সরকার সাম্প্রদায়িক শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করছে
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম; বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি। সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন দুই দশক ধরে। সংগঠনের সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছান নিজের যোগ্যতা, ত্যাগ আর প্রজ্ঞার বলে। দেশে প্রগতি ধারার ছাত্র রাজনীতির অভিভাবক সংগঠক বলে পরিচিত ছাত্র ইউনিয়নেরও সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
রাজনীতির কারণে ঢাকা কলেজ থেকে বহিষ্কার হন, জেল খাটেন একাধিকবার। স্বাধীনতার পর গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ডাকসুর ভিপি (সহ-সভাপতি) নির্বাচিত হন। নেতৃত্ব দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের গেরিলা বাহিনীর।
রাজনীতি, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও জোটভুক্তিসহ বিভিন্ন বিষয়ে সম্প্রতি মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র। আলোচনায় গুরুত্ব পায় কোটাবিরোধী আন্দোলন প্রসঙ্গেও। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু। আজ থাকছে এর প্রথম পর্ব।
জাগো নিউজ : আসছে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। দেশে চলমান রাজনীতি কীভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম : দেশে বর্তমানে দুই ধরনের রাজনীতি বিরাজ করছে। একটি হচ্ছে, হালুয়া-রুটির ভাগবাটোয়ারার রাজনীতি। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, এ ভাগবাটোয়ারার রাজনীতিই এখন মূলধারার রাজনীতি।
অপরদিকে আদর্শবাদী ধারার যে রাজনীতি, তা আপাতত দুর্বল ও ক্ষয়িষ্ণুপ্রায়। রাজনীতি বলতে সাধারণত মানুষ মূলধারাকেই সামনে দেখে এবং সেই রাজনীতি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে স্থির থাকেন। তবে সাধারণরা আদর্শের রাজনীতি যে একেবারে দেখেন না, তা নয়। কিন্তু আদর্শবাদী রাজনীতির সরব উপস্থিতি না থাকার কারণে মানুষ এখনই কিছু একটা করতে পারবে, তা ধর্তব্যের মধ্যে নেয় না। বিরাজমান রাজনীতির চিত্রের কথা বললাম।
জাগো নিউজ : ভরসা তো এই মূলধারাতেই?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম : এই চিত্র চিরদিন একই থাকবে, তা মনে করার কোনো কারণ নেই। কেননা রাজনীতির গতিধারায় কখনও কখনও কৃষ্ণপক্ষও দেখা যায় এবং এর আড়ালে আলো থাকে। পরিবর্তন হয়ে এই আলো সামনে চলে আসে।
রাজনীতির হালচাল নিয়ে বলতে হয়, মূলধারার রাজনীতিতেও এখন পলিটিক্স ঢুকে গেছে। এটিই এখন প্রবাদ। রাজনীতি বলতে সাধারণ মানুষ নীতি বোঝেন, আর পলিটিক্স বলতে বোঝেন নীতিহীন মানুষের রাজনীতি।
জাগো নিউজ : যারা আদর্শের কথা বলে রাজনীতি করছেন তারা তো দিনদিন দুর্বল হচ্ছেন। আপনাদের জন্য তো চ্যালেঞ্জ আরও বাড়ছে?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম : অবশ্যই চ্যালেঞ্জ বাড়ছে। এটি অপ্রত্যাশিত নয়। শ্রেণিদ্বন্দ্ব থেকেই এ চ্যালেঞ্জ বাড়ছে। আন্তর্জাতিক ও জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে দুটি শক্তি পরস্পরের বিরুদ্ধে দ্বন্দ্বে লিপ্ত। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনীতির যে মেরুকরণ তা এ শক্তির ওপর ভর করে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়ই সাম্রাজ্যবাদের অনুসারী। সাম্রাজ্যবাদ শক্তির প্রভাবেই উভয় দল ক্ষমতায় আসছে। কোনো আদর্শবাদের ভিত্তিতে তারা ক্ষমতায় আসে না। তারা ক্ষমতায় গিয়ে অবাধে লুটপাট এবং ব্যক্তিগত সম্পদ আহরণে ক্ষমতায় যেতে মরিয়া।
