ভিডিও EN
  1. Home/
  2. বিশেষ প্রতিবেদন

বিদেশ সফরে এগিয়ে প্রেষণে আসা কর্মকর্তারা

সিরাজুজ্জামান | প্রকাশিত: ০৯:২১ এএম, ২২ মে ২০১৮

জাতীয় সংসদ একটি স্বতন্ত্র ও সার্বভৌম প্রতিষ্ঠান হলেও এখানকার নিজস্ব কর্মকর্তারা সুযোগ-সুবিধা থেকে বেশি বঞ্চিত হন- দীর্ঘদিন ধরে রয়েছে এমন অভিযোগ। সে অভিযোগের প্রমাণ মিলেছে সংসদ সদস্যদের (এমপি) বিদেশ সফরের তথ্য থেকে। 

সংসদে প্রেষণে আসা কর্মকর্তা ও আত্মীকৃতরা বেশির ভাগ সময় বিদেশ সফরে গেছেন। কিন্তু নিজস্ব কর্মকর্তারা সেভাবে সুযোগ পাননি। এজন্য ক্ষোভে ফুঁসছেন তারা। 

সংসদ থেকে পাওয়া তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বাইরের এসব কর্মকর্তারা বিদেশ সফর করলেও তারা এখন আর সংসদে নেই। ফলে তাদের ‘অর্জিত জ্ঞান’ সংসদের কোনো কাজে আসেনি। 

জাতীয় সংসদের ইন্টার পার্লামেন্টারি অ্যাফেয়ার্স (আইপিএ) অধিশাখা ১ ও ২, হিসাব এবং সেবা শাখা থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে জাগো নিউজের পক্ষ থেকে তিন মাস অনুসন্ধান চালানো হয়। আজ থাকছে এর শেষ পর্ব।

নবম জাতীয় সংসদ গঠনের পর ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে সংসদ সদস্যদের বিদেশ ভ্রমণ শুরু হয়। ২০১১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ওই তিন বছরে মোট ১১৩টি প্রতিনিধি দল ছাড়াও শুধুমাত্র সংসদের কর্মকর্তারা একবার বিদেশ সফর করেন।

সব মিলিয়ে ওই তিন বছরে সংসদ থেকে মোট ১১৪টি প্রতিনিধি দল বিদেশ সফরে যান। ওইসব দলের নয়টিতে সংসদের কর্মকর্তাদের ঠাঁই হয়।  

জাগো নিউজের হাতে আসা তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ওই সময়ে সংসদ থেকে ২৫ জন কর্মকর্তা বিদেশ সফর করেন। তাদের মধ্যে ২২ জনই প্রেষণে আসা। পরবর্তীতে তারা সংসদ ত্যাগ করেন। এর মধ্যে আত্মীকৃত কর্মকর্তা ছিলেন দুজন। সংসদের নিজস্ব কর্মকর্তা ছিলেন মাত্র একজন। সৌভাগ্যবান ওই কর্মকর্তা হলেন উপ-সচিব মো. আবু আল হেলাল। তিনি ২০০৯ সালের এপ্রিলে ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবায় যাওয়ার সুযোগ পান।  

প্রেষণে আসা ২২ কর্মকর্তার মধ্যে মাত্র দুজন এখনও সংসদে আছেন। বাকি সবাই বদলি হয়ে অন্যত্র চলে গেছেন।  

সংসদের নিজস্ব কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করে ক্ষোভের সঙ্গে জাগো নিউজকে জানান, সংসদ একটি সার্বভৌম প্রতিষ্ঠান। এটি পরিচালনার জন্য আলাদা আইন আছে। নিজস্ব জনবল আছে। তবুও এখানে প্রেষণে আসাদের দাপট বেশি। বিদেশ ভ্রমণের চিত্র দেখলেই তা বোঝা যায়। এ কারণে সবার মধ্যে কম-বেশি ক্ষোভ রয়েছে। 

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সংসদ নিয়ে গবেষণা করা প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, ‘যদি কোনো মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে তারা বিদেশ যান তাহলে ওই মন্ত্রীর সঙ্গে কর্মকর্তারা যেতে পারেন। তবে যদি সংসদ সংক্রান্ত হয় তাহলে সংসদের আসল কর্মকর্তাদের সুযোগ দেয়া উচিত। তারা প্রাধান্য পাবেন- এটাই স্বাভাবিক। যে প্রতিনিধি দলগুলো নির্বাচিত হয় তাদের কে, কীভাবে নির্বাচিত  হন- সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ও মাপকাঠি থাকা উচিত। এ ব্যাপারে স্পিকার কর্তৃক তথ্য প্রকাশের ব্যবস্থা করাও বাঞ্চনীয়।’

