গণআন্দোলনে সব স্বৈরশাসকের পতন হয় না
রুহুল কবির রিজভী; সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। দলটির দফতর সম্পাদকেরও দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। চলমান রাজনীতির বিভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র। আলোচনায় গুরুত্ব পায় দলটির চেয়ারপারসন কারাবন্দি বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশে ফেরা, নির্বাচনসহ বিভিন্ন প্রসঙ্গ।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাগো নিউজ’র জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সায়েম সাবু। দুই পর্বের প্রথমটি থাকছে আজ।
জাগো নিউজ : ‘সরকারের কৌশলের কাছে খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলন ব্যর্থ’ বলে মন্তব্য করেছেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। আপনিও কি তা-ই মনে করেন?
রুহুল কবির রিজভী : আন্দোলনে ব্যর্থ হয়েছি, তা কখনও মনে করি না। সরকারের ফ্যাসিবাদী নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার হয়ে আমাদের হাজার হাজার নেতাকর্মী জেলে। এমন একটি ফ্যাসিবাদী সরকারের আমলে আন্দোলনের গতিবেগ সবসময় একই রকম থাকে না। গতিবেগের পথ পরিবর্তন হয়। আমাদের আন্দোলন চলছে। নির্দিষ্ট একটি নতুন ধারার মধ্য দিয়ে আন্দোলন প্রবাহিত হয়। ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন কখনও ব্যর্থ হয় না। বিজয়ের মধ্য দিয়েই আন্দোলনের পূর্ণতা আসে।
জাগো নিউজ : আন্দোলনের গতিপথ পরিবর্তনের কথা বলছেন। ২০১৪ সালের নির্বাচন ঘিরে যে আন্দোলন, তা থেকে শিক্ষা নিয়েই কি এমন উপলব্ধি?
রুহুল কবির রিজভী : শিক্ষার ব্যাপার নয়। আন্দোলন নির্ভর করে সরকারের নীতির ওপর। সরকারের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যের ওপর আন্দোলনের রূপরেখা অনেকাংশে নির্ভর করে। গণবিরোধী সরকারেরও নানা ধরনের বৈশিষ্ট্য থাকে। কেউ হয়ত স্বৈরাচার, কেউ হয়ত গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে জোর করে ক্ষমতায় থাকতে চায়। বর্তমান সরকার ভিন্নমতকে পদদলিত করে আজীবন ক্ষমতায় থাকতে চায়।
নাৎসিবাদ, ফ্যাসিবাদের মতো একটি স্বৈরনীতি আমরা দেখতে পাচ্ছি। এটি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জন্য নতুন অধ্যায় তৈরি করেছে। শেখ হাসিনার নীতি নাৎসিবাদকেও ছাড়িয়ে গেছে। এমন একটি সরকারের বিরুদ্ধে সবসময় গণতান্ত্রিক ধারায় আন্দোলন করে সফলতা আসবে- তা মনে করার কোনো কারণ নেই। সভা, সমাবেশ বা মিছিল করলেই আন্দোলন একই ধারায় চলে না। আর সরকার তো এসবও করতে দিচ্ছে না। সংবিধানে মানুষের যে অধিকার সংরক্ষণ করা আছে, তা প্রতিনিয়ত হরণ করছে সরকার। আমরা এখন ঘরোয়া আলোচনাও করতে পারছি না।
জাগো নিউজ : আন্দোলন করে ক্ষমতায় এসেছে আওয়ামী লীগ। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিএনপিও ক্ষমতায় এসেছিল। এদেশে রাজনীতি আর আন্দোলন পরিপূরক। এখন কেন আন্দোলনের ভিন্ন পথ খুঁজছেন?
রুহুল কবির রিজভী : দেখুন, ২০০১ সালে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে আমাদের এত বেগ পেতে হয়নি। তখন হাসিনা সরকার এত স্বৈরাচারী ছিল না।
স্বৈরশাসক হিটলারকে সরাতে জনগণ বা রাজনৈতিক শক্তি পারেনি। মুসোলিনিকেও রাজনৈতিক শক্তি দিয়ে সরানো যায়নি। এমনকি গাদ্দাফি বা সাদ্দামের মতো শাসককেও জনগণ সরাতে পারেনি। বিদেশি সৈন্য লেগেছে। সব স্বৈরশাসকের-ই গণআন্দোলনে পতন হয় না। এমন একটি জনবিরোধী শাসককে সরাতে নানা শক্তির সন্নিবেশ ঘটনোর দরকার পড়ে।
জাগো নিউজ : তাহলে জনগণের বাইরে অন্য কোনো শক্তির প্রত্যাশা করছেন?