বাজার অর্থনীতিই এখন বাজারকেন্দ্রিক রাজনীতি তৈরি করেছে। সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের অর্থনীতিতে আমাদের এখানে চলছে নয়া উদারনীতির রাজনীতি। এ রাজনীতিই লুটপাটের অর্থনীতি তৈরি করছে। লুটপাটের ভাগবাটোয়ারা নিয়ে দ্বন্দ্বে লিপ্ত আজকের মূলধারার দল দুটি। এ দ্বন্দ্ব যে শুধু আওয়ামী লীগের মধ্যেই, তা নয়। দল দুটির নিজেদের মধ্যেও একই প্রশ্নে দ্বন্দ্ব বিরাজমান। বিএনপি-জামায়াতের হরতাল-অবরোধে যত মানুষ মারা গেছে, এর চেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে। একইভাবে মরছে বিএনপির মধ্যেও। গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে এর বহু প্রমাণ রয়েছে।
জাগো নিউজ : এর দায় তো আপনাদের ওপরেও বর্তায়। বামপন্থী সংগঠনগুলোর দুর্বলতার কারণেই হয়তো এমন হিংসার রাজনীতি...
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম : ইতিহাস সবসময় সমান্তরালভাবে অগ্রসর হয় না। ইতিহাসের পথ আঁকাবাঁকা। রিমোর্ট কন্ট্রোলের মাধ্যমে পর্দার আড়াল থেকে বাংলাদেশ শাসন করছে সাম্রাজ্যবাদ। সরকারের মধ্যকার সরকার দেশ শাসন করছে। সাধারণ মানুষের হাতে ক্ষমতার উৎস নেই।
সাম্রাজ্যবাদ এতই ক্ষমতাবান যে সরকারও তাদের সঙ্গে থাকছে, বিরোধী দলও তাদের সঙ্গে থাকছে। এ কারণে ক্ষমতার পটপরিবর্তন হলেও তাদের স্বার্থে কোনো ব্যাঘাত ঘটে না। সরকারগুলো লুটপাটের বাধা মোকাবেলায় সর্বশক্তি প্রয়োগ করতে চায়। বামপন্থী তথা জনগণের সামনে এ চ্যালেঞ্জ সবসময় ছিল। এ কারণে চ্যালেঞ্জ আরও বাড়ছে আদর্শবাদী সংগঠনগুলোর কাছে।
জাগো নিউজ : জনগণকেও সঙ্গে পাচ্ছেন না চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায়…
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম : সোভিয়েত ইউনিয়নের সময় পৃথিবীতে যে ভারসাম্যের শক্তি ছিল, তা এখন নেই। এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। আবার জনগণের শক্তি যেন অগ্রসর হতে না পারে, সে জন্য সুকৌশলে আমলাতন্ত্রের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখা হয়েছে। জনগণ চাইলেও কৌশলের কারণে টিকতে পারছে না।
জাগো নিউজ : সময় ও বাস্তবতার নিরিখে বামপন্থী ধারার রাজনীতিতেও পরিবর্তন আনা জরুরি ছিল কিনা?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম : আদর্শবাদী নীতির কোনো পরিবর্তন হয় না। আমরা বৃটিশদের বিরুদ্ধে যে নীতিতে যুদ্ধ করেছি, একই নীতিতে আমরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি। স্বাধীনতার প্রশ্নে কতবার আঘাত এসেছে! কিন্তু স্বাধীনতার জন্য মানুষ মরিয়া ছিল সবসময়। নতুন কোনো নীতির প্রয়োজন নেই।
১৯৭১ সালে যে নীতির ভিত্তিতে দেশ স্বাধীন করেছিলাম, সেই নীতির ভিত্তিতেই সমাজ প্রতিষ্ঠা করা আমাদের প্রধান কর্তব্য।
