্ধানে জানা গেছে, পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের অধীন ১৭৩ শয্যার মা ও শিশুদের চিকিৎসার বিশেষায়িত এ হাসপাতাল প্রয়োজনীয় জনবল সংকটে ভুগছে।

১৭৩ শয্যায় উন্নীত হলেও এখনও ১০০ শয্যার জন্য বরাদ্দকৃত জনবল দিয়ে বছরের পর বছর চলছে। ১০০ শয্যার জন্য বরাদ্দকৃত জনবলের ২২১টির মধ্যে ৩২ পদই শূন্য।

১৯৫৩ সালে প্রতিষ্ঠিত বিশেষায়িত এ হাসপাতালে মা ও শিশুদের উন্নত মানের চিকিৎসাসেবা প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, অত্যাধুনিক ওটি, প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরি, রি-এজেন্ট ও ওষুধের পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকলেও শুধুমাত্র প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক, নার্স ও ওয়ার্ডবয়ের অভাবে আগের মতো কাঙ্ক্ষিত সেবা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, হাসপাতালের সকালের শিফটে আউটডোর ও ইনডোরে পর্যাপ্ত সংখ্যক চিকিৎসক থাকলেও বিকাল ও রাতের শিফটে দু-চারজন চিকিৎসক দায়িত্বে থাকেন। ওটি, পোস্ট অপারেটিভ ও ওয়ার্ড সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয় তাদের।

হাসপাতালের প্রশাসন শাখা সূত্রে জানা গেছে, সুদীর্ঘ ছয় দশকের পুরনো এ হাসপাতালে নিজস্ব নার্স নিয়োগ হয় না। স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে প্রেষণে আসা সীমিত সংখ্যক নার্সরা রোগীদের সামাল দেন। মা ও শিশুদের বিষয়ে দেশে-বিদেশে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে বিশেষজ্ঞ হওয়ার পর হুট করে তাদের বদলি করা হয়।

হাসপাতালে একটি অত্যাধুনিক প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরি ও ব্লাড ব্যাংক থাকলেও জনবলের অভাবে দুপুরের পর তা বন্ধ হয়ে যায়। ১৮ বছরের পুরনো একটি অ্যাম্বুলেন্স থাকলেও প্রায়ই সেটা বিকল থাকে। ফলে মুমূর্ষু রোগীকে যখন-তখন রেফার্ড করা যায় না।

মুমূর্ষু মা ও শিশুদের চিকিৎসার জন্য এ মাতৃসদনে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ) নেই। ফলে প্রসবকালীন ও প্রসবপরবর্তী সময়ে গর্ভবতী মা ও শিশুর শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে, আইসিইউ সাপোর্ট প্রয়োজন হলে রোগীকে দ্রুত অন্য হাসপাতালে রেফার্ড করতে হয়।

jagonews24

জানা গেছে, আজিমপুর মাতৃসদন ও শিশু স্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে মা ও শিশুদের চিকিৎসা ছাড়াও প্রশিক্ষণ ও গবেষণামূলক নানা কাজ হয়ে থাকে। প্রতিষ্ঠানটিতে ধাত্রী, গাইনি ও শিশু চিকিৎসক, নার্সিং ইন্সট্রাক্টর, সাব অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার (এসএসিএমও), কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি), সিনিয়র স্টাফ নার্স, নার্স, পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা (এফডব্লিউভি) ও ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ার অ্যাসিস্ট্যান্টদের (এফডব্লিউএ) নিরাপদ প্রসব, জরুরি নবজাতক সেবা, নবজাতক ও বাড়ন্ত শিশুর খাদ্য, বুকের দুধ পান ও দুগ্ধদানে পরামর্শদান, স্থায়ী ও অস্থায়ী পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি, প্রসবপূর্ব ও পরবর্তী পরামর্শ, মাতৃ ও শিশু মৃত্যু হ্রাস, কগনেটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি (সিবিটি), কমিউনিটি স্কিল বার্থ অ্যাটেনডেন্ট (সিএসবিএ), জরুরি প্রসূতি সেবা (ইওসি), অ্যান্টি নেটাল কেয়ার (এএনসি) ও পোস্ট নেটাল কেয়ার (পিএনসি), আইওয়াইসিএফ, ক্লিনিক্যাল কন্ট্রাসেপশন,এইচআইভি/এইডস, আরটিআই/এসটিআই, সিএমই ও আইইউসিডি এবং অস্ত্রোপচারবিষয়ক গবেষণার ওপর ট্রেনিং অব ট্রেইনি (টিওটি) প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। প্রতিষ্ঠানে দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন গবেষণাও পরিচালিত হয়।

হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. ইশরাত জাহান অপকটে প্রয়োজনীয় জনবলসহ নানা সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকার করে বলেন, সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ২৪ ঘণ্টা চিকিৎসা সেবা দেয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের পরিচালক (মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য) ডা. মোহাম্মদ শরীফ জানান, পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের অধীনে রাজধানীর আজিমপুর ও মোহাম্মদপুরে দুটি বিশেষায়িত হাসপাতাল রয়েছে। হাসপাতাল দুটি সুনামের সঙ্গে পরিচালিত হচ্ছে।

তিনি আরও জানান, আগামী মাসে দুটি বিশেষায়িত হাসপাতালে ১২ শয্যার নিওনেটাল আইসিইউ চালু হবে। ফলে মুমূর্ষু নবজাতকদের বাইরের হাসপাতালে আইসিইউর জন্য দৌড়ঝাঁপ করতে হবে না।

এমইউ/এএইচ/এমএআর/আরআইপি

আরও পড়ুন