রুহুল কবির রিজভী : অন্য কোনো শক্তির প্রত্যাশা করছি না। অন্য শক্তির প্রয়োজন হবে বলেও মনে করছি না। আন্দোলনে জনগণের ব্যাপক উপস্থিতি আমরা দাঁড় করাতে পারব।
জাগো নিউজ : গত ১০ বছরে জনগণের মধ্যে আন্দোলনের ব্যাপকতা সৃষ্টি করতে পারেননি। এখন ভরসা পাচ্ছেন কোথায়?
রুহুল কবির রিজভী : আমরা আন্দোলনে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে সক্ষম হয়েছি। সরকারের নীতি তো হিটলারের চেয়ে ভয়ঙ্কর। এমন পরিস্থিতিতে তো গণআন্দোলনও কাজে আসবে না। গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে আইয়ুব খান বা এরশাদের পতন হয়। শেখ হাসিনার চরিত্র তো নিষ্ঠুর ধরনের। এ ধরনের সরকার সরাতে বিদেশি সৈন্য লেগেছে নতুবা অভ্যন্তরীণ কোনো শক্তির দরকার হয়েছে।
জাগো নিউজ : এ নিষ্ঠুরতার পরিণতি কী হতে পারে বলে মনে করেন?
রুহুল কবির রিজভী : এ ধরনের সরকারের পতন কখনও-ই স্বাভাবিক হয় না। পৃথিবীর ইতিহাসে বহু দৃষ্টান্ত আছে। এদের পতন হয় খুবই বেদনাদায়ক।
জাগো নিউজ : গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করছেন। বিএনপির মধ্যকার গণতান্ত্রিক চর্চা নিয়ে বিতর্ক আছে। নেতাকর্মীর মধ্যে আস্থার সংকট আছে। আপনার কাছে এর ব্যাখ্যা কী?
রুহুল কবির রিজভী : দেশে দেশে গণতন্ত্রের নানা রূপ আছে। আপনি কী বলতে চাইছেন, তা বুঝতে পারছি। ভারতও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। সে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে পরিবারের ধারাবাহিকতা নেই? তারা কি ফ্যাসিজম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে?’
বিএনপি বহুদলীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতেই বিএনপির সৃষ্টি। বিএনপি ফ্যাসিবাদে কোনোদিন বিশ্বাস করে না। অন্যের মতকে প্রতিষ্ঠা দিতেই আমাদের সংগ্রাম।
জাগো নিউজ : কিন্তু পরিবারতন্ত্রের বেড়াজালে তো আটকা। ঠিক আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের প্রশ্নেও তাই…
রুহুল কবির রিজভী : পরিবারতন্ত্র আর ফ্যাসিবাদ এক বিষয় নয়। ফ্যাসিবাদ জেনেটিক্যালিও হতে পারে। বাবা বাকশাল করেছিলেন, মেয়েকেও করতে হবে। এদেশ তাদের জমিদারি বলেই মনে করে। এখানে অন্য কোনো মত থাকবে না। বিএনপি এ নীতি কখনও-ই ধারণ করে না।
জাগো নিউজ : নেতৃত্বের প্রশ্নে পরিবারতন্ত্রই গুরুত্ব পেয়েছে...