জাগো নিউজ : আপনাদের আন্দোলনের সতীর্থরাও মিলে যাচ্ছে মূলধারার রাজনীতিতে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে ওয়ার্কার্স পার্টি বা জাসদের মতো দলগুলোর নীতি এখন মিলেমিশে একাকার। নীতির প্রশ্নে কী বলবেন?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম : কে সতীর্থ আর সতীর্থ নয়, তা নির্ভর করে সে কোন পক্ষে আছেন। যাদের কথা বললেন, তারা আর এখন আমাদের কোনোভাবেই সতীর্থ নন। এক সময় তারা আমাদের সতীর্থ ছিলেন।
নীতির প্রশ্নে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি হচ্ছে সমমনা দল। অথচ সমমনা হওয়া সত্ত্বেও তারা মিলেমিশে দেশ পরিচালনা করতে পারছে না। কারণ লুটপাটের নীতিতে দ্বন্দ্ব অনিবার্য। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যকার ব্যবস্থাপনাই সংঘাতপূর্ণ নীতিকে সমর্থন করে চলছে। এটি রুগ্ন ও পশ্চাৎপদ ব্যবস্থাপনা। এ ব্যবস্থাপনায় যারা স্থান পায় বা নিতে চায় তাদের অন্তত সতীর্থ মনে করি না। আত্মোপলব্ধি করে যদি নিজেরা অগ্নিপরীক্ষায় পাশ করে ফিরে আসেন, তাহলে তাদের সাদরে গ্রহণ করে একসঙ্গে কাজ করে যাব।
জাগো নিউজ : বাম ঘরানার এ নেতারাও তো বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে জোটভুক্ত হয়েছিলেন?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম : জোটভুক্ত হওয়ার সময় তারা বলেছিলেন, আপাতত আমরা গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়টি সমাধান করতে চাই। শ্রেণি সংগ্রামের বিষয়টি পরে সুরাহা করা যাবে। আমরা বলেছিলাম, পারবেন না।
জাগো নিউজ : এখন কী বলবেন?
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম : ২০০৬ সালের আগে থেকে জোট নিয়ে কথা হচ্ছিল। ২০১৮ সাল এখন। ১২ বছর আগে যে গণতন্ত্র ছিল এখন তা আরও নাজুক অবস্থায় পড়েছে। গণতন্ত্রহীন শাসন ব্যবস্থার যে প্রক্রিয়া চালু করেছে সরকার, সেই প্রক্রিয়ার অংশ এখন রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনুরাও।
আর রাষ্ট্রীয়ভাবে অসাম্প্রদায়িক ধারা বজায় রাখতে যে চর্চা চলতো এখন ধীরে ধীরে তাও বিলীন হয়ে যাচ্ছে। সরকার সাম্প্রদায়িক শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করছে। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম রেখে সরকার তার সাম্প্রদায়িক চরিত্র উন্মোচন করেছে।
জাগো নিউজ : রাষ্ট্রধর্মের প্রশ্নে রাশেদ খান মেনন ও হাসানুল হক ইনু বিরোধিতাও করেছিলেন…
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম : হ্যাঁ; তারা বলেন, রাষ্ট্রধর্ম রাখার সময় আমরা বিরোধিতা করেছিলাম। হ্যাঁ, তারা সংসদে বসেই সামান্য বিরোধিতা করেছিলেন। অথচ এটি ছিল বিভক্তি ভোটের ব্যাপার। নিয়ম হচ্ছে, এমন বিষয়ের বিপক্ষে থাকলে সংসদ থেকে বের হয়ে যেতে হয়। তারা বের হননি। তারা সংসদেই বসেছিলেন। বসে থাকার মানে হচ্ছে সমর্থন জানানো। তারাও রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের পক্ষে থাকলেন।
আর এখন যে সাম্প্রদায়িক বীজ বুনন চলছে সরকার তাতেও সমর্থন দিচ্ছে। হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে বৈঠক করে সরকার যেসব ভয়ঙ্কর কথা বলছে, তা জামায়াতকেও হার মানাচ্ছে। কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীদের সিভিল সার্ভিসে যোগ দেয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ইসলামীকরণে আওয়ামী লীগ বিএনপির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমেছে।
এএসএস/এমএআর/জেআইএম