‘মরলে এখানেই মরব, বাঁচলেও এখানেই’
বৃষ্টি শুরু হলেই আঁতকে উঠছেন রাঙ্গামাটির পাহাড়িরা। বৃষ্টির কারণে রাঙ্গামাটি ও চট্টগ্রামের বেশ কয়েকটি স্থানে পাহাড় ধসের ঘটনায় তাদের উৎকণ্ঠা আরও বেড়েছে। তবে পাহাড় ধসের আতঙ্ক থাকলেও এলাকা ছাড়তে রাজি নন তারা। রাঙ্গামাটির ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা ঘুরে এ তথ্য জানা গেছে।
জানা গেছে, সোমবার (১১ জুন) সকাল ৯টা থেকে আগের ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রাম ও আশপাশের এলাকায় ২৩৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করে পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিস। তারা বলছে চলতি বছরের এটিই সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত। তবে শনিবার বিকেলে আবহাওয়া অধিদফতরের ভারী বর্ষণের পাশাপাশি পাহাড় ধসের আশঙ্কার কথা জানায় আবহাওয়া অফিস।
এ বৃষ্টির কারণে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার মগাছড়ি, রাঙ্গামাটির চম্পকনগর, শিমুলতলি, ভেদভেদি ও কলেজ গেট এলাকায় পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছে। ঘাগড়ার শালবন এলাকায় বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙে পড়লে কিছু সময়ের জন্য রাঙ্গামাটি-চট্টগ্রাম সড়ক যোগাযোগ বন্ধ থাকে।
এদিকে রোববার বৃষ্টির পর রাঙ্গুনিয়া ও রাঙ্গামাটির বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, রাঙ্গামাটি বেতার স্টেশনের পাশে নতুনপাড়া এলাকায় (গতবার যেখানে পাহাড় ধসে পড়েছিল) নতুন করে টিন ও বেড়া দিয়ে ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। পাহাড়ের উপরেই জেলা প্রশাসন থেকে ঝুলানো হয়েছে ‘পাহাড়ধসের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। বসবাস করা নিষেধ’ সাইনবোর্ড। সাইনবোর্ডের লাগোয়া গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি কাঁচা ও আধাপাকা ঘর। যদিও গত বছরের ১৩ জুন পাহাড় ধসে এ এলাকায় নিহত হয়েছিল অন্তত ৫০ জন।
পাহাড়ের বাসিন্দা গৃহবধূ ঝিনুক। মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়েও থাকছেন পাহাড়ে। তিনি বলেন, ‘মরলে এখানেই মরব, বাঁচলে এখানেই বাঁচবো। তবুও পাহাড় ছেড়ে যাব না।’
রাঙ্গামাটি শহরের উপকণ্ঠে দুর্গম পাহাড়ি এলাকা উলুপাড়া। গত বছরের ১৩ জুন পাহাড় ধসে এখানে দুই কলেজ শিক্ষার্থীর মারা যায়। রোববার দুপুরে বৃষ্টি ভেজা পিচ্ছিল পাহাড়ি পথ মাড়িয়ে উলুপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়- ওই গ্রামের সবার চোখেই এক অজানা আতঙ্ক। অনেকে বাড়িঘর ছেড়ে গেছেন। আবার অনেকে একত্রিত হয়েছেন ‘টং’য়ে।
রাঙ্গামনি নামে এক যুবক জানান, বৃষ্টি শুরু হলেই সবায় আতঙ্কে থাকি। তবে শহর দূরে হওয়ায় তাদের যাওয়ার কোনো জায়গা নেই।
এত ঝুঁকি নিয়ে কেন পাহাড়ে থাকছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে উলুপাড়ার বাসিন্দা যুদ্ধবধি চাকমা বলেন, কোথায় যাব? বাপ-দাদারা এ পাহাড়েই বসবাস করে এসেছেন। আমরাও আছি। মরণ এল এখানেই মরতে হবে। যাওয়ার কোনো জায়গা নেই।
সরকারে পক্ষ থেকে কি কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি? এমন প্রশ্নের জবাবে যুদ্ধবধি চাকমা জাগো নিউজকে বলেন, ‘সরকার তো কত কিছুই করবে বলেছিল। কিন্তু সাইনবোর্ড লাগানো ছাড়া তো কোনো কাজ চোখে পড়ে না। তবে অনেকে এসেছিল, পাহাড়ের বাড়ি ছেড়ে যেতে বলেছিল। কিন্তু কোথায় যাব? তারা শুধু পাহাড় ছাড়তে বলে, যাব কোথায় তাতো বলে না।
‘গতবছর পাহাড় ধসের পর সরকার এবং বিভিন্ন সংস্থা নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। প্রায় তিন মাস আশ্রয়কেন্দ্রে থাকার পর একবস্তা চাল আর এক হাজার টাকা ছাড়া কিছুই মেলেনি। এখানে আমাদের আত্মীয়-স্বজন মারা গেছে, ঘর ভেঙেছে। কিন্তু লাভ হয়েছে তথাকথিত নেতাদের। আমরা যারা পাহাড়ের আছি তারা কিছুই পাইনি। যত ত্রাণ এসেছে তা শহরের রাস্তাতেই শেষ হয়ে যেত।’
ভেদভেদি আনসার ক্যাম্পের কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন বলেন, গত বছর যেখানে পাহাড় ধস হয়েছিল সেখানেই আবারও বসবাস শুরু করেছে নিহতদের স্বজনরা। তারাও জানে ওখানে থাকা ঠিক হচ্ছে না। কিন্তু গরিব মানুষগুলোর যাওয়ার জায়গা নেই, তাই নিশ্চিত মৃত্যুকে ভাগ্য হিসেবে মেনে নিয়েছেন তারা।
এদিকে জেলা জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, রাঙামাটি পৌরসভাসহ ১০ উপজেলায় মোট তিন হাজার ৩৭৮টি পরিবারের ১৫ হাজারেরও বেশি মানুষ পাহাড় ধসের ঝুঁকিতে রয়েছে। এর মধ্যে রাঙামাটি পৌর সদরের ৯টি ওয়ার্ডে ৩৪টি স্থানে ৬০৯ পরিবারের প্রায় আড়াই হাজার লোক ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে।
রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মামুনুর রশিদ জাগো নিউজকে বলেন, আরও যেন পাহাড় ধসে প্রাণহানি না ঘটে সেজন্য ‘সর্বোচ্চ প্রস্তুতি’নেয়া হয়েছে। আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। তবে গত বছরের ঘটনার পরও অনেকেই পাহাড়ে বসবাস করছে। তবে নতুন করে কেউ ঝুঁকি নিয়ে যাতে বসতি করতে না পারে সেদিকে নজর রাখা হচ্ছে।
আবু আযাদ/এএইচ/এমএস