রুহুল কবির রিজভী : আস্থা ও ঐক্যের প্রশ্নে জিয়াউর রহমান, বেগম খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমান দলের নেতাকর্মীদের কাছে অনন্য। তাদের প্রতি মানুষের অফুরন্ত আস্থা। মানুষের এ বিশ্বাসকে তো আপনি অবজ্ঞা করতে পারেন না।
বেগম খালেদা জিয়া জনপ্রিয় বলেই দলের দায়িত্ব পেয়েছেন বারবার। ১৯৯১ সালে বেগম খালেদা জিয়া যখন ক্ষমতায় আসেন তখন দেশ গণতন্ত্রহারা। তিনি আপসহীন নেতৃত্ব দিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন।
বাড়িতে ডাকাত পড়লে আগে ডাকাত তাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হয় এবং বাড়িতে যার প্রতি আস্থা বেশি তার নেতৃত্বেই ডাকাত তাড়াতে হয়। বাংলাদেশে বারবার গণতন্ত্রের পথ রুদ্ধ হয়েছে। বেগম খালেদা জিয়া বারবার গণতন্ত্রের দ্বার উন্মোচন করেছেন।
জাগো নিউজ : শীর্ষ নেতৃত্বের প্রতি আস্থার কথা বললেন। দলের অন্য নেতাদের প্রসঙ্গে কী বলবেন?
রুহুল কবির রিজভী : যে কোনো সময়ের চেয়ে বিএনপির নেতারা এখন ঐক্যবদ্ধ। বেগম খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে আমরা সবাই মিলে কাজ করছি।
জাগো নিউজ : তারেক রহমানের ‘ভারপ্রাপ্ত ’ দায়িত্ব পাওয়া নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। আওয়ামী লীগ এখনও সমালোচনা করছে…
রুহুল কবির রিজভী : শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সভাপতি হওয়া নিয়ে আমারও আপত্তি আছে। দেশের বাইরে থাকা অবস্থায় তাকে সভাপতি করা হয়। বেগম খালেদা জিয়া দলের সদস্য হয়েছেন। সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হয়েছেন। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হয়েছেন। এরপর দলের প্রধান হন। তারেক রহমানও দলের কাঠামো মেনেই সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হয়েছেন।
আওয়ামী লীগ সব বিষয় নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করতে চাইছে। তারা কী বলছে, তা নিয়ে আমরা ভাবছি না।
জাগো নিউজ : অভিযোগ রয়েছে রাতারাতি দলের গঠনতন্ত্র পরিবর্তন করে তারেক রহমানকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে…
রুহুল কবির রিজভী : গঠনতন্ত্র পরিবর্তন করা হয়েছে কাউন্সিলের মাধ্যমে। রাতারাতি গঠনতন্ত্র পরিবর্তনের কোনো ঘটনা ঘটেনি।
জাগো নিউজ : তারেক রহমানের নাগরিকত্ব বর্জন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে সরকার। দলের কাছে এর ব্যাখ্যা কী?
রুহুল কবির রিজভী : শেখ পরিবারের অধিকাংশ সদস্যেরই দ্বৈত নাগরিকত্ব রয়েছে। তারেক রহমান বাংলাদেশের নাগরিকত্ব বর্জন করেননি। এটি সরকারের চরম মিথ্যাচার। তিনি রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য পাসপোর্ট জমা দিয়েছেন। এখানে নাগরিকত্ব বর্জনের কী হলো?
মিডিয়া আওয়ামী লীগের হয়ে এ বিষয়গুলো বড় করে দেখাতে চায়। এসব মিথ্যা ইস্যু তৈরি করে মিডিয়া জনইস্যুগুলো ধামাচাপা দিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। সরকারের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী যে মিথ্যাচার করেছেন, তার প্রমাণ আমরা দিয়েছি।
শেখ হাসিনাও যে রাজনৈতিক আশ্রয়ে একাধিক দেশে বসবাস করেছেন, তা ভুলে গেছে আওয়ামী লীগ। শেখ হাসিনাকে ভারত সরকার ভাতা দিতেন, তা প্রণব মুখার্জি বইয়ে লিখেছেন। শেখ হাসিনাকে ভাতা দিতেন প্রণবরা, আর জনগণের সরকার যাতে ক্ষমতায় আসতে না পারে সেজন্য নীলনকশা করেন।
ভারতের বিশেষ অনুগ্রহে ক্ষমতায় আছেন শেখ হাসিনা। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন এবং নির্বাচন পরবর্তী ভারতের ভূমিকা কী ছিল সবাই তা জানেন। জনগণের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে ভারত এখনও আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে।
এএসএস/জেডএ/এমএআর/আরআইপি