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ওই সময়ে সবচেয়ে বেশি বিদেশ সফর করেছেন সংসদের সাবেক সচিব আশফাক হামিদ। তিনি চারবার বিদেশ ভ্রমণ করেন। তার ভ্রমণ করা দেশগুলো হলো- কোরিয়া, থাইল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড ও পানামা সিটি। 

২০০৯ সালের এপ্রিলে ইথিওপিয়ার আদ্দিস আবাবায় অনুষ্ঠিত ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের (আইপিইউ) সম্মেলনে সংসদের তিনজন কর্মকর্তা অংশ নেন। পাঁচ দিনব্যাপী চলা ওই সম্মেলনে বাংলাদেশ থেকে ১৫ জন অংশ নেন। প্রতিনিধিদলের প্রধান ছিলেন সাবেক ডেপুটি স্পিকার শওকত আলী। তার নেতৃত্বে সম্মেলনে যোগ দেয়া সংসদের কর্মকর্তারা হলেন- অতিরিক্ত সচিব প্রণব চক্রবর্তী, উপ-সচিব মো. আবু আল হেলাল ও সাবেক ডেপুটি স্পিকারের একান্ত সচিব তারিক মাহমুদ। 

২০০৯ সালের ২৫ থেকে ২৯ মে পর্যন্ত জার্মান পার্লামেন্ট ওয়ার্কিং ভিজিটে সংসদ থেকে দুজন কর্মকর্তা সেখানে যান। তারা হলেন- তৎকালীন সার্জেন্ট-অ্যাট-আর্মস কাজী এমদাদুল হক, সাবেক হুইপ আ স ম ফিরোজের একান্ত সচিব রেজাউল হক। সশস্ত্র বাহিনী থেকে আসা কাজী এমদাদুল হক এখন আর সংসদে নেই। নেই অন্যজনও। 

২০০৯ সালের ৭ থেকে ১১ জুলাই পর্যন্ত কোরিয়ার সিউলে অনুষ্ঠিত সেক্রেটারি জেনারেল ফোরাম অব এশিয়া প্যাসিফিক পার্লামেন্টস-এ শুধুমাত্র সংসদের দুজন সদস্য অংশ নেন। এটি মূলত ছিল সংসদের কর্মকর্তাদের জন্য। কিন্তু সেখানে অংশ নেন সংসদের সাবেক সচিব আশফাক হামিদ ও সচিবের একান্ত সচিব মো. শফিকুল ইসলাম। ওই দুজনই ছিলেন সংসদের বাইরের। তারা এখন সংসদে নেই। ফলে তাদের অর্জিত জ্ঞান সংসদের কোনো কাজে আসেনি বলে সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ। 

২০০৯ সালের ২ থেকে ৬ অক্টোবর পর্যন্ত তানজানিয়ার আরুশায় কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশনের (সিপিএ) ৫৫তম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগেরে সিনিয়র এমপি শেখ ফজলুল করিম সেলিমের নেতৃত্বে সেখানে বাংলাদেশ থেকে পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধিদল অংশ নেন । এর মধ্যে একজন ছিলেন সংসদের কর্মকর্তা। যুগ্ম-সচিব (সিএস) সৈয়দ আহমদ এখন আর সংসদে নেই। 

২০০৯ সালের ১৯ থেকে ২১ অক্টোবর সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় অনুষ্ঠিত আইপিইউ’র ১২১তম সম্মেলনে বাংলাদেশ থেকে ১২ সদস্যের প্রতিনিধিদল অংশ নেন। এর মধ্যে তিনজন ছিলেন সংসদ কর্মকর্তা। তারা হলেন- অতিরিক্ত সচিব ভীম চরণ রায়, উপ-সচিব আমির হোসেন ও প্রধান হুইপের একান্ত সচিব অমলেন্দু সিংহ। তাদের মধ্যে প্রথম দুজন এখন আর সংসদে নেই।  

২০০৯ সালের ৭ থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ইন্দোনেশিয়ার বান্দু-এ অনুষ্ঠিত ফোরথ জেনারেল অ্যাসেম্বলি অব দ্য এশিয়ান পার্লামেন্টারি অ্যাসেম্বলিতে সাত সদস্যের প্রতিনিধিদল অংশ নেন। তাদের মধ্যে দুজন ছিলেন সংসদ কর্মকর্তা। তারা হলেন- উপ-সচিব মো. আবুল হোসেন ও সিনিয়র সহকারী সচিব মো. মুনিম হাসান। দুজনই প্রেষণে সংসদে যুক্ত হন।  

২০১০ সালের ৪ থেকে ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত ভারতের নয়াদিল্লীতে অনুষ্ঠিত স্পিকারদের সম্মেলনে তৎকালীন স্পিকার ও বর্তমানে রাষ্ট্রপতি অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদের নেতৃত্বে চার সদস্যের প্রতিনিধিদল অংশ নেন। সেখানে সংসদ কর্মকর্তাদের মধ্যে ছিলেন- যুগ্ম সচিব সম্পদ বড়ুয়া, সাবেক পরিচালক (গণ-সংযোগ) জয়নাল আবেদীন, স্পিকারের সহকারী একান্ত সচিব-২ চৌধুরী কামরুল হাসান। পদাধিকার বলে অংশ নেয়া ওই তিনজনের কেউই এখন সংসদে নেই। 

২০১০ সালের মার্চে থাইল্যান্ডের ব্যাংককে অনুষ্ঠিত আইপিইউ’র ১২২তম সম্মেলনে সংসদ থেকে ১৭ সদস্যের প্রতিনিধিদলের এক বিশাল বহর অংশ নেয়। সংসদের সাবেক ডেপুটি স্পিকার শওকত আলীর নেতৃত্বে ওই প্রতিনিধিদলে সংসদের কর্মকর্তারা হিসেবে অংশ নেন সচিব আশফাক হামিদ, যুগ্ম সচিব এ কে মোহাম্মদ হোসেন, সিনিয়র সহকারী সচিব মহাসীন আলী ও প্রটোকল অফিসার এ এস এম আতাউল করিম। ওই চারজনের প্রথম তিনজন এখন আর সংসদে নেই। 
২০১০ সালের ৪ থেকে ৬ অক্টোবর সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় অনুষ্ঠিত আইপিইউ’র ১২৩তম সম্মেলনে সংসদ উপনেতা সাজেদা চৌধুরীর নেতৃত্বে ১৪ সদস্যের প্রতিনিধিদল অংশ নেন। সেখানেও ছিলেন সাবেক সচিব আশফাক হামিদ। এছাড়া উপ-সচিব বেগম রাশিদা সিদ্দিকা, উপনেতার একান্ত সচিব মো. মোস্তফা কামাল ও সহকারী সচিব এ কে এম আব্দুর রহিম ভূঞা ওই দলে ছিলেন। শেষের জন ছাড়া সংসদে এখন আর কেউ কর্মরত নেই বলে জানা গেছে। 

২০১১ সালের ১৫ থেকে ২০ এপ্রিল পানামা সিটিতে অনুষ্ঠিত আইপিইউ’র ১২৪তম সম্মেলনেও সাবেক সচিব আশফাক হামিদ, সিনিয়র সহকারী সচিব ওয়াহিদুল ইসলাম, সিনিয়র সহকারী সচিব ড. মো. মজিবুর রহমান ও ডেপুটি স্পিকারের একান্ত সচিব এ বি এম আতাউ রহমান অংশ নেন। তাদের একজনও এখন আর সংসদে নেই।  

সংসদে প্রেষণে আসা কর্মকর্তাদের বিদেশে পাঠানোর প্রবণতা ভালোভাবে নিচ্ছেন না বাংলাদেশের নির্বাচন, সংসদ, জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান সুশানের জন্য নাগরিক-সুজন। প্রতিষ্ঠানটির সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাইরের কর্মকর্তাদের বিদেশে ঘুরানো; এতে তো সংসদের সক্ষমতা বাড়ছে না। এগুলো হলো অর্থের অপচয়। ব্যক্তিস্বার্থে এগুলো করা হয়।’

‘আমাদের সংসদ যে জবাবদিহিতা-স্বচ্ছতার ভিত্তিতে কাজ করছে না- এসব কর্মকাণ্ডই তার প্রতিফলন।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘সংসদের নিজস্ব কর্মকর্তারা বিদেশে গেলে সংসদই উপকৃত হবে। তাই এখন সবাইকে সমান সুযোগ দেয়া হয়। এ বিষয়ে বিন্দু পরিমাণ ছাড় দেয়া হচ্ছে না।’ 

এইচএস/এমএআর/পিআর

আরও পড়